১৭ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ৭:৫৯

রেলে নিয়োগ নিয়ে আবারও দুর্নীতি

এইচএসসি পাস করার আগেই পাস, সুস্থ ব্যক্তিকে ‘প্রতিবন্ধী’ দেখিয়ে নিয়োগ * মৌখিক পরীক্ষায় অংশ না নেয়া প্রার্থীও চাকরি পেয়েছেন * প্রার্থীপ্রতি ৮-১০ লাখ টাকা লেনদেনের অভিযোগ

বাংলাদেশ রেলওয়েতে লোক নিয়োগে দুর্নীতি থামছেই না। পূর্বাঞ্চল রেলে নিয়োগে ভয়াবহ দুর্নীতির অভিযোগে জিএম ইউসুফ আলী মৃধা ও সাবেক রেলমন্ত্রীর পিএস ওমর ফারুক দেওয়ানসহ অর্ধডজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে বিচার চলছে। এরই মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলের জন্য বুকিং সহকারী, টাইম কিপার, গার্ড গ্রেড-২, ট্রেসার ও স্টোর মুন্সি- পাঁচ পদে লোক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ উঠল। এসব পদে এক বিজ্ঞপ্তিতে ৯১ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আরও বেশ কয়েকজনকে নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। অভিযোগ উঠেছে, শর্ত পূরণ করে না এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়ার পাশাপাশি এসব পদে নিয়োগের জন্য প্রার্থীপ্রতি ৮-১০ লাখ টাকাও লেনদেন হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের জিএম খায়রুল আলম যুগান্তরকে বলেন, নিয়োগে অভিযোগ নিয়ে তদন্ত হচ্ছে।
সূত্র জানায়, এইচএসসি পাস করার আগেই পাস দেখিয়ে, প্রতিবন্ধী নন, এমন প্রার্থীকে প্রতিবন্ধী কোটায়, মৌখিক পরীক্ষায় অংশ না নেয়া প্রার্থীকে পাস দেখিয়েসহ নানাভাবে এসব নিয়োগ দেয়া হয়। তা করা হয় রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের জিএমের অনুমোদনক্রমেই।
এর আগে ২০১২ ও ২০১৬ সালে বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ২০১২ সালে পূর্বাঞ্চলে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পদে লোক নিয়োগে দুর্নীতি হয়। অভিযোগ উঠায় স্থগিত রাখা হয় ১ হাজার ৮০০ জনের নিয়োগ। ওই সময় রেলওয়ের ৪১ ক্যাটাগরির সব ক’টি পদেই অনিয়ম হয়। নিয়োগে দুর্নীতির সত্যতা মেলে দুদক ও রেলওয়ের একজন যুগ্ম মহাপরিচালকের দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনেও। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রেলওয়ে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের জন্য ৮০০ খালাসি নিয়োগেও একই অভিযোগ উঠে। ওই নিয়োগে রেলওয়ের শ্রমিক লীগের একটি সিন্ডিকেট চাকরি দেয়ার নামে জেলায় জেলায় প্রার্থীদের কাছ থেকে ৬-৭ লাখ টাকা করে তোলে। রেলওয়েতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরই সক্রিয় হয়ে উঠে সিন্ডিকেট।
পশ্চিমাঞ্চলের জন্য বুকিং সহকারী, টাইম কিপার, গার্ড গ্রেড-২, ট্রেসার ও স্টোর মুন্সি পদে লোক নিয়োগের জন্য গত বছরের ২ জুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় রেলওয়ে। এর মধ্যে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে চলতি বছরের ২০ এপ্রিল গার্ড গ্রেড-২ পদে ৪১ জন, বুকিং সহকারী পদে ২২ জন, স্টোর মুন্সি পদে ৮ জন, টাইম কিপার পদে ১৩ জন ও ট্রেসার পদে ১৭ জনসহ ৯১ জনকে নিয়োগ দেয়ার সুপারিশ করা হয়। এসব নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. জাকির হোসেনকে অভিযোগ অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয়।
অনুসন্ধান কাজটি তদারকি করছেন দুদকের পরিচালক জায়েদ হোসেন খান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, রেলওয়ের দুর্নীতি পিছু ছাড়ছে না। ইউসুফ আলী মৃধার দুর্নীতির বিচার হতে না হতেই আরেকটি নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ সামনে এসেছে। আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছি। নিয়োগ সিন্ডিকেটের সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক না কেন, অনুসন্ধানের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি আরও জানান, রেলওয়ের দুর্নীতি নিয়ে দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক টিমও কাজ করছে। দুদক টিমের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, নিয়োগ সিন্ডিকেটের সঙ্গে যারা জড়িত বা দুদকে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, তাদের প্রত্যেকের নামে নোটিশ ইস্যু করা হবে। নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগের বক্তব্য নেয়ার পাশাপাশি তাদের সম্পদের হিসাব চেয়েও নোটিশ করা হবে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, লোক নিয়োগে দুর্নীতির অনুসন্ধানে দুদকের সহকারী পরিচালক মো. জাকির হোসেন ২৯ জুন রেলওয়ের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি দিয়ে বেশ কিছু তথ্য চেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে- পাঁচটি পদে নিয়োগ বিধিমালা, জেলা কোটার তথ্য, প্রতিটি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, নিয়োগ কমিটির তালিকা, লিখিত পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিদর্শকদের তালিকা, প্রতিটি পদে চূড়ান্তভাবে নিয়োগের তালিকা, প্রার্থীদের আবেদনপত্র, লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন এবং লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফল শিট, উত্তরপত্র, নিয়োগপ্রাপ্ত সবার কর্মস্থল ও তাদের ব্যক্তিগত নথি।
