২৫ জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:০৮

ডুবল চট্টগ্রাম রাস্তায় নৌকা

পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ চরমে : টানা বৃষ্টি পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারে জীবনযাত্রা অচল : ডুবেছে হাজারো বসতঘর গুদাম দোকান-পাট : পাহাড়ধস আতঙ্ক বন্দরে সঙ্কেত : ২৩২ মিমি বর্ষণ

শফিউল আলম : বন্দরনগরী চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকার এক্সেস রোড। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর এই ব্যস্ত শহরের এক্সেস রোডে নিত্যদিন বাস-ট্রাস-রিক্সা চলাচল করতে দেখা যায়। প্রবল বর্ষণের পর এ রোড যে হয়ে গেছে নদী। বাস-রিক্সা চলাচল অসম্ভব। তবে এ রোডে চলাচল করতে দেখা যায় নৌকা। শ্রাবণের ঘনঘোর বর্ষণে এখন প্রায়ই চট্টগ্রাম শহরের রাস্তায় নৌকা চলাচলের দৃশ্য চোখে পড়ে। গতকালও যেন আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়েছিল দেশের বাণিজ্যির রাজধানী হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম শহর। বৃষ্টি হলেই শহরের বেশির ভাগ এলাকা হয়ে যায় নদী।
প্রবল বৃষ্টির সঙ্গে প্রবল সামুদ্রিক জোয়ার, পাহাড়-টিলার ঢলে চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। টানা বৈরী আবহাওয়ায় সর্বত্র জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। গতকালও (সোমবার) টানা অতিবৃষ্টি, ঢল ও জোয়ারে জীবনযাত্রায় নেমে আসে অচলদশা। নগরীর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে কাদা-পানিতে ডুবে আছে হাজার হাজার বসতঘর, গুদাম আড়ত, দোকান-পাট, শিল্প-কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সড়ক রাস্তা-ঘাট জনপদ। প্রতিকূল আবহাওয়ায় প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রামের স্বাভাবিক কার্যক্রম এবং ব্যবসা-বাণিজ্য থমকে গেছে। আমদানিকৃত নিত্য ও ভোগ্যপণ্যে দেশের প্রধান পাইকারি ও ইন্ডেন্টিং বাজার ‘সওদাগরী পাড়া’ চাক্তাই খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ, রাজাখালী এলাকা গত দু’দিন ধরে কোমর থেকে বুকসমান পানিতে ভাসছে। এ যাবত শতাধিক কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে জানিয়ে পানিবদ্ধতার সঙ্কট সমাধানে কর্তৃপক্ষের অবহেলায় ব্যবসায়ীমহল তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। আগ্রবাদ হালিশহরের পানিবদ্ধতায় লাখো মানুষের কষ্ট-দুর্ভোগ অবর্ণনীয়। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ২শ’ ৩২ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। অব্যাহত অতি বর্ষণ ও ঢলের কারণে নগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড় ধসের সতর্কতা বলবৎ রেখেছে আবহাওয়া দপ্তর ও প্রশাসন। সেই সাথে পাহাড়-টিলাময় এলাকাগুলোতে পাহাড়ধস আতঙ্ক বিরাজ করছে। মৌসুমি বায়ু জোরালো থাকায় বাংলাদেশ সংলগ্ন উত্তর বঙ্গোপসাগরে বায়ুচাপে তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করছে। সাগর উত্তাল রয়েছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরে ৩নং সতর্ক সঙ্কেত বহাল রাখা হয়েছে। আবহাওয়া বিভাগ আজও (মঙ্গলবার) চট্টগ্রাম বিভাগসহ দেশের অনেক জায়গায় মাঝারি থেকে ভারী কোথাও অতিভারী বর্ষণের পূর্বাভাস দিয়েছে।
বর্ষারোহী মৌসুমি বায়ু আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অতিবর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম জেলার অনেক জায়গায় পাহাড়ি ঢল বইছে। উত্তর-পূর্ব ভারতে উজানভাগ আসামের লুসাই পাহাড় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভারী বৃষ্টিতে বৃদ্ধি পেয়েছে খর স্রোতা কর্ণফুলী নদীর পানি। কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উপর পানির চাপ কমাতে বাঁধের অধিকাংশ স্পিলওয়ে দিয়ে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এতে করে ভাটিতে বেড়েছে পানির তীব্র চাপ। চট্টগ্রামে কর্ণফুলীতে গত ৩০ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ৩৪৯ সেন্টিমিটার। সর্বশেষ গতকাল বিকেল পর্যন্ত কর্ণফুলী বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। মোহনায় প্রবল ঘূর্ণি স্রোতের কারণে নৌযান চলাচল ব্যাহত ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এছাড়া দক্ষিণ চট্টগ্রামের শংখ (দোহাজারী পয়েন্টে বিপদসীমার মাত্র ১৫ সেমি নিচে) এবং মাতমুহুরী নদী সকাল পর্যন্ত বিপদসীমার ৪১ সেমি উপরে গিয়ে বিকেলে মাত্র ১২ সেমি নিচে নেমেছে চিরিঙ্গা পয়েন্টে। এছাড়া দেশের দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য অববাহিকায় বিভিন্ন নদ-নদী, খালের পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এদিকে