১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শনিবার, ৫:০৩

ই-বর্জ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকি

নতুন করে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে ইলেক্ট্রনিকস বর্জ্য। বাতিল হওয়া টিভি, ফ্রিজ, কম্পিউটার, মুঠোফোন, বিদ্যুৎসাশ্রয়ী বাতিসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতি করছে। যা ইলেক্ট্রনিকস বর্জ্য বা ই-বর্জ্য নামে পরিচিত। গবেষণা বলছে, দুই বছর আগেও দেশে দৈনিক ৫০০ টনের বেশি ই-বর্জ্য তৈরি হতো। বর্তমানে তা আরো বেড়েছে। কিন্তু এসব বর্জ্য ধ্বংস, রক্ষণাবেক্ষণ বা ব্যবস্থাপনার জন্য দেশে কোনো পরিকাঠামো নেই। নেই আইন কিংবা সচেতনতাও। বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) গবেষণায় এমন চিত্র উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ই-বর্জ্যের বিষয়ে বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশে আইন আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ই-বর্জ্যের বিষয়টি এখন বাংলাদেশের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। এর স্বাস্থ্যঝুঁকিও মারাত্মক। এ ক্ষেত্রে এখনই ব্যবস্থা না নিলে এর জন্য চড়া মূল্য দিতে হবে। সুইডেনের প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক একটি সংগঠন এসএসএনসির অর্থায়নে বাংলাদেশের বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) পরিচালিত ‘ই-বর্জ্য: বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র-২০১৪’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে বাতিল হয়ে যাওয়া ই-বর্জ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫১ লাখ টন। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ১ কোটি ১০ লাখ টনে দাঁড়ায়। এর মধ্যে মোবাইল, টেলিভিশন এবং কম্পিউটার তৈরির বর্জ্যের পরিমাণ বেশি। এদিকে বাংলাদেশে জাহাজভাঙা শিল্পের জন্য আমদানি করা প্রতিটি জাহাজে বিভিন্ন প্রকারের বিপুল পরিমাণ অব্যবহৃত বৈদ্যুতিক পণ্য থাকায় এ থেকে তৈরি হওয়া বর্জ্য বেশি। এর বাইরে সিএফএল বাতি, মার্কারি বাতি, থার্মোমিটারসহ নানা প্রকারের চিকিৎসা ও গৃহস্থালি যন্ত্র থেকে তৈরি হয় বর্জ্য। ইএসডিও’র গবেষণাটি করা হয় প্রশ্নপত্র জরিপের ভিত্তিতে। মূলত ঢাকা এবং চট্টগ্রামে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত পরিচালিত এ জরিপের জন্য বাসাবাড়ি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বৈদ্যুতিক পণ্য ব্যবহারকারী, আমদানিকারক, বিক্রেতা, মেরামতকারী এবং বাতিল হওয়া পণ্য পুনর্ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার (রি-সাইক্লিং) কাজে জড়িত ছয় হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা হয়। গবেষণার সুপারিশে বলা হয়েছে, ই-বর্জ্যের বিষয়ে সঠিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি দরকার এবং নীতিমালা মানা উচিত, অবৈধভাবে আমদানি করা ই-বর্জ্য ঠেকাতে এবং ভবিষ্যতে এবিষয়ে আরো বেশি বেশি গবেষণা দরকার হবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকায় ই-বর্জ্য ফেলার জন্য স্থায়ী কোনো স্থান নেই। তবে সায়েন্স ল্যাবরেটরি রোড, চানখাঁরপুল, নিমতলী ও ধোলাইখালে হকাররা বিভিন্ন জায়গা থেকে কম্পিউটারসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক পণ্য এনে জড়ো করে। এখান থেকে পুরনো বৈদ্যুতিক পণ্য বিক্রেতারা সচল জিনিসগুলো পরীক্ষা করে কিনে নেয়। আর একেবারেই অচল যে পণ্যগুলো সেগুলো থেকে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, প্লাস্টিক, লোহা এবং তামার মতো ধাতুগুলো খুলে আলাদা করে কেজি দরে বিক্রি করা হয়। এসব জায়গার ই-বর্জ্য সংগ্রহকারী কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৮০ হাজার টাকার পণ্য কিনলে সেগুলো তারা সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারেন।
