২৫ জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:০২

টানা বর্ষণে আবারও পাহাড়ধসের আশঙ্কা

ঝুঁকিপূর্ণদের আশ্রয়কেন্দ্রে সরানো হচ্ছে

সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরে পাহাড়ধসে একই পরিবারের পাঁচজন নিহত হওয়ার রেশ কাটতে না কাটতেই আবারও বসতঘরের ওপর পাহাড় ধসে পড়েছে। এদিকে গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য জেলাগুলোতে পাহাড়ধসের আশঙ্কায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিংসহ বিভিন্ন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীদের অনেককেই আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। অনেকে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো বিস্তারিত খবর :
সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ১১টা দিকে জঙ্গল সলিমপুরের ৭ নং সমাজ এলাকায় একটি বসতঘরের ওপর পাহাড় ধসে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে ঘরটি গুঁড়িয়ে গেলেও বাসিন্দারা নিরাপদ স্থানে সরে থাকায় হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। মাত্র তিন দিনের মধ্যে দুবার পাহাড়ধসের ঘটনায় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোকে স্থানান্তরের চেষ্টা করছে প্রশাসন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সীতাকুণ্ডের ১০ নম্বর সলিমপুর ইউনিয়নের দুর্গম জঙ্গল সলিমপুর পাহাড়ে গতকাল সকাল সাড়ে ১১টার দিকে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। এতে ছিন্নমূল সমবায় সমিতির ৭ নং সমাজ এলাকার বাসিন্দা কাঠমিস্ত্রি কবির আহমদের স্ত্রী সুমি বেগমের মালিকানাধীন ঘরটি দুমড়েমুচড়ে যায়। তবে ঘটনার সময় সুমি বেগম, তাঁর ছেলে ও কবির কেউই ঘরে ছিলেন না। টানা বৃষ্টির কারণে কবিরের পরিবারসহ ৮০টির মতো পরিবারকে গত রবি ও সোমবার নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ফলে কেউ হতাহত হয়নি। এর আগে শুক্রবার ছিন্নমূল বস্তির ৩ নং সমাজ এলাকায় মো. রফিকের ঘরে পাহাড় ধসে পড়ে তাঁর পরিবারের পাঁচজন নিহত হয়। ফের পাহাড়ধসের ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু বিকল্প নিজস্ব জায়গা না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ওই পাহাড় ছেড়ে স্থায়ীভাবে অন্যত্র চলেও যেতে পারছে না তারা।
ছিন্নমূল ৭ নং সমাজের বাসিন্দা মো. আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, রবিবার থেকে আবারও টানা বৃষ্টি শুরু হওয়ায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং শুরু হয়। কিন্তু অনেকেই নিজ ঘর ছেড়ে অন্যের ঘর বা আশ্রয়ে যেতে চায় না। তবুও প্রশাসনের কর্মকর্তারা সরে যাওয়ার জন্য চাপ দেন। রবিবারও প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩৫-৪০টির মতো পরিবারকে স্থানীয় স্কুল-মাদরাসায় সরিয়ে নেওয়া হয়। তারা সবাই খুব ঝুঁকিপূর্ণ উঁচু টিলায় বাস করছিল। আবার পাহাড়ের নিচু ঢাল বা সমতলের দিকে যারা বাস করে তাদের ঘরগুলো অতটা ঝুঁকিপূর্ণ না হওয়ায় বৃষ্টি বেশি শুরু হলে অনেকেই এসে সেখানে প্রতিবেশীদের ঘরে আশ্রয় নেয়। এভাবে সুমি বেগমের পরিবারও রবিবার নিরাপদ স্থানে সরে গিয়েছিল। ফলে গতকাল সোমবার তাঁর ঘরের ওপর পাহাড় ধসে পড়লেও বড় কোনো অঘটন ঘটেনি।
ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে ছিন্নমূল সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমানও জানান, ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় যারা ছিল তাদেরকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
জঙ্গল সলিমপুর অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই মো. ইসহাক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আবারও পাহাড়ধসের খবর শুনে আমরা দ্রুত ছুটে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওই ঘরের বাসিন্দারা আগে থেকেই নিরাপদ স্থানে অবস্থান করায় কেউ হতাহত হয়নি। ’ এসআই ইসহাক আরো বলেন, টানা বৃষ্টি শুরু হওয়ায় রবিবার প্রায় ৪০টি পরিবারকে স্থানীয় স্কুল ও মাদরাসায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরো ৪০-৪৫টি পরিবারকে প্রতিবেশীদের নিরাপদ ঘরে আশ্রয় দিয়ে নিজ ঘর থেকে সরিয়ে রাখা হয়।
সীতাকুণ্ডের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. রহুল আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা জঙ্গল সলিমপুরে প্রতিদিন মাইকিং করে ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের সরে যেতে বলি। তারা সমতলে অবস্থিত স্কুল-মাদরাসাসহ বিভিন্ন অফিস ও ঘরে আশ্রয় নিলে নিজেরাই রক্ষা পাবে। রবি ও সোমবার কিছু পরিবারকে সরানো হয়েছে। তবে প্রকৃতপক্ষে এখনো তাদের সরিয়ে নিয়ে স্থায়ীভাবে অন্যত্র বসানোর মতো সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। ’ সেটা করা গেলে একটি স্থায়ী সমাধান হতো বলে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরের পাহাড়ে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ অবৈধভাবে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। গত ২১ জুলাই ওই এলাকার ৩ নম্বর সমাজ এলাকার বাসিন্দা মো. রফিকের বসতঘরে পাহাড় ধসে পড়লে তাঁর স্ত্রী, ছেলেসহ পাঁচজন নিহত হয়। সে ঘটনার রেশ না কাটতেই আবারও এ ঘটনা ঘটল।
