১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শনিবার, ৫:০৬

পেনশনের জন্য নেওয়া ঋণ শোধ করছে না বিমান

এক হাজার ৮৭৭ জন কর্মীকে ‘স্বেচ্ছা অবসরে’ পাঠাতে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ২৯০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল বিমান বাংলাদেশ। কর্মীদের পেনশন ও গ্র্যাচুইটির টাকা পরিশোধ করার জন্য নেওয়া সেই ঋণ সুদে-আসলে বেড়ে বর্তমানে ৪১৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত আট বছরে ঋণের অর্ধেক টাকা পরিশোধ করার কথা থাকলেও এক কানাকড়িও পরিশোধ করা হয়নি। যেসব শর্তে ঋণের এ টাকা অর্থ মন্ত্রণালয় ছাড় করেছিল, বিমান সেগুলোও মানেনি। এখন এই টাকা পরিশোধে অক্ষমতার কথা জানিয়ে সরকারি ইক্যুইটি খাতে স্থানান্তরের আবদার করেছে জাতীয় পতাকাবাহী এ সংস্থা।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর অতিরিক্ত জনবলে জর্জরিত সংস্থাটিতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিল। লোকসান কমাতে তখন বিমান থেকে এক হাজার ৮৭৭ জন কর্মীকে ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট স্কিমের (ভিআরএস) আওতায় স্বেচ্ছা অবসরে পাঠানো হয়। এ প্রকল্পের আওতায় পেনশন, গ্র্যাচুইটিসহ সব পাওনা হাতে নিয়ে অনেকে চাকরি ছেড়েছেন। আবার অনেকে মামলা করে চাকরিতে ফিরেছেন।
বিমানের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পেনশন বা গ্র্যাচুইটির জন্য নেওয়া ঋণের টাকা সরকারের কাঁধে চাপাতে বিমানের চেষ্টার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। বিমানের প্রশাসনিক এই মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়ে বলেছে, ১২ দফা শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয় এ ঋণের টাকা ছাড় করেছিল। এর মধ্যে একটি অন্যতম শর্ত ছিল স্বেচ্ছা অবসরে যাদের পাঠানো হবে তাদের পদ বিলুপ্ত করে সাংগঠনিক কাঠামো সংশোধন করা। এই সংশোধিত সাংগঠনিক কাঠামো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পেতে হবে। বিমান এ শর্ত মানেনি। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের স্বাক্ষরে পরিবর্তিত একটি সাংগঠনিক কাঠামো বিমান থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও তা সংস্থাটির পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক অনুমোদিত ছিল না। পরিচালনা পর্ষদ অনুমোদিত সাংগঠনিক কাঠামো পাঠানোর জন্য মন্ত্রণালয় বিমানকে আট দফা তাগাদা দিয়েছে। বিমান বিষয়টি আমলে নেয়নি। জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়ার তো সুযোগই নেই।
বিমানের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যেসব পদের লোক স্বেচ্ছা অবসরে গেছেন সেসব পদ বিলুপ্ত হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। ওই সব পদে পরে বিজ্ঞাপন দিয়ে লোক নিয়োগ করা হয়েছে। তা ছাড়া বিমানকে কম্পানি করার সময় সরকার বিমানের জনবল তিন হাজার চার শর মধ্যে সীমিত রাখার শর্ত দিলেও বিমান তা মানেনি। বিমানে প্রায় নিয়মিত লোক নিয়োগ করা হচ্ছে। নামকাওয়াস্তে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে এসব লোক নিয়োগ করা হয়। নতুন নিয়োগ পাওয়া এসব লোক যাঁরা বর্তমানে বিমানে চাকরি করছেন তাঁদেরই আত্মীয়স্বজন। পাইলট থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই লোক নিয়োগের সময় আত্মীয়করণ করা হয়েছে। একটি পরিবার থেকে পাঁচজন পাইলটও রয়েছেন বর্তমান বিমান কর্মকর্তাদের মধ্যে। এ চিত্র শুধু পাইলট নয়, সব স্তরেই রয়েছে।
