২৭ জুলাই ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:২১

জলজট-যানজটে অচল ঢাকা

দোষারোপের প্রতিযোগিতা

কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে গতকাল রাজধানীতে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা ও যানজটের সৃষ্টি হয়। দোকানপাট, বাসা-বাড়িসহ সব জায়গায় পানি ঢুকে অচল হয়ে পড়ে নগরবাসীর জীবনযাত্রা। স্কুল-কলেজগামী ছাত্রছাত্রী ও অফিসগামীরা বৃষ্টির মধ্য দিয়ে চলতে গিয়ে চরম বিপাকে পড়েন। জলাবদ্ধতার কারণে প্রতিটি সড়কেই দেখা দেয় তীব্র যানজট। ১০ মিনিটের পথ যেতে এক থেকে দুই ঘণ্টা লেগে যায়। আর এ সুযোগে রিকশা-সিএনজির ভাড়া বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
গত সোম ও মঙ্গলবারের টানা বৃষ্টিপাতের পর গতকাল বুধবার সকাল থেকে তিন-চার ঘণ্টা ভারী বৃষ্টিপাত হয়। মূল সড়ক থেকে অলিগলি পর্যন্ত হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি জমে যায়। রাজধানীজুড়ে পানি থই থই করতে থাকে। এ পানির মধ্য দিয়ে গাড়ি চলাচল করার সময় রাস্তার দু’পাশে ঢেউ আঁছড়ে পড়ে। রাস্তা দেখে মনে হয় যেন এক একটি নদী। মূলত খালগুলো বন্ধ হওয়া ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা অকার্যকর হয়ে যাওয়ায় পানি অপসারণে ধীর গতি দীর্ঘ সময় পানি আটকে এ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এর সাথে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির ফলে দীর্ঘ যানজটের কারণে অসহনীয় ভোগান্তিতে পড়েন নগরবাসী।
সরেজমিন দেখা গেছে, বৃষ্টিপাতে রাজধানীর মিরপুর-১০ থেকে কাজীপাড়া-শাওড়াপাড়া সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এ সড়কের দুই লেনেই হাঁটু সমান পানি জমে যায়। গত রাত পর্যন্ত এ পানি জমে ছিল। মূল সড়কে পানি থাকায় আশপাশের অলিগলিতেও ছিল হাঁটু পানি। পানির মধ্য দিয়ে চলতে গিয়ে সব ধরনের যানবাহনের গতি ধীর হয়ে যায়। এতে যানজট তীব্র আকার ধারণ করে।
কাওরানবাজারে দেখা যায়, হোটেল সোনারগাঁও থেকে মগবাজার ফাইওভার পর্যন্ত কোমর সমান পানি জমে গেছে। এ ছাড়া ফার্মগেট থেকে কাওরানবাজার সড়কেও পানি জমে যায়। পান্থপথসহ আশপাশের সড়কেও পানি জমে। এ কারণে কাওরানবাজার মোড় থেকে সব পথেই তীব্র যানজট দেখা দেয়। এ সুযোগে ভ্যান ও রিকশা পারাপার করতে দেখা যায়। ২০-৫০ মিটার পথ যেতে আরোহীদের গুনতে হয় ২০-৩০ টাকা।
পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে কোমর সমান পানি জমে যায়। এতে সিএনজি-প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেলের ইঞ্জিনে পানি ঢুকে নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া রাস্তা ভাঙাচোরা থাকায় অনেক রিকশা উল্টে যায়।
মিরপুরের কালশী সড়কে পানির ঢেউ আঁছড়ে পড়তে থাকে। এ পানিতে শিশুদের খেলা করতে দেখা যায়।
ব্যাংকপাড়া খ্যাত মতিঝিল থেকে দৈনিক বাংলা সড়কে পানি থই থই করতে থাকে। এ কারণে দু’পাশের দোকানপাট বন্ধ থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক চত্বরেও হাঁটু পানি জমে যায়। আর কে মিশন রোড, গোপীবাগেও পানি জমে যায়। পুরানা পল্টনসংলগ্ন সচিবালয়ের সড়কগুলোতেও পানি জমে যায়। উত্তরার বিমানবন্দর এলাকা, আশকোনা রোডসহ আশপাশের এলাকায় হাঁটু পানি জমে ভোগান্তিতে পড়েন হজযাত্রীসহ এলাকাবাসী। ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের মিরপুর রোডে দেখা যায় পানি আর পানি। এ সড়কে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যানজট লেগে থাকে।