নিয়োগে দুর্নীতির কিছু ঘটনা : ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার পাতরাইল দীঘিরপাড় গ্রামের মো. সিরাজুল ইসলামের ছেলে রাতুল ইসলাম সবুজ নিয়োগ পেয়েছেন রেলওয়ের টাইম কিপার পদে। যোগ দিয়েছেন যশোরে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বলা ছিল, এ পদের জন্য ন্যূনতম এইচএসসি পাস হতে হবে। আরও বলা ছিল, আবেদনপত্রে কাটাছেঁড়া বা ঘষামাঝা থাকতে পারবে না। রাতুলের দুটিই ছিল সমস্যা। তার আবেদনপত্রে উপজেলার স্থলে ঘষামাঝা ছিল। টাইম কিপার পদে আবেদনের সর্বশেষ তারিখ ছিল ২০১৬ সালের ১১ জুলাই। রাতুল এইচএসসি পাস করে ওই বছর ১৯ আগস্ট। অথচ পাস করার আগেই নিজেকে এইচএসসি পাস দেখিয়ে আবেদন করে। তার লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা হয় গত বছরের ৯ ডিসেম্বর। আর তাকে নিয়োগ দেয়া হয় চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি। অনুসন্ধানে জানা যায়, রাতুলের এক আত্মীয় আবু জাফর মিয়া রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ট্র্যাক)। তারও প্রভাব ছিল রাতুলকে এভাবে নিয়োগের ক্ষেত্রে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমি জানি, রাতুল নিয়োগ পেয়েছে। কিন্তু আমি তার আত্মীয় নই।
রাজশাহীর পুটিয়া উপজেলার জোতভাগিরতপুর গ্রামের সাঈদ আলীর ছেলে তানভীর আহমেদ সজীব প্রতিবন্ধী না হয়েও শ্রবণপ্রতিবন্ধী হিসেবে নিয়োগ পান। এ পদের জন্য লিখিত পরীক্ষা হয় ৩০ সেপ্টেম্বর আর মৌখিক পরীক্ষা ৭ নভেম্বর। তাকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয় চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি। তার আবেদনের সঙ্গে শ্রবণপ্রতিবন্ধী হিসেবে কোনো সনদ দাখিল না করলেও নিয়োগের পর চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি সমাজসেবা অধিদফতর থেকে তার পক্ষে একটি সনদ দেয়া হয়। তানভীর আহমেদ সজীব আদৌ প্রতিবন্ধী কিনা, জানতে যোগাযোগ করা হয় তানভীরের মা সেলিনা পরভীনের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমার ছেলের হাতে একটু ব্যথা আছে। এছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই। প্রতিবেশীরা জানান, তারা তানভীরের কোনো সমস্যা দেখেননি। রাজশাহী কলেজে পড়াশোনা করে তিনি সরকারি চাকরি নেন। তানভীর বর্তমানে পাকশী রেলওয়েতে টেক্স-আর পদে কর্মরত আছেন।
গার্ড গ্রেড-২ পদে নিয়োগ পাওয়াদের একজন আশরাফুল করিম। তার বাবা এসএম আক্তার হোসেন রেলওয়ের পশ্চিম জোনের (রাজশাহী) জিপিও-১ হিসেবে কর্মরত। তিনি প্রভাব খাটিয়ে ছেলেকে রেলে চাকরি দেন। মৌখিক পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও আশরাফুলকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। দুদকের নথিতে নিয়োগ সিন্ডিকেটের যে তালিকা রয়েছে তাতে এসএম আক্তার হোসেনের নামও রয়েছে। একইভাবে নিয়োগ পাওয়া আরেক জনের নাম তানভীর হায়দার জনি। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার ইকবারদী গ্রামের আবদুল করিম ভূঁইয়ার ছেলে জনিও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে নিয়োগ পেয়েছেন।
অভিযোগের বিষয়ে নিয়োগ কমিটির প্রধান রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের (রাজশাহী) জিএম খায়রুল আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, নিয়োগে দুর্নীতি হয়ে থাকলে তদন্ত হবে। অনিয়মের মাধ্যমে কেউ চাকরি নিয়ে থাকলে তিনি বাদ পড়বেন। তিনি আরও বলেন, পশ্চিমাঞ্চলে লোক নিয়োগের জন্য একটি কমিটি আছে। এর বাইরে আছে বাছাই কমিটি। এসব কমিটি আবেদনকারীদের বিষয়ে যাচাই-বাছাই করে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে। নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় দুদক তদন্ত করছে বলে তিনি জানান। তবে সিন্ডিকেট করে দুর্নীতির মাধ্যমে লোক নিয়োগের অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন। খায়রুল আলম জানান, রেলওয়েতে ৪০ হাজার পদ থাকলেও বর্তমানে আছেন ২৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। শূন্যপদে পর্যায়ক্রমে লোক নিয়োগ দেয়া হবে।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/07/17/140276/