২৪ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১২:০৩

ইংরেজির কারণেই ফল বিপর্যয়

বিশ্লেষণ

এসএসসির পর এইচএসসিতেও ফল বিপর্যয় ঘটল। ফলাফলের প্রায় সব কয়টি সূচকেই এবার অবনতি ঘটেছে। সামগ্রিক ফলাফলে উত্তীর্ণের হার যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে সর্বোচ্চ ভালো ফল জিপিএ ৫ পাওয়া শিার্থীর সংখ্যাও। এ ছাড়া সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি পরীার সম্প্রসারণ, কুমিল্লা বোর্ডের অর্ধেকেরও কম শিক্ষার্থীর পাস করা এবং ঢাকা বোর্ড, মাদরাসাসহ অনেক বোর্ডেই ইংরেজিতে কম পাস করা, মানবিক বিভাগে পাসের হার মাত্র ৫৮ শতাংশর সামান্য বেশি হওয়ার কারণেই মূলত এমন বিপর্যয় ঘটেছে এবারে এইচএসসির ফলাফলে। মূলত এ চার-পাঁচটি কারণই ফলাফলে বিপর্যয়ের মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।
প্রকাশিত ফলাফল বিশ্লেষণে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে গত এক-দেড় বছর রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিস্থিতিও ফলাফলে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে কোনো সহায়ক ভূমিকা পালন করেনি। অথচ আগে কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নিজেই।
বোর্ডগুলোর দেয়া তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এবারের এইচএসসিতে পাসের হার যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে জিপিএ ৫ প্রাপ্তির সংখ্যা। শতভাগ শিক্ষার্থী ফেল করেছে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও এবার বেড়েছে। এ ছাড়া শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও গত বছরের চেয়ে কমেছে। এবার পাস করেনি এরূপ কলেজের সংখ্যা হচ্ছে ৭২টি। গত বছর ছিল ২৫টি। গত বছরের চেয়ে এ সংখ্যা বেড়েছে ৪৭টি। এ বছর পাস করেছে ৬৮ দশমিক ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী। গত বছর এ হার ছিল ৭৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। ১০ বোর্ড মিলে এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে ৩৭ হাজার ৯৬৯ জন শিক্ষার্থী। গত বছর পেয়েছিল ৫৮ হাজার ২৭৬ জন।
ফলাফলের সব সূচকেরই অবনতির এ চিত্রকে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও বিপর্যয় হিসেবে স্বীকার করলেও ইতিবাচক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এই বলে যে, পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে নতুনপদ্ধতি অনুসরণ করায় এমনটি ঘটেছে। তিনি বলেছেন, এতে শিক্ষার মান বেড়েছে ও খাতা সঠিকভাবে মূল্যায়ন হয়েছে।
শিা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার রেকর্ডসংখ্যক ফেল করার নেপথ্যে কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি, যা নিয়ে শিক্ষকেরাও অনভ্যস্ত এবং অপরিণত। এ বছর ২৬টি বিষয়ে ৫০টি পত্রে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিতে পরীক্ষা হয়েছে। পাঠদান ও পরীায় অত্যাধুনিক এই পদ্ধতির সফল বাস্তবায়ন এখন পর্যন্ত সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া কুমিল্লা বোর্ডে ৪৯.৫২ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। অর্থাৎ অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষার্থী ন্যূনতম পাস নাম্বার পায়নি। এ বোর্ডেই ইংরেজিতে ফেল করেছে ৩০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী। শুধু কুমিল্লা নয়, ঢাকা বোর্ড, মাদরাসাসহ অনেক বোর্ডেই ইংরেজিতে কম পাস করেছে। অথচ শিক্ষামন্ত্রী বার বারই বলে বেড়াচ্ছেন, ইংরেজি ও অঙ্কে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিশেষ কাস নেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভীতি কমেছে। সারা দেশে ইংরেজি শিক্ষকের অভাব রয়েছে। সেটি পূরণ করা হয়েছে। কিন্তু পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে তার কোনো প্রভাব পড়েছে বলে প্রমাণিত হয়নি। ঢাকা বোর্ডের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, ইংরেজিতে প্রায় অর্ধেক পরীার্থী খারাপ ফল করে, যার প্রভাব পুরো ফলাফলে পড়ে। এবার সেটিই ঘটেছে।
