প্রবল বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রতিটি সড়ক : নয়া দিগন্ত
২৭ জুলাই ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:২০

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রশাসন ব্যর্থ

চট্টগ্রাম মহানগরীতে জলাবদ্ধতা দিন দিন প্রকট রূপ নিলেও এর স্থায়ী সমাধানে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, প্রকৃতিকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে না দিলে স্বাভাবিকভাবেই সে বৈরী আচরণ করবে। চট্টগ্রাম মহানগরীর খালগুলো রায় প্রশাসনের ব্যর্থতার মাশুল গুনছে চট্টগ্রামের মানুষ। ফলে শুধু চলতি মাসেই পাঁচ দফায় থৈ থৈ পানির নিচে তলিয়েছে দেশের প্রধান এই বাণিজ্যনগরী।
জলাবদ্ধতায় শুধু বন্দরনগরীর বাসিন্দারা পানিবন্দী ছিল বিষয়টি এমনপর্যায়ে ছিল না। দেশের ভোগ্যপণ্যের প্রধান পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ-চাক্তাইয়ের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়ায় এক দিনে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার পণ্য নষ্ট হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে, যা সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিকে তিগ্রস্ত করেছে। খোদ চট্টগ্রাম সিটিমেয়র দুই দিন আগে এক সেমিনারে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছেন, জলাবদ্ধতার কারণে চট্টগ্রামের তির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। দিন দিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। নগরবাসী যেভাবে জলাবদ্ধতায় কষ্ট পাচ্ছে তা অবর্ণনীয়। তিনি বলেছেন, জলাবদ্ধতার কারণে শুধু চট্টগ্রাম নয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে তিগ্রস্ত হচ্ছে।
নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, চট্টগ্রাম মহানগরীর বিদ্যমান খালগুলোর বেশির ভাগই অবৈধ দখলে চলে গেছে। একসময় ৭০টি খাল থাকলেও বর্তমানে তা ৩৮টিতে নেমে এসেছে, তা-ও আবার অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ প্রশস্ততায়। জলাবদ্ধতা নিরসনের সাথে খালগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করা জরুরি হলেও এখন পর্যন্ত কার্যকর তেমন উদ্যোগ নেই। তা ছাড়া বিদ্যমান খালগুলোর প্রবেশমুখে স্লুইস গেট নির্মাণ পরিকল্পনার কথা সিটি করপোরেশনের প থেকে বলা হলেও তাতে তেমন ফল মিলবে না বলে নগর পরিকল্পনাবিদদের মত। তাদের মতেÑ কর্ণফুলী নদী ও খালের ড্রেজিং ও খননকাজ সম্পন্ন করে জোয়ারের পানি প্রবেশ বন্ধ করার জন্য শুধু স্লুইস গেট নির্মাণে সব সমস্যার সমাধান হবে না। এ ব্যাপারে জোয়ারের পানির প্রবেশ বন্ধ করার জন্য প্ল্যাফ গেট নির্মাণ করার সাথে সাথে বৃষ্টির সময় উজান থেকে নেমে আসা পানি নিষ্কাশনের জন্য ক্যাচম্যান এরিয়া হিসাব করে পানি নিষ্কাশন করার জন্য দেড়গুণ ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প বসানোর ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কোনো সময় মেকানিক্যাল সমস্যা দেখা দিলেও পানি নিষ্কাশনে যেন বিঘœ না ঘটে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. প্রকৌশলী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, জলাবদ্ধতা ও পাহাড়ধস রোধ করতে হলে ১৯৯৫ সালে প্রণীত মাস্টারপ্ল্যান রিভাইসড করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন না করলে নগরবাসীর দুর্ভোগ কমানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, পাহাড়ধসের ব্যাপারে বহির্বিশ্বে আমাদের ব্যাপারে যে বার্তা যাচ্ছে তা আমাদের ভাবমূর্তির জন্য অত্যন্ত খারাপ। এ জন্য পাহাড় রার জন্য কর্তৃপরে অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে এবং কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ ও সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি, আইইবি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী এম আলী আশরাফ নয়া দিগন্তকে বলেন, সমুদ্র, নদী ও পাহাড়বেষ্টিত এই চট্টগ্রাম পৃথিবীর অন্যতম বৈচিত্র্যময় শহর। আমরা আমাদের অব্যবস্থাপনা, অবহেলা ও লোভের কারণে এই সমস্যাটিকে জটিল করে তুলেছি। দীর্ঘ দিন থেকে অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কেটে, আমাদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থে ব্যবহার করার কারণে পাহাড় তার নিজের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে বৈরী আচরণ শুরু করেছে।
তিনি বলেন, ১৯৬৯ সালের জন স্নেল অ্যান্ড কোম্পানির জরিপে চট্টগ্রাম নগরে যে সত্তরটি খালের কথা উল্লেখ ছিল তার বেশির ভাগই দখল হয়ে গেছে। অনেক খালের চিহ্ন পর্যন্ত মুছে গেছে। আবার বিদ্যমান ৩৮টি খালের কোনো কোনোটির প্রশস্ততা ২ ফুটে নেমে এসেছে, যা থাকার কথা ছিল ৫০ ফুট। আরএস জরিপ অনুযায়ী খালের জায়গা খালকে ফেরত দিতে হবে।
১৯৯৫ সালের মহা পরিকল্পনায় চিহ্নিত খালগুলো উদ্ধার করে স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে এবং কর্ণফুলী নদী ও সংলগ্ন যেসব খাল বেদখল হয়ে স্থাপনা নির্মিত হয়েছে তা উচ্ছেদ করে পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ সৃষ্টি করতে হবে।
এই নগর পরিকল্পনাবিদের মতে, খালগুলো উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। ফলে পানি সরতে পারছে না বলেই সড়কের ওপর উঠে যাচ্ছে। তিনি বলেন, কর্ণফুলী নদী তো বলেনি যে, সে পানি নেবে না। পানি কর্ণফুলীতে যাওয়ার পথ স্বাভাবিক রাখলেই জলাবদ্ধতা থেকে পরিত্রাণ সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/239189