২৭ জুলাই ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৫৮

যান্ত্রিক স্বল্পতায় বন্দরজট

চট্টগ্রাম বন্দরে চাহিদার ৭০ ভাগই ঘাটতি : ১১২০ কোটি টাকার সরঞ্জাম সংগ্রহ ঝুলে আছে : অবশেষে আংশিক ক্রয়ের উদ্যোগ

‘কলের কাজ কলে চলে, বলে চলে না’। সেই কলের অপ্রতুলতার কারণে দক্ষতা ও সক্ষমতায় ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের শীর্ষকর্তাদের টনক নড়েছে অনেক বিলম্বে। যখন বন্দর কার্যক্রম ২৪ ঘণ্টা সচলের নির্দেশনা এসেছে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই। আর কন্টেইনার ও জাহাজের জটে স্থবির হয়ে আছে স্বাভাবিক বন্দর কার্যক্রম। রফতানি মুখ থুবড়ে পড়ায় শিল্পোদ্যোক্তারা ত্যক্ত-বিরক্ত হতাশ। অব্যাহত বন্দরজটের অন্যতম প্রধান কারণ যান্ত্রিক সরঞ্জামের স্বল্পতা। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে চাহিদার বিপরীতে বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম বা ভারী ইকুইপমেন্টের ঘাটতি রয়েছে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ। যাও চলছে তার অনেকগুলোই পুরনো জরাজীর্ণ। জোড়াতালি মেরামত দিয়ে কাজ চালু রাখা হচ্ছে। আমদানি-রফতানি বাণিজ্য ও রাজস্ব আহরণ গতিশীল করার লক্ষ্য সামনে রেখে দেশের প্রধান চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও কাস্টম হাউস সার্বক্ষণিক (২৪/৭) সচলের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার বাস্তবায়ন শুরু হতে যাচ্ছে আগামী ১ আগস্ট। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা।
এর পাশাপাশি কন্টেইনার ও খোলা সাধারণ (ব্রেক বাল্ক) পণ্যসামগ্রী উঠানামার উপযোগী অপরিহার্য যন্ত্রপাতির বিরাট ঘাটতির মধ্যেই তিন শিফটে ২৪ ঘণ্টা বন্দর কার্যক্রমের সচলতা কতদূর কার্যকর হবে, কাক্সিক্ষত ‘সেবা’ আদৌ মিলবে কিনা এবং গড় উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাওয়া নিয়ে পোর্ট শিপিং সার্কেলের অভিজ্ঞমহল সংশয় প্রকাশ করেছেন। ২৪ ঘণ্টা বন্দর-কাস্টমস সচলের তোড়জোড় প্রস্তুতিকে ঘিরে চলতি ও গতসপ্তাহে ঢাকায় এবং চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয় দফায় দফায় উচ্চপর্যায়ের বৈঠক আর সমন্বয় সভা। এতেও বন্দর ব্যবহারকারী এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, চিটগাং চেম্বার, শিপিং এজেন্টসহ স্টেকহোল্ডারগণ বন্দরে যান্ত্রিক স্বল্পতার পেছনে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের অদূরদর্শিতা, অবহেলা, সিদ্ধান্তহীনতা ও অনিয়মকে দায়ী করে তীব্র ক্ষোভ-অসন্তোষ ব্যক্ত করেন। তারা অনতিবিলম্বে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরে যান্ত্রিক সরঞ্জামের মারাত্মক সঙ্কট নিরসন করে বন্দরকে সত্যিকার অর্থে সচল, গতিশীল ও সেবাদাকারী প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করার আহŸান জানান। এমনকি ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ এসব বৈঠকে চট্টগ্রাম বন্দরের ইকুইপমেন্টস ও অবকাঠামোর ঘাটতির পরিণামে রফতানি আজ বাণিজ্যে চরম খেসারত দিতে হচ্ছে উল্লেখ করে এসব বিষয় আগামীতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করে তুলে ধরারও ইঙ্গিত দেন।