শান্তিনগর, রাজারবাগ, ফকিরাপুল, বিজয়নগরসহ আশপাশের প্রতিটি সড়কেই ছিল হাঁটু সমান পানি। এসব সড়কে ড্রেন নির্মাণ করতে রাস্তা খুঁড়ে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ফুটপাতগুলোও ভাঙা থাকায় অসহনীয় দুর্ভোগে পড়েন মানুষ। খিলগাঁও মূল সড়ক থেকে চৌধুরীপাড়া আবুল হোটেল পর্যন্ত বাইপাস সড়কে হাঁটু পানি জমে যায়। এ ছাড়া সড়কের আশপাশের সড়কগুলোতেও পানি জমে যাওয়ায় চলাচলে দুর্ভোগে পড়েন মানুষ। বনশ্রী থেকে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত সড়ক দীর্ঘ দিন থেকে ভেঙেচুরে গেছে। এ সড়কে পানি জমে যাওয়ায় অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হয় এলাকাবাসী। শুধু এসব এলাকায়ই নয়, মোহাম্মদপুর, আগারগাঁও, ধানমন্ডি, গুলশান, খিলক্ষেত, বাড্ডা, রামপুরা, তেজগাঁও, সংসদ ভবন, মালিবাগ, মৌচাক, কমলাপুর, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, মানিকনগর, বাসাবো, মুগদা, মাণ্ডা, সিপাহীবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
বৃষ্টিপাত ও জলাবদ্ধতার কারণে অফিস ও স্কুলগামীরা বেশি সমস্যায় পড়েন। ছাতা-রেইনকোর্ট নিয়ে বের হন নগরবাসী। তার পরও টানা বৃষ্টিপাতের কারণে রাস্তায় বেরিয়েই ভোগান্তির শিকার হন। অলিগলির সড়কে হাঁটু পানি মাড়িয়ে মূল রাস্তায় আসতে হয়। এরপর রিকশা সঙ্কট। যেগুলো পাওয়া যায় তাতে চালকেরা দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া হাঁকান। অনেকে বেশি ভাড়া গন্তব্যস্থলে গেলেও আবার অনেকে হেঁটেই রওনা হন। আর যারা গণপরিবহনে যাওয়ার চেষ্টা করেন তারাও পড়েন যানজটের ফ্যাসাদে।
বেলা ১১টা। অফিসে পৌঁছার সময় শেষ হয়ে গেছে একঘণ্টা আগে। তখনো সড়কের পাশের একটি দোকানের নিচে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজছেন তিনি। বাস না পেয়ে দীর্ঘ অপোর পর একটি সিএনজিতে ওঠেন বাসাবোর বাসিন্দা আরিফা খাতুন। তাকে ভাড়া গুনতে হয়েছে তিনগুণ। তার মতো এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে নগরীর হাজারো মানুষকে।
সকাল ৮টায় জাতীয় প্রেস কাবের সামনে থেকে গাবতলী যাওয়ার জন্য ৮ নম্বর গাড়িতে ওঠেন আলামিন। দুপুর ১২টার কিছু পরে তিনি গাবতলী পৌঁছাতে সক্ষম হন বলে জানান।
রামপুরা রোডে তুরাগ পরিবহনে বসে থাকা সমীরণ দাস বলেন, যাত্রাবাড়ী থেকে বাসে উঠেছি সকাল ১০টায়। কিন্তু এ পর্যন্ত আসতে প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে গেছে। তিনি বলেন, খিলগাঁও বাইপাস সড়কটি ভাঙাচোরা থাকায় এখানেই এক ঘণ্টার বেশি কেটে গেছে।
বেলা ১টায় শাহবাগে অপেমাণ যাত্রী ইসমাইল হোসেন বলেন, মিরপুরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসের জন্য এক ঘণ্টা ধরে অপো করার পর একটি বাসে উঠেছি। বিকল্প অটো সার্ভিস নামের পরিবহনটি সিটিং সার্ভিসের নামে বিআরটিসি নির্ধারিত ভাড়ার তিনগুণ বেশি নিয়েছে। পল্টন-শাহবাগ এলাকায় তীব্র যানজট থাকায় হাইকোর্টের সামনে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে রওনা দিয়েছেন বেসরকারি একটি কোম্পানির কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, রাস্তায় যে জট তাতে মনে হচ্ছে গাড়ির চেয়ে হেঁটে আগে অফিসে পৌঁছাতে পারব। সে কারণে ভাড়া পরিশোধ করেও হেঁটে রওনা দিয়েছি। এভাবে পল্টন থেকে শাহবাগ, কাকরাইল, কাওরানবাজার, ফার্মগেট, ধানমন্ডির মিরপুর রোড, মৌচাক, খিলগাঁও থেকে মালিবাগ চৌধুরীপাড়া বাইপাস সড়ক, রামপুরা, বাড্ডা, নতুনবাজার, গুলশান, বনানীর বিভিন্ন সড়ক, মহাখালী, উত্তরাসহ বেশির ভাগ মূল সড়কেই ছিল যানজট।
সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারওয়ালাদের জন্য দিনটি ছিল ভয়াবহ। পানির মধ্যে মাঝ রাস্তায় বাসগুলো বন্ধ হয়ে না গেলেও সিএনজি চালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারের ইঞ্জিনে পানি ঢুকে মাঝ রাস্তায় বন্ধ হয়ে অন্যান্য যানবাহনের জন্য দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। মোটরসাইকেল ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা ছোট যান বলে সহজেই সাইল্যান্সার পাইপে পানি প্রবেশ করে দ্রুত ইঞ্জিন অয়েলের সাথে মিশে যায় এবং বন্ধ হয়ে যায়। এমন কয়েকশ’ যানবাহন রাস্তায় বন্ধ হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। ছোট বাহনগুলো যেমন মোটরসাইকেল, অটোরিকশা এমনকি সিএনজিচালিত ছোট প্রাইভেট কারগুলো ঠেলে-ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নেয়া হলেও ভারী যানবাহনগুলো দীর্ঘক্ষণ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়।
