২৫ জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:০৪

২২ বার সময় নিলো রাষ্ট্রপক্ষ

নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির বিধিমালা গেজেট

নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালা গেজেট নিয়ে ২২ বার সময় নিলেন রাষ্ট্রপক্ষ। প্রতিবারই রাষ্ট্রপক্ষ গেজেট প্রকাশের প্রস্তুতির জন্য আর দুই সপ্তাহ সময়ের প্রয়োজন বলে উচ্চ আদালতে (সুপ্রিম কোর্ট) আবেদন করেন। আদালতও এবারই শেষ সুযোগ বলে আবেদন মঞ্জুর করেন। এ্ইভাবে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও রাষ্ট্রপক্ষের সময় আবেদন মেষ হয়নি। ইতোমধ্যে গেজেট প্রকাশের বিলম্ব কারণ জানাতে আইন মন্ত্রনালয়ের দুজন সচিবও উচ্চ আদালতে হাজির হন। তবেও গেজেট প্রকাশ করতে পারেনি সরকার। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ও আইনমন্ত্রীও দুইবার বৈঠকেও বসেন। এসময় আইনমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, চলতি সপ্তাহের গেজেট প্রকাশ করার আশা প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে গত রোববার সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসেই অ্যাটর্নী জেনারেল ফের দুই সপ্তাহের সময় আবেদন করেন। এবার নিয়ে অন্তত ২২ বার সময় আবেদন করেলেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, নির্বাহী বিভাগ নিন্ম আদালতকে নিয়স্ত্রণ করতেই গেজেট প্রকাশে বার বার সময় আবেদন। তাদের মতে, বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে নিয়ন্ত্রণ মুক্ত দ্রুত সময়ে মধ্যে বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালা গেজেট প্রকাশ দাবি জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন ইনকিলাবকে বলেন, সরকার স্বাধীন বিচার বিভাগ বিশ্বাস করে না। যার কারণে সরকার আইন মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে নিন্ম আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করেন। ইচ্ছাকৃতভাবে নিন্ম আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালা গেজেট প্রকাশ করে না। তিনি আরো বলেন,গেজেট প্রকাশ করে নিন্ম আদালতকে সরকার নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করতে চান না। যার ফলে বার বার সময় আবেদন করেন রাষ্ট্রপক্ষ। যারা গণতন্ত্র বিশ্বাস করে তারা সবাই বিচার বিভাগের তথা নিন্ম আদালতের গেজেট চায়। আমরা আইনজীবী সব সময় এ দাবি জানিয়ে আসছি। তিনি আরো বলেন, নিবার্চনের আগে বিরোধী জোটের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আইনগতভাবে কিভাবে হয়রানি করতে আপ্রাণ চেস্টা করছে এবং নিন্ম আদালতের গেজেট প্রকাশ করছে না।
গত ২ জুলাই সরকারকে দুই সপ্তাহ সময় দিয়ে আপিল বিভাগ বলেছিল, এটাই শেষ সুযোগ। কিন্তু গতকাল রোববার পূন নিধার্রিত বিষয়টি শুনানি জন্য প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বধীন ছয় সদস্যের আপিল বেঞ্চে আসে। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম ফের দুই সপ্তাহ সময় চান। আপিল বেঞ্চ এক সপ্তাহের সময় দেন। গেজেট প্রকাশে আপিল বিভাগ থেকে দফায় দফায় সময় নিচ্ছে সরকার। গত ৪ জুলাই নিন্ম আদালতের গেজেট আকারে জারি করতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি। সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন। জয়নুল আবেদীন বলেন, সরকার এখনো আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিন্ম আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের ইচ্ছা নিন্ম আদালতের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করছে। এ অবস্থায় অবিলম্বে নিন্ম গেজেট প্রকাশের জোড় দাবি জানাচ্ছি।
গত ২ জুলাই এক অনুষ্ঠান শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আশা প্রকাশ করেছিলেন, ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে এই গেজেট চূড়ান্ত হবে। এরপর আইনমন্ত্রী গত ১৬ জুলাই এবং ১৯ জুল্ইা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দুদফায় বৈঠক করেন। বৈঠকের পর আইনমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, বৃহস্পতিবারের মধ্যে চূড়ান্ত হবে। তিনি বলেন, আগামী ১৯ জুলাই বসে গেজেট তৈরি খসড়া প্রস্তুত করব। এর পর আগামী সপ্তাহের প্রথম দিকে প্রেসিডেন্টর এর কাছে উপস্থাপনা করার আশা প্রকাশ করছি। এরপর গত বৃস্পতিবার বিকেলেও প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ফের বৈঠক বসেন আইনমন্ত্রী। পরে তিনি বলেন, গেজেট আকারে প্রকাশের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে সরকার। আগামী সপ্তাহেই (চলতি সপ্তাহে) তা হতে পারে। এইসব ব্যাপার নিয়ে একটু খুঁটিনাটি বুঝার প্রয়োজন ছিল এবং যেসব ব্যাপার নিয়ে দ্বিমত ছিল সেগুলো অনেকাংশে দূর হয়েছে। কিন্তু সপ্তাহের প্রথম কার্যর্দিবস রোববারও ফের সময়ের আবেদনের করেন রাষ্ট্রপক্ষ। পরে আপিল বিভাগ এক সপ্তাহ সময় দেন। এ পর্যন্ত ২২ বার সময় নিলেন সরকার। আদালত শেষ সুযোগ উল্লেখ করে সময় দেয়ার পরও রাষ্ট্রপক্ষ দফায় দফায় সময় নেয়। বার বার সময়ে আবেদনের বিরুক্তবোধ করেছেন সর্বোচ্চ আদালত।
১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করতে ঐতিহাসিক এক রায় দেন। ওই রায়ে আপিল বিভাগ বিসিএস ক্যাডারকে সংবিধান পরিপন্থি ও বাতিল ঘোষণা করে। একইসঙ্গে জুডিশিয়াল সার্ভিসকে স্বতন্ত্র সার্ভিস ঘোষণা করা হয়। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার জন্য সরকারকে ১২ দফা নির্দেশনা দেন সর্বোচ্চ আদালত। রায়ের পর ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। আপিল বিভাগের নির্দেশনার পর গত বছরের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় নিন্ম আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালার একটি খসড়া প্রস্তুত করে সুপ্রিম কোর্টে পাঠায়। সরকারের খসড়াটি ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী বিধিমালার অনুরূপ হওয়ায় তা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থি বলে গত ২৮ আগাস্ট শুনানিতে জানায় আপিল বিভাগ। এরপর ওই খসড়া সংশোধন করে সুপ্রিম কোর্ট আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। একই সঙ্গে তা চূড়ান্ত করে প্রতিবেদন আকারে আদালতে উপস্থাপন করতে বলা হয় আইন মন্ত্রণালয়কে।
এরপর দফায় দফায় সময় দেয়া হলেও সরকার গেজেট আকারে প্রকাশ না করায় গত ৮ ডিসেম্বর দুই সচিবকে তলব করে আপিল বিভাগ। দুই সচিবের হাজিরার আগে ১১ ডিসেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে একটি নোটিসে বলা হয়, নি¤œ আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ সংক্রান্ত বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে প্রেসিডেন্ট সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হক পরদিন আদালতের তলবে হাজির হলে আপিল বিভাগ বলেন, বিধিমালা নিয়ে প্রসিডেন্টকে ভুল বোঝানো হয়েছে। সেদিন শুনানি করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলক ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেয় আপিল বিভাগ।

https://www.dailyinqilab.com/article/88972/