এ ছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয় শর্ত দিয়েছিল ঋণের টাকা ৫ শতাংশ সুদে ১৫ বছরে ষাণ্মাসিক ভিত্তিতে পরিশোধ করতে হবে। বিমান সরকারের দেওয়া এ সিদ্ধান্তও মানেনি। ঋণ নেওয়ার পর গত আট বছরে বিমান একটি টাকাও পরিশোধ করেনি। এ ঋণের টাকা ব্যয়ের দুই মাসের মধ্যে কন্ট্রোলার জেনারেল অব ফরেন এইডেড প্রজেক্টের মাধ্যমে অডিট করার শর্ত ছিল। এ শর্তও বিমান মানেনি বলে বিমানের কর্মকর্তারাই জানিয়েছেন। তাঁরা আরো জানিয়েছেন, এক হাজার ৮৭৭ জনের পেনশন বা গ্র্যাচুইটির টাকা পরিশোধের কথা বলা হলেও এ তথ্য সত্য নয়। কারণ অনেক বিমানকর্মী আদালতের নির্দেশে চাকরি ফিরে পেয়েছেন। তাঁরা পেনশন বা গ্র্যাচুইটির টাকা নেননি। তাঁরা চাকরি শেষ করে স্বাভাবিক নিয়মে অবসরে যাওয়ার সময় পেনশন বা গ্র্যাচুইটির টাকা দাবি করবেন।
বিমান কেন পেনশন বা গ্র্যাচুইটির জন্য নেওয়া ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারছে না জানতে চাইলে বিমানের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিমান আগে করপোরেশন ছিল। পরে সংস্থাটিকে কম্পানি করা হয়েছে। পুনর্গঠন ও বাণিজ্যিকীকরণ করার জন্য বিমান নতুন প্রজন্মের বোয়িং কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ধারাবাহিকতায় চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ই আর এবং দুটি বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ কেনা হয়েছে। এই ছয়টি উড়োজাহাজ কেনার জন্য দেশি-বিদেশি ব্যাংক থেকে আট হাজার ২৯৬ কোটি টাকা ঋণ করেছে। এই ঋণের কিস্তি হিসেবে গত ৩০ জুন পর্যন্ত তিন হাজার ৫৫১ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। আরো চারটি বোয়িং ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বিমানবহরে যুক্ত হবে। এতে বিমানের ঋণের পরিমাণ আরো বাড়বে।
বর্তমানে প্রতিবছর গড়ে ৬০০ কোটি টাকা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে। তার ওপর ভাড়া করা এয়ারক্রাফটের নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করার ফলে বিমানের নগদ তহবিল প্রবাহের ভারসাম্য রাখাটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় স্বেচ্ছা অবসর গ্রহণ স্কিমের আওতায় কর্মীদের পেনশন বা গ্র্যাচুইটির জন্য নেওয়া ঋণ ও সুদের ৪১৯ কোটি টাকা বর্তমানে পরিশাধ করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় ঋণ ও সুদের টাকা সরকারি ইক্যুইটি খাতে স্থানান্তরের অনুরোধ করা হয়েছে।
ঋণের টাকা পরিশোধে অক্ষমতার কথা জানালেও বিমান গত অর্থবছরে লাভ করার ঘোষণা দিয়েছে। বিমান বলেছে, গত অর্থবছরে তারা ২৭৬ কোটি টাকা লাভ করেছে। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিমান ৩২৪ কোটি টাকা লাভ করে। বিমান সংশ্লিষ্টরা বলছে, এই লাভের মধ্যে শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। বিমান শুধু কর্মীদের পেনশনের টাকাই নয়, তারা জ্বালানি তেলের টাকাও পুরোপুরি পরিশোধ করতে পারছে না। এ অবস্থায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পাওনা টাকাও পরিশোধ করতে পারছে না।
বিমান সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, বিমান মুনাফা করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু কিভাবে মুনাফা করেছে তার ব্যাখ্যা দেয়নি। শুধু অপারেটিং কস্ট বিবেচনা করলেই হবে না। পুরো দায়দেনা মিটিয়ে কত লাভ হয়েছে তা বিমানকে বলতে হবে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/02/11/462323