অন্যান্য যানবাহনের জন্য দুর্ভোগ হলেও রিকশাওয়ালাদের জন্য গতকাল ছিল আনন্দের দিন। আকাশ ছোঁয়া ভাড়া হাঁকিয়েও যাত্রীদের ধমক খেতে হয়নি। ২০ টাকার ভাড়া ১০০ টাকা। এত ভাড়া দিয়েও অনেকে রিকশা পাননি গন্তব্যে যেতে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে গত ২৩ জুলাই স্থল লঘুচাপের সৃষ্টি হয়। পরদিন ২৪ জুলাই তা শক্তি সঞ্চয় করে সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়ে গেলে শুরু হয় আকাশে ঘন-কালো মেঘের আনা-গোনা। শুরু হয় হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি। ২৫ জুলাই সারা দিনই আকাশ কালো মেঘে ঢেকে থাকে এবং ভারী বৃষ্টিপাত হয়। আর গতকাল সারা দিনে ৬৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে। তবে আগারগাঁওয়ের অফিস থেকে ধারণ করা এ চিত্রের চেয়ে রাজধানীর অন্যান্য এলাকায় বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে আবহাওয়াবিদদের ধারণা।
সরেজমিন দুই মেয়র : বৃষ্টির পর দুপুরে জনগণের দুর্ভোগ দেখতে বের হন ঢাকার দুই মেয়র। দক্ষিণের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন যান ধানমন্ডি এলাকায়। এ সময় তিনি ওয়াসাকে দায়ী করে ড্রেনেজ অব্যবস্থাপনাকে দুর্ভোগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। মেয়র বলেন, কয়েকদিনের অতি বর্ষণের নগরীর বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ডিএসসিসির কর্মীরা এটি নিরসনে কাজ করছেন। বৃষ্টি থামার ৩-৪ ঘণ্টার মধ্যে পানি অপসারিত হয়ে যাবে। তিনি বলেন, এটি মূলত ঢাকা ওয়াসার কাজ হলেও আমাদের লোকেরা মাঠে নেমে এ কাজ করছেন। ওয়াসার লোকজনকে মাঠে পাওয়া যায় না। তাদের এ বিষয়ে আন্তরিকতা কম। এক সাথে ১০০-১৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে পানি যাওয়ার মতো ড্রেনেজ সিস্টেম এ নগরীতে নেই। পরিকল্পনা অনুযায়ী এটা করা হলে এ সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যেত।
বিকেলে রাজধানীর সোনারগাঁও মোড়ে নগরের জলাবদ্ধতা পরিদর্শনে আসেন উত্তরের মেয়র আনিসুল হক। জলাবদ্ধতার সমাধান নাগরিকদের কাছেই চান মেয়র। তিনি বলেন, আমাকে কেউ একজন বলুন, এর সমাধান কী? এ সময় জলাবদ্ধতার জন্য খালগুলো ভরাট হয়ে যাওয়াকেই দায়ী করেন তিনি। তিনি বলেন, আলাদীনের চেরাগ পেলেও এ সমস্যার সমাধান হবে না।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী : সচিবালয়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত আলোচনা সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন ওয়াদা করেন, আগামী বছর থেকে ঢাকায় জলাবদ্ধতা থাকবে না। কিছুদিনের মধ্যেই পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হবে। মন্ত্রী বৃষ্টির কারণে বর্তমান জলাবদ্ধতাকে অস্বাভাবিক উল্লেখ করে বলেন, এ পরিস্থিতি আমাদের শিা দিচ্ছে। আমরা বুঝতে পারছি, কোন জায়গাতে আটকা পড়ছি। সে জায়গায় দ্রুত ব্যবস্থা নেবো। খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, জরিপ করে দেখা গেছে ঢাকার ৪৬টি খালের মধ্যে ১৮টির উন্নয়ন করতে হবে। এগুলো অবশ্যই করতে হবে। ওয়াসাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, ভারী বৃষ্টি হলেও যাতে তিন ঘণ্টার মধ্যে পানি নিষ্কাশন হয়।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/239190