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, খাগড়াছড়িতেও ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলোতে বসবাসকারীদের সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে মাইকিংয়ে নেমেছে প্রশাসন। গতকাল বিকেলে খাগড়াছড়ি সদরে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করে মানুষজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে অনুরোধ করা হয়। খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এলিশ শারমিন গতকাল বিকেলে শালবন এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতিদের আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে অনুরোধ জানান। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত জেলা শহরের শালবনে অবস্থিত একটি ডরমিটরিতে অন্তত ১০টি পরিবারের সদস্যরা আশ্রয় নেয়। জেলা সদরের শালবন ও মোহাম্মদপুর এলাকায় পাহাড়ধসে চারটি ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খাগড়াছড়ি সদরের শালবন, সবুজবাগ, কলাবাগানসহ কয়েকটি এলাকায় বহুসংখ্যক পরিবার পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাস করছে।
দীঘিনালা (খাগড়াছড়ি) প্রতিনিধি জানান, গত তিন দিনের টানা বর্ষণে পাহাড়ধসের আশঙ্কায় গতকাল খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের সরিয়ে নিয়েছে প্রশাসন। উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, কবাখালী ইউনিয়নের কবাখালীতে, বিশেষ করে আলীনগর এলাকায় পাহাড়ধসের আশঙ্কা রয়েছে। সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারীদের সরে যেতে মাইকিং করা হয়েছে। তাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে কবাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি খুলে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মেরুং ইউনিয়নের মধ্য বোয়ালখালী এলাকায় রসিকনগর দাখিল মাদরাসা টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারীদেরও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাদের কয়েকটি পরিবার মাদরাসায় আশ্রয় নিয়েছে, অন্যরা আশ্রয় নিয়েছে স্বজনদের বাড়িতে। দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শেখ শহীদুল ইসলাম জানান, পাহাড়ধসের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে তিনি প্রতিটি এলাকা সরেজমিনে গিয়ে পরিদর্শন করছেন এবং সব এলাকার লোকজনরে সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন।
রাঙামাটি প্রতিনিধি জানান, পাহাড়ধসের আশঙ্কায় রাঙামাটিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করে ঝুঁকিতে বসবাসকারী মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ছয়টি আশ্রয়কেন্দ্রে গত দুই দিনে নতুন করে ঠাঁই নিয়েছে বহু মানুষ। গতকাল পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে এক হাজার ৩০০ মানুষ অবস্থান করছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন সূত্র।
এর আগে গত ১২ ও ১৩ জুনের দুর্যোগের পর শহরে ১৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলে তাতে আশ্রয় নেয় সাড়ে তিন হাজার মানুষ। গত এক মাসে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটায় তাদের প্রায় সবাই নিজ নিজ এলাকায় কিংবা স্বজনদের কাছে ফেরত গিয়েছিল। আবার স্কুলগুলো খোলার কারণে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্কুলের আশ্রয়কেন্দ্রের পরিবর্তে নতুন আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়। এসব আশ্রয়কেন্দ্রেও খুব বেশি মানুষ ছিল না। কিন্তু কয়েক দিনের টানা বর্ষণে শনিবার থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে বাড়তে থাকে মানুষ। বর্তমানে শহরের রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, পুনর্বাসন কোয়ার্টার, জিমনেশিয়াম, রাঙামাটি স্টেডিয়াম, রাঙামাটি মেডিক্যাল কলেজের নবনির্মিত হোস্টেল, মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
রাঙামাটির ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক প্রকাশ কান্তি চৌধুরী বলেন, ‘বৃষ্টির কারণে আমরা সতর্ক আছি, খোঁজখবরও রাখছি। এ পর্যন্ত কোথাও কোনো খারাপ খবর নেই। তবু আমরা মাইকিং করে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে যারা আছে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসার জন্য অনুরোধ করছি। সেখানে সব ব্যবস্থাই আছে। প্রয়োজনে আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা আরো বাড়ানো হবে। ’
রাঙামাটি ফায়ার সার্ভিসকে সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে এবং ১৫ সদস্যের রেসকিউ টিমও রেডি আছে।
এদিকে গত রবিবার টানা বর্ষণের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কে গতকালও যান চলাচল করতে পারেনি। সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এমদাদ হোসেন বলেন, ‘এই সড়কের খামারপাড়া এলাকায় নতুন সংস্কার করা সড়কটির ওপর দিয়ে এক-দেড় ফুট উঁচু হয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে এবং কেসিং এলাকায় রাস্তা ভয়াবহভাবে কর্দমাক্ত হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে। তাই আমরা যান চলাচল করতে দিচ্ছি না। বৃষ্টি বন্ধ হলে সংস্কারকাজ শেষে এটি উন্মুক্ত করা হবে। ’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/07/25/523491