টানা ভারী বর্ষণের সাথে গতকাল সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে সামুদ্রিক জোয়ারের পালা শুরু হলে আগের দিনের পানি না নামতেই দ্বিতীয় দিনের মতো বিভিন্ন এলাকা ডুবে যায়। কর্ণফুলী নদীর মোহনা ফুঁসে থাকায় পানি নামতে পারছে না। বরং অমাবস্যার বর্ধিত প্রভাবে উল্টো জোয়ারের পানির চাপ বেড়ে গেছে। সন্ধ্যা অবধি নগরীজুড়ে মারাত্মক পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। জনদুর্ভোগ পৌঁছে চরম পর্যায়ে। অতি বর্ষণের নগরীর পাহাড়-টিলা বেয়ে ঢল নামছে প্রবলবেগে। ফের রাতের জোয়ারের সময় বন্দরনগরী ও আশপাশের বিশেষত উপকূলবর্তী এলাকাগুলো ডুবে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অতিবৃষ্টির সাথে জোয়ারে হাঁটু থেকে কোমর সমান, কোথাও একবুক পানিতে ডুবে থাকে নগরীর দক্ষিণ ও পশ্চিমে আগ্রাবাদ, হালিশহর, পতেঙ্গা সাগরিকা থেকে শুরু করে পূর্বে বাকলিয়া, চাক্তাই খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, রাজাখালী, মিয়াখান নগর, বহদ্দারহাট, কাপ্তাই রাস্তার মোড়, মোহরা, চান্দগাঁও, মুরাদপুর, শোলকবহর, ষোলশহর, নাসিরাবাদ, বায়েজিদ, প্রবর্তক, পাঁচলাইশ, চকবাজার, কাতালগঞ্জ, অক্সিজেনসহ অধিকাংশ এলাকা। কোথাও কোথাও বুক সমান পানিতে তলিয়ে গেছে। আবার কোথাও বাড়িঘর সড়ক অলিগলি পাহাড়ধোয়া বালি-মাটিতে সয়লাব দেখা গেছে। এ অবস্থায় অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, হাট-বাজার, মসজিদ ডুবে গেলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে। ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে পড়েছে শহরময়। এসব জায়গায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে।
খানাখন্দে ভরা রাস্তাঘাট সড়কগুলো কাদা-পানিতে প্লাবিত হওয়ায় যানবাহন চলছে খুবই কম। এতে করে কর্মমুখী অগণিত মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। বৈরী আবহাওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর ও বহির্নোঙরে জাহাজের আমদানি-রফতানিমুখী পণ্যসামগ্রী ওঠানামা, ডেলিভারি পরিবহন কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে। বেসরকারি আইসিডিগুলোতে কাজকর্ম স্থবির। এতে আরও বেড়ে যাচ্ছে বন্দরজট। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া জেঁকে বসার কারণে দিনে এনে দিনে খাওয়া গরীব দিনমজুর, হকারদের আয়- রোজগারের পথ প্রায় রুদ্ধ হয়ে গেছে। অতিবর্ষণে জেলার মীরসরাই, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, সীতাকুন্ড, সাতকানিয়া, বাঁশখালীসহ বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ি ঢল বয়ে যাচ্ছে। উপকূলীয় উপজেলাগুলোর বিভিন্ন এলাকা অতিবৃষ্টির সাথে জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে। ফল-ফসল, ক্ষেত-খামারের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে ব্যাপক। ভেসে গেছে অনেক মৎস্য খামার। বৃহত্তর চট্টগ্রামে অতিবৃষ্টির মধ্যে পাহাড় ধসের তীব্র ঝুঁকিতে রয়েছে লাখ লাখ মানুষ। আবহাওয়া বিভাগ জানায়, আগামী ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম বিভাগসগ দেশের অনেক জায়গায় মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ, কোথাও অতি ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকতে পারে। এদিকে খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন জানায়, গত দু’দিনের অবিরাম বর্ষণের সাথে জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়ে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ, রাজাখালীর অন্তত দুই হাজার পাইকারি দোকান ও গুদামে কয়েকশ’ কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের ভোগ্য ও খাদ্যপণ্য বিনষ্ট হয়ে গেছে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়েও ডুবে যায়নি এমন অধিকাংশ দোকান ও গুদাম ডুবে গেছে। মালামাল সরানোরও কোন উপায় ছিল না। অ্যাসোসিয়েশন নেতৃবৃন্দ বলছেন, চাক্তাই খালের তলদেশ সংস্কার ও পাকা করার নামে খালকে সঙ্কুচিত করে ফেলা হয়েছে। খালের পানি ধারণ ও নিষ্কাশন ক্ষমতা হারিয়ে গেছে। তাই জোয়ারের পানিতে ডুবে যাচ্ছে শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়িক এলাকাটি। এর পরিকল্পিত সমাধানের জন্য ব্যবসায়ীমহলের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার ৭ দফা দাবি ও সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছিল আগেই। কিন্তু তা উপেক্ষা করার কারণেই আজ খাতুনগঞ্জসহ বিশাল এলাকায় আজ ব্যবসা-বাণিজ্য পরিত্যক্ত হওয়ার উপক্রম বলে তারা তীব্র ক্ষোভ-অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/88975/