নিত্যদিনের কন্টেইনারজাত ও সাধারণ খোলা পণ্যসামগ্রী হ্যান্ডলিং কার্যক্রমের উপযোগী বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি বা ইকুইপমেন্টস সঙ্কটে নিপতিত চট্টগ্রাম বন্দর দীর্ঘদিন ধরেই। এরমধ্যে আমদানি-রফতানি কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে যান্ত্রিক সরঞ্জামের স্বল্পতা প্রকট। এরফলে পণ্য উঠানামা ব্যাহত হচ্ছে। বন্দরের স্বাভাবিক গতি ধীর হয়ে পড়েছে। বন্দরের সার্বিক গতি ও উৎপাদনশীলতায় পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। সর্ববৃহৎ কন্টেইনার স্থাপনা নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), সিসিটি, জেনারেল কার্গো বার্থে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সরঞ্জাম খুবই অপ্রতুল। বন্দরে গত এক যুগেও অনেক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হয়নি। বন্দরের এনসিটি, সিসিটি, জেসিবি মিলিয়ে রয়েছে ১৯টি জেটি-বার্থ। এ অবস্থায় মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ায় গত ২৫ জুন সিসিটিতে ভিড়ার সময় একটি বিদেশি জাহাজ ‘এমভি এক্সপ্রেস সুয়েজে’র বেপরোয়া আঘাতে সবচেয়ে দামী ও গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম দু’টি কী গ্যান্ট্রি ক্রেন বিধ্বস্ত হয়ে সিসিটির কাজকর্মে অনেকটা অচলাবস্থা নেমে আসে। বিদেশি প্রকৌশলীরা পরিদর্শনের পর এগুলোর মেরামত প্রক্রিয়া এখনও শুরুই হয়নি। এতে করে গিয়ারলেস (ক্রেনবিহীন) জাহাজের কন্টেইনার খালাস কাজে সঙ্কট তৈরি হয়েছে। আবার গিয়ারলেস জাহাজের আগমনও গত কয়েক মাসে বেড়ে গেছে।
প্রবৃদ্ধি অনুপাতে যান্ত্রিক স্বল্পতা
দেশের মোট আমদানি-রফতানি পণ্যপ্রবাহের ৯২ ভাগই চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। এর মধ্যদিয়ে কাস্টমস, কর ও অন্যান্য বিভাগ এবং বন্দরের রাজস্ব আয় আসছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। চট্টগ্রাম বন্দরে বিদায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট পণ্যসামগ্রী প্রায় ৮ কোটি মেট্রিক টন এবং ২৪ লাখ ১৮ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছে। জাহাজের গমনাগমন ২ হাজারেরও বেশি। গত এক দশেকের গড় হিসাব অনুযায়ী খোলা সাধারণ পণ্যখাতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ১৮ শতাংশ এবং কন্টেইনারে প্রবৃদ্ধি সাড়ে ১৪ শতাংশ। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর বিভিন্ন ধরনের ভারী, মাঝারি ও হালকা ধরনের ইকুইপমেন্ট সঙ্কটে ধুঁকছে প্রায় এক দশক যাবত। যান্ত্রিক সরঞ্জাম ব্যবহারের চাহিদার বিপরীতে শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ (স্থাপনাভেদে) পর্যন্ত ঘাটতি রয়ে গেছে। অর্থাৎ প্রধান বন্দরে যান্ত্রিক প্রাপ্যতার হার মাত্র ৩০ থেকে ৪০ ভাগ। কারিগরি হিসাবে এক-তৃতীয়াংশ সরঞ্জাম দিয়েই বন্দরে দায়সারা কাজ চলছে। যা যে কোন আদর্শ বন্দরের জন্য সুখকর নয়। এই সঙ্কট বা সীমাবদ্ধতার কারণে বন্দরের দক্ষতা ও সক্ষমতার উপর নেতিবাচক পড়ছে। সরঞ্জাম ঘাটতির কারণে বন্দর-ব্যয়ও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই বাড়তি ব্যয় আমদানিকারক, ব্যবসায়ীরা তাৎক্ষণিক গুণলেও পরবর্তীতে নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের মূল্য বাড়িয়ে তা দেশের ভোক্তা সাধারণের কাছ থেকে উসুল করা হয়। বন্দরে পণ্য হ্যান্ডলিং খরচের সাথে বাজারদরের সম্পর্ক নিবিড়।
