২৬ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১১:৫৬

৩৭ দিনেও বেক্সিমকোর বিরুদ্ধে মামলা করেনি সোনালী ব্যাংক

ব্যাংক এমডির অসহায়ত্ব প্রকাশ- প্রভাবশালীদের সঙ্গে অনেক সময় আমরা পারি না

বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান জিএমজি এয়ারলাইন্সের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ৩৭ দিনেও মামলা করেনি সোনালী ব্যাংক। সম্প্রতি ব্যাংকের বোর্ডসভায় জিএমজির বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে খেলাপি ঋণের ২৬৬ কোটি টাকা আদায়ে এখনও মামলা করতে পারেনি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। বরং এ সুযোগে ১৩ জুলাই উল্টো রিট করেছেন এই গ্রুপের কর্ণধার এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবিতে (ক্রেডিট ইনফর্মেশন ব্যুরো) তাকে যেন খেলাপি হিসেবে দেখানো না হয় সে জন্য তিনি উচ্চ আদালতে রিট করেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বোর্ডসভায় সিদ্ধান্ত হওয়ার পর অর্থঋণ আদালতে একটি মামলা করতে বড়জোর ১৫-২০ দিন লাগতে পারে। কিন্তু সেখানে এক মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও তারা মামলা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের মতে, সোনালী ব্যাংক মামলা দায়ের প্রক্রিয়া বিলম্বিত করে প্রকারান্তরে বিষয়টি নিয়ে সালমান এফ রহমানকে রিট করার সুযোগ করে দিয়েছে।
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রভাবে ব্যাংকগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। এ ছাড়া রিট মোকাবেলায় প্রত্যেক ব্যাংককে উচ্চপর্যায়ের আইনজ্ঞ নিয়োগ দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘ইতিমধ্যে জিএমজির পক্ষ থেকে রিট করায় কিছু করতে পারছি না। এ ছাড়া প্রভাবশালীদের সঙ্গে অনেক সময় আমরা পারি না।’
সূত্র জানায়, গত ৫ জুন সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৫২৩তম বোর্ডসভায় জিএমজির বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্তের বিষয়টি ইতিমধ্যে জিএমজিকে জানানো হয়েছে। এর আগে ২৯ মার্চ সব সুদ মওকুফ চেয়ে ঋণটি পুনঃতফসিলের জন্য চিঠি দেয় জিএমজি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তা বোর্ডসভায় গৃহীত হয়নি। বোর্ডের বেশিরভাগ সদস্য শক্ত অবস্থান নিয়ে সাফ জানিয়ে দেন, টাকা আদায়ে বেক্সিমকোকে আর ছাড় নয়। মামলা করতে হবে।
এদিকে এ বিষয়ে সালমান এফ রহমানের বক্তব্য নেয়ার জন্য তার মুঠোফোনে সোমবার রাতে যোগাযোগ করা হলে জানান, তিনি মিটিংয়ে আছেন। পরে কথা বলবেন।
এরপর যুগান্তরের পক্ষ থেকে কি বিষয়ে কথা বলতে চায়, জানতে চেয়ে বেক্সিমকো গ্রুপের মিডিয়া পার্টনার ইমপ্যাক্ট পিআরের পক্ষ থেকে প্রতিবেদককে ফোন করা হয়। বিষয়টি অবহিত করার পর তিনি জানান, মঙ্গলবার তাদের বক্তব্য দেয়া হবে। কিন্তু মঙ্গলবার তিন দফায় ফোন করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, আওয়ামীপন্থী ব্যবসায়ী বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান বর্তমানে আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি মামলার অন্যতম আসামি। এ ছাড়া এই জিএমজি কোম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে তিনি ৩শ’ কোটি টাকা নিয়ে আটকে রেখেছেন। অথচ বিনিয়োগকারীদের টাকা পরিশোধ করছেন না।