এ ছাড়া এবারো বিগত পাঁচ বছরে সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা। আলিম পরীায় এবার পাসের হার ৭৭ দশমিক ০২ শতাংশ। গতবার আলিম পরীায় পাসের হার ছিল ৮৮ দশমিক ১৯ শতাংশ। গত বারের চেয়ে এ বছর বোর্ডে পাসের হার ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ কমেছে। এই বোর্ডে জিপিএ ৫ পেয়েছে এক হাজার ৮১৫ জন শিার্থী, যা গত বছরের চেয়ে ৫৯৯ জন কম। মাদরাসা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম ছায়েফউল্যা নয়া দিগন্তকে জানান, শিক্ষার্থীরা ইংরেজি বিষয়ে বেশি খারাপ করেছে। এটি বোর্ডের পাসের হারে প্রভাব ফেলেছে।
অপর দিকে, আন্তঃবোর্ডের দেয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, এ বছর আটটি সাধারণ শিা বোর্ডের অধীন পরীায় যত পরীার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছে, তাদের প্রায় ৮৩ শতাংশই বিজ্ঞান ও গার্হস্থ্য বিভাগের শিার্থী। এবার আটটি শিা বোর্ডে মোট জিপিএ ৫ পেয়েছে ৩৩ হাজার ২৪২ জন শিার্থী। এর মধ্যে ২৮ হাজার ৯৩৫ জনই বিজ্ঞান ও গার্হস্থ্য শাখার পরীার্থী। বিষয়টি তুলে ধরে শিামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সংবাদ সম্মেলনে জানান, জিপিএ ৫ ও পাসের হারে বিজ্ঞান ও গার্হস্থ্য শাখার পরীার্থীরা এগিয়ে। এই শাখা থেকে দুই লাখ ১৪ হাজার ৩৫২ জন পরীা দিয়ে পাস করেছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ২২০ জন। পাসের হার ৮৩ দশমিক ১৪ শতাংশ, যা সামগ্রিক ফলাফলে ইতিবাচক দিক হিসেবে চিত্রিত করেন মন্ত্রী।
এ দিকে এবারের ফলাফল বিপর্যয়ের জন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে দায়ী করা যাচ্ছে না। অথচ কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া না গেলে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিকেই শিক্ষার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে অভিযুক্ত করা হয়ে থাকে। কিন্তু গত প্রায় দু’বছর যাবৎ সারা দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল না। শিক্ষাকার্যক্রম চলাকালে ও পরীক্ষার সময় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করেছিল। সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পরিবেশ বিরাজ করলেও শিক্ষা ক্ষেত্রে বা পরীক্ষার ফলাফলে তার প্রভাব কেন পড়েনি তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
বিপর্যয়ের কারণ সম্পর্কে কয়েকটি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানরা যা বলেন
আন্তঃবোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহবুবুর রহমানের কাছে ফল বিপর্যয়ের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, ঢাকা ও কুমিল্লা বোর্ডসহ কয়েকটি বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার কম হওয়ায় এবং কুমিল্লা বোর্ডের শিক্ষার্থীদের ফল বিপর্যয়ের কারণেই সার্বিক ফলাফলে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে নতুনপদ্ধতি অনুসরণের কারণে পর পর দু’টি পাবলিক পরীক্ষায় (গত মে মাসে এসএসসি এবং গতকালের এইচএসসি) ফল বিপর্যয় সম্পর্কে মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ঢাকা বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, ফলাফলের গতি আগামী দু-এক বছরের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল খালেক ফল বিপর্যয় সম্পর্কে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, সবাই শুধু কুমিল্লা বোর্ডকেই দুষছেন। সব বোর্ডেই তো পরীক্ষার ফল খারাপ হয়েছে।
পরে দফায় দফায় অনুরোধে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা শুধু ইংরেজি বিষয়ে ফেল বেশি কেন করেছে তা খতিয়ে দেখা হবে। তিনি জানান, ইংরেজিতে ৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। অন্য কোনো বিষয়ে ফল বিপর্যয় হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
যশোর শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো: আবদুল আলিম বলেন, ইংরেজি ও কুমিল্লা বোর্ডের কারণেই সার্বিক ফল বিপর্যয় ঘটেছে।
সবচেয়ে বেশি পাসের হার এবার সিলেট বোর্ডে। সব বোর্ডকে এবার কিভাবে টেক্কা দিল সিলেট? জানতে চাইলে বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম গোলাম কিবরিয়া তপাদার বলেন, আমরা আগে থেকেই যতœ নিয়েছি শিক্ষার্থীদের। কঠিন বিষয়গুলোর ব্যাপারে বিশেষ নজর দেয়া হয়েছিল। অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের সচেতন করা হয়েছে। বিষয়ভিত্তিক সেমিনার করা হয়েছে চারটি। এর ফলই পেয়েছি এবারের ফলাফলে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/238326