চট্টগ্রাম বন্দরে ১১শ’ ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬১ ধরনের আধুনিক ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম সংগ্রহের জন্য ৬ বছর আগে যে পরিকল্পনা নেয়া হয় তা ঝুলে আছে। বছর বছর মুনাফালব্ধ বন্দরের নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থায়ন বাবদ এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। বন্দরে কী গ্যান্ট্রি ক্রেনের স্বল্পতাসহ কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের অধিকাংশ যন্ত্রপাতির সঙ্কট তীব্র। আর যান্ত্রিক ঘাটতির সুবাদে নেপথ্যে দুর্নীতিবাজ চক্রের ঘুষ বকশিশ স্পিডমানির ‘রেইট’ বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে পণ্যসামগ্রীর খালাস, জাহাজীকরণ, স্টেক-মজুদ করাসহ কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে ব্যাহত ও বিলম্বিত হচ্ছে। বন্দরের জন্য ৬১ ধরনের আধুনিক ভারী যন্ত্রপাতি সংগ্রহের পদক্ষেপ নিলেও সিদ্ধান্তহীনতা, পদ্ধতিগত অনিয়ম, সমন্বয়ের অভাবে বারবার তা থমকে যায়। ডাইরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড (ডিপিএম) নাকি অন্যকোন পদ্ধতিতে যন্ত্রপাতি কেনা হবে তা নিয়েই জটিলতার যেন শেষ নেই। যন্ত্রপাতি সংগ্রহ প্রকল্পে রয়েছে ১০টি কী গ্যান্ট্রি ক্রেন, রাবার টায়ারড গ্যান্ট্রি (আরটিজি) ক্রেন, স্ট্র্যাডল ক্যারিয়ার, রীচ স্ট্র্যাকার, কন্টেইনার মোভার, রেল মাউন্টেড গ্যান্ট্রি ক্রেন। যা কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ভারী যন্ত্রপাতি।
প্রধান বন্দরে যান্ত্রিক সরঞ্জামের তীব্র ঘাটতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে চিটাগাং চেম্বারের পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ, বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী ও শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহসানুল হক চৌধুরী বলেছেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই সঙ্কটের দ্রুত সুরাহার জন্য তাগিদ দিয়ে আসছি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা সময়মতো যদি পদক্ষেপ গ্রহণ করতো তাহলে আজকের মতো নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। অনতিবিলম্বে যান্ত্রিক সরঞ্জাম সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়ে বন্দরকে সার্বক্ষণিক গতিশীল করার আহ্বান জানিয়ে তারা বলেন, অন্যথায় শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যে আরও তীব্র আকারে সঙ্কট তৈরি হতে পারে। শিল্প ও ব্যবসায়-বিনিয়োগ গুটিয়ে নেয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
এদিকে বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরে গতিশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক সরঞ্জাম সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরমধ্যে শিগগিরই আনা হচ্ছে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা মূল্যের অন্তত ২৯টি যন্ত্রপাতি। পর্যায়ক্রমে আরও বিভিন্ন সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হবে। এ ব্যাপারে দরপত্র প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে। এসব যান্ত্রিক সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি ক্রেন, স্ট্র্যাডল ক্যারিয়ার, কন্টেইনার মুভার, লক হ্যান্ডলার, টেলি হ্যান্ডলার, আরএমজি। এছাড়া পরিকল্পনা অনুসারে ১১শ’ ২০ কোটি টাকায় ৬১ ধরনের আধুনিক যান্ত্রিক সরঞ্জাম ধাপে ধাপে সংগ্রহ করা হবে। আপাতত বেসরকারি সোর্স থেকে কিছু সরঞ্জাম জরুরিভিত্তিতে ভাড়ায় সংগ্রহেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সিসিটিতে কী গ্যান্ট্রি ক্রেন বিকল থাকায় কন্টেইনার খালাস কাজ গতিশীল করতে ক্রেনবিহীন জাহাজ বন্দরে না আনার জন্য শিপিং কোম্পানি, এজেন্টদের তাগিদ দেয়া হয়েছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/89203/