সূত্র জানায়, ১৯৯৮ সালে জিএমজি এয়ারলাইন্স সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় শাখায় ঋণের জন্য আবেদন করে। এ জন্য ধানমণ্ডির ২ নম্বর সড়কের ১৭ নম্বর প্লটে (নতুন) ১ বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমি ও তার উপরের ভবনসহ সব স্থাপনা ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা হয়। এ জমির মালিক বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সোহেল এফ রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান। ওই বছরেই জিএমজিকে সাড়ে ৪ কোটি টাকা ওভার ড্রাফট ঋণ সুবিধা প্রদান করে সোনালী ব্যাংক। পরে ধীরে ধীরে সুদসহ ঋণ দাঁড়ায় ২৬৬ কোটি ১০ লাখ টাকা।
২০১২ সালে জিএমজির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে ওই ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ে। এ সময় ঋণটি পুনঃতফসিল করে সোনালী ব্যাংক। এরপর আবারও খেলাপি হয়ে পড়লে ব্যাংকটি ঋণ পরিশোধের জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে চেষ্টা চালায়। এ জন্য কয়েক দফায় চিঠি, উকিল নোটিশ, আলোচনা সবই করা হয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে। অবশেষে অর্থ আদায়ে অর্থঋণ আদালত আইন-২০১৩-এর আশ্রয় নেয় ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে আইনের ১২(৩) ধারা অনুযায়ী বন্ধকী জমি নিলামে তুলতে গত বছরের ১২ জুলাই নিলাম দরপত্র বিজ্ঞপ্তি দেয় সোনালী ব্যাংক। বর্তমানে ওই জমিতে বেক্সিমকো গ্রুপের কার্যালয় এবং তাদের ফ্যাশন ব্র্যান্ড ইয়োলোর শোরুম রয়েছে।
তবে শেষ মুহূর্তে জিএমজি রিট করলে নিলাম স্থগিত হয়। পরে আইনি প্রক্রিয়ার ওই রিটটি তাদের পক্ষে নিষ্পত্তি (ভ্যাকেট) করে সোনালী ব্যাংক। এরপরই ঋণটি পুনঃতফসিলের চেষ্টা শুরু করে জিএমজি।
অর্থঋণ আদালত আইন-২০১৩-এর ১২(৩) ধারা অনুযায়ী কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিবাদীর কাছ থেকে কোনো স্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে, অস্থাবর সম্পত্তি দায়বদ্ধ রেখে ঋণ প্রদান করলে এবং বন্ধক প্রদান বা দায়বদ্ধ রাখার সময় সম্পত্তি বিক্রির ক্ষমতা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করলে তা বিক্রি না করে, বিক্রির চেষ্টা করে ব্যর্থ না হয়ে, সমন্বয় না করে অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করা যাবে না।
ব্যাংকের নথিতে জিএমজির চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, পিতা-ফজলুর রহমান, মাতা-সৈয়দা ফাতিনা রহমান। ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাহাব সাত্তার, পিতা-আজিজ এইচ এ সাত্তার, মাতা-ভাজিহা আজিজ সাত্তার। পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরী, পিতা- সাবের আহমেদ চৌধুরী, মাতা-হোসনে আরা বেগম।
জিএমজি ছিল ২০১০ সালে শেয়ারবাজার ধসের আগে অন্যতম আলোচিত একটি কোম্পানি। দীর্ঘদিনের লোকসানি এ কোম্পানিকে কারসাজির মাধ্যমে লাভজনক দেখিয়ে প্রথমে প্লেসমেন্টে শেয়ার বিক্রি করা হয়। এরপর প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে শেয়ারবাজার ধসের পর সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও জিএমজির কারসাজির বিষয়টি উঠে আসে। কমিটির প্রতিবেদনে সালমান এফ রহমানের বিষয়ে সতর্ক থাকতেও বলা হয়েছিল। ১৯৯৬-এর শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতেও তার নাম রয়েছে।

 

http://www.jugantor.com/first-page/2017/07/26/142964/