এসব বর্জ্যের স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকির বিষয়ে কথা হয় ইএসডিওর গবেষণাকর্মটির প্রধান সমন্বয়ক ও প্রাণ-প্রতিবেশ বিশেষজ্ঞ (ইকোলজিস্ট) ড. শাহরিয়ার হোসেনের সঙ্গে। এ প্রসঙ্গে সিএফএল বাতি, মোবাইলফোন ও কম্পিউটার বর্জ্যকে উদাহরণ হিসেবে টানেন তিনি। মানবজমিনকে বলেন, একটি সিএফএল বাতিতে সাধারণত ৮ থেকে ১০ মিলিগ্রাম মার্কারি গ্যাস আকারে থাকে। ২০১২ সাল পর্যন্ত সরকার প্রায় ৮ কোটি সিএফএল বাতি বিনামূল্যে বিতরণ করেছে। এখন যার সবই পরিত্যক্ত। সে ক্ষেত্রে এ বাতিগুলো থেকে যে গ্যাস নির্গত হয়েছে, তার অধিকাংশই শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্কে পৌঁছেছে। এসব বাতিতে কঠিন আকারে যে সিসা আছে, সেটা মিশে যায় মাটিতে কিংবা পানিতে, যা খাদ্যশৃঙ্খলার (ফুড চেইন) ভেতর দিয়ে পুনরায় মানুষের শরীরে চলে যায়। এতে শিশু ও বয়স্করা আক্রান্ত হয় বেশি। কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। ব্যক্তিগত পর্যায়ে মোবাইলফোন, সিএফএল বাতি এবং কম্পিউটার বর্জ্য থেকে নির্গত বিষাক্ত পদার্থ ও রাসায়নিকেই মানুষ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে জানিয়ে শাহরিয়ার আরো বলেন, এখন এক হাজার টাকাতেও একটা সেলফোন পাওয়া যায়। যার জীবৎকাল খুবই স্বল্প। কম্পিউটার সামগ্রী বা পুরনো টিভি যখন একেবারেই কাজে লাগছে না, তখন সেখান থেকে শুধু প্লাস্টিকটা নেয়া হচ্ছে। যেটা বিক্রি করা যাবে বা রিসাইকেল করা যাবে। বাকি যেগুলো কাজে লাগানো যাচ্ছে না, সেগুলোই সবচেয়ে ক্ষতিকর। ঢাকায় ই-বর্জ্য ফেলার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। হকাররা বিভিন্ন বাতিল বৈদ্যুতিক পণ্য এনে বিভিন্ন স্থানের ভাঙারি দোকানে জড়ো করেন। আমাদের দেশে দু’ভাবেই বর্জ্য ডাম্পিং করা হয়। একটা হলো খোলা জায়গায় আর অপরটি হলো পুড়িয়ে ফেলা। দু’টিই ক্ষতিকর বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ই-বর্জ্যের আইন প্রসঙ্গে এই বিশেষজ্ঞ জানান, ২০১২ সালে একটি গাইড লাইন হয়েছিল। পরবর্তীকালে তা পরিবেশ মন্ত্রণালয় হয়ে অধিদপ্তর হয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়। ২০১৫ সালে আইন মন্ত্রণালয় বর্জ্য ব্যবস্থার জন্য আলাদা আইন প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করে তা ফেরত দেয়। কিন্তু সব বর্জ্য তো আর এক নয়, সেটা তারা বুঝতে চায়নি বলে ড. শাহরিয়ার উল্লেখ করেন। তারা পরিবেশ জাস্টিফাই ও আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক করেননি। সবশেষে পরিবেশ মন্ত্রণালয় ২০১৬ সালে আবার উদ্যোগ নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের ই-বর্জ্যের ৮০ শতাংশ আসে অবৈধভাবে বিদেশ থেকে। সুতরাং আইন করে আটকাতে না পারলে সহজে তা ঢুকে পড়বে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
দেশের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান জনস্বাস্থ্যের ওপর ই-বর্জ্যের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, এগুলো নষ্ট হয় না। পরিবেশের ক্ষতি করে। গৃহস্থালি বর্জ্যের থেকে ই-বর্জ্যের ক্ষতির মাত্রাটা অনেক বেশি। অপচনশীল এসব বর্জ্যের ধাতু এবং রাসায়নিক যেমন মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে, তেমনি এর প্রধান শিকার হয় গর্ভবতী নারী ও শিশুরা। এতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির শিকার হয় তারা। এগুলোর কারণে ক্রনিক ক্যানসার, শ্বাসকষ্ট, কিডনি ও লিভারের বিভিন্ন সমস্যা এবং মস্তিষ্ক ও রক্তনালির বিভিন্ন রোগও হতে পারে বলে জানান তিনি।
http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=53061&cat=2/%E0%A6%87-%E0%A6%AC%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%9C%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%87--%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8