২২ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১২:১৮

ইউএনও গ্রেফতারের ঘটনায় তোলপাড়

প্রধানমন্ত্রীর বিস্ময় : বাদি দল থেকে বহিষ্কার, ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে ডিসি ও এসপির বিরুদ্ধে

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বিকৃত করে আমন্ত্রণপত্র ছাপানোর অভিযোগে ইউএনও গ্রেফতারের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। এ ঘটনায় বিস্মিত হয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরাও। চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রশাসন ক্যাডারের আমলাদের মধ্যে। ফলে যেকোনো সময় মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হতে পারে। আর দলের ইমেজ ুণœ করায় মামলার বাদি বরিশাল আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ওবায়েদ উল্লাহ সাজুকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। একই সাথে কেন স্থায়ী বহিষ্কার করা হবে না সে ব্যাপারে শোকজ করা হবে বলে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিশ্চিত করেছেন। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট জেলার ডিসি ও এসপির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হতে পারে বলে সরকারের একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
আগৈলঝাড়া উপজেলার ইউএনও থাকাকালে গাজী তারেক সালমান স্বাধীনতা দিবসে শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে কার্ড ছাপান। বরগুনা সদর উপজেলায় বদলি হয়ে যাওয়ার পর ৭ জুন তার বিরুদ্ধে বরিশাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঁচ কোটি টাকার তিপূরণ ও মানহানির মামলা করেন বরিশাল আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক ও আইনজীবী সমিতির সভাপতি ওবায়েদ উল্লাহ সাজু। মামলাটি আমলে নিয়ে বিচারক ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে তারেক সালমানকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে সমন জারি করেন। গত বুধবার ওই মামলায় আদালতে হাজিরা দিয়ে জামিনের আবেদন করেন তারেক সালমান। আদালত প্রথমে তা নামঞ্জুর করে ইউএনওকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এর দুই ঘণ্টা পর তার জামিন মঞ্জুর করা হয়।
এ ঘটনা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায় ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমে। সংবাদের শিরোনাম হন পুলিশ বেষ্টনীতে হাতকড়া পরিহিত ইউএনও তারেক। এ ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। নিন্দা আর সমালোচনার ঝড় উঠে সাইবার দুনিয়ায়। বিভিন্ন মাধ্যমে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন ইউএনও গাজী তারেক সালমানের সহপাঠী ও ব্যাচমেটসহ প্রশাসন ক্যাডারের আমলারা।
অন্য দিকে শিশুর আঁকা একটি ছবি ও তার জের ধরে এক বছর পর যে পরিমাণ পানি ঘোলা হলো, তার জন্য বেশ বিব্রত অবস্থায় পড়ে সরকার এবং মতাসীন আওয়ামী লীগ। অতি উৎসাহীদের কারণে মতাসীন আওয়ামী লীগকে এর আগেও বহুবার বেকায়দায় পড়তে হয়েছে। কিন্তু এবার যে সমালোচনার ঝড় সামলাতে হচ্ছে, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না দলটি। সে জন্য ুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারকেরা।
প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানায়, ছবি বিতর্কের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টিগোচর হলে নাজেহাল হওয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) তারিক সালমানের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর হুবহু ছবি আজ পর্যন্ত কেউ আঁকতে পারেনি। আমরাও যেগুলো ব্যবহার করি ওই সব ছবিতেও কিছু খুঁত থাকে। হুবহু হয় না, আমি তো জানি। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা করে শিশুদের আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি ব্যবহার করে ইউএনও প্রশংসনীয় কাজ করেছেন।’
ইউএনওর নাজেহালের ঘটনায় তীব্র ােভ প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ছবি ব্যবহার করা নিয়ে যারা এটা করেছে, তারা নিশ্চয়ই দলের ও সরকারের জন্য ভালো কিছু করেনি। আর যে বিচারক সরকারি একজন কর্মকর্তাকে জেলে পাঠিয়েছেন তিনি হয়তো নিজে অতি উৎসাহী হয়ে এটা করেছেন, অথবা কারো ফোন পেয়ে প্রভাবিত হয়েছেন। এখন খুঁজে বের করতে হবে সেই ফোন কার ছিল। একজন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে বিভাগীয় অনুমতি লাগে। তিনি কি তা নিয়েছেনÑ এটাই আমার প্রশ্ন।’
সূত্র জানায়, ইউএনও গ্রেফতারের এ ঘটনায় প্রশাসনসহ সব মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। আর এ প্রতিক্রিয়া সামাল দিতে প্রধানমন্ত্রী নিজেও তার ুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভের বিষয়টি স্বীকার করেছেন তার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। বৃহস্পতিবার রাতে তিনি বিবিসির সাথে এক সাাৎকারে বলেন, ‘আমরা সবাই, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আজ যত কর্মকর্তা ছিলেন, এটি দেখে আমরা সবাই বিস্মিত হয়েছি। যে ব্যক্তি এ মামলা করেছেন, আমরা মনে করি তিনি অত্যন্ত ঘৃণীত কাজ করেছেন।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ছবিটি দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, কাস ফাইভের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে প্রতিযোগিতার আয়োজন করে এ অফিসার সুন্দর একটি কাজ করেছেন। এবং সেখানে যে ছবিটি আঁকা হয়েছে, সেটি আমার সামনেই আছে, আপনারা দেখতে পারেন এবং এ ছবিটিতে বিকৃত করার মতো কিছু করা হয়নি। এটি রীতিমতো পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। এ অফিসারটি রীতিমতো পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। আর সেখানে উল্টো আমরা তার সাথে এই করেছি, এই বলে প্রধানমন্ত্রী তিরস্কার করলেন। বললেন, এটি রীতিমতো নিন্দনীয়।’
প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারীকে কিভাবে গ্রেফতার করা হলো কোনো রকম অনুমোদন ছাড়া? এ প্রশ্নের জবাবে ইমাম বলেন, এটি করা যায় না। কারণ ইউএনও হচ্ছেন উপজেলা পর্যায়ে সরকারের সবচেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাকে কোনো শাস্তি দিতে হলে বা তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা কোনো রকম কিছু করতে হলে সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন। এইচ টি ইমাম এ ঘটনায় বরিশালের ডিসি এবং এসপিকে দায়ী করেন। বলেন, ‘পুলিশ যে ব্যবহার করেছে এ ছেলেটির (ইউএনও) সাথে, যেভাবে তাকে নিয়ে গেছে, এ নিয়ে আমি ওখানকার ডেপুটি কমিশনার, পুলিশ সুপার, এদের প্রত্যেককে দায়ী করব। এদের বিরুদ্ধেও আমাদের বোধহয় ব্যবস্থা নিতে হবে।’
কিভাবে পুলিশ এ রকম একটি মামলা নিল আর জেলা বিচারকই বা কিভাবে এ মামলা আমলে নিলেন সে ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে এইচ টি ইমাম বলেন, ‘আমাদের অফিসারটিকে যেন হেনস্থা করার জন্য পুলিশ যেভাবে গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে, এই পুরো ঘটনায় যে রকম তীব্র ােভ সৃষ্টি হয়েছে আমি তার সাথে সম্পূর্ণ একমত।’
ইমাম বলেন, ঘটনাটি শোনার পরপরই প্রধানমন্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন, ‘যে ব্যক্তি এ মামলা করেছে, সে কে? আমরা খবর নিয়ে জানলাম, এই লোক পাঁচ বছর আগেও আওয়ামী লীগে ছিল না। দলের ভেতরে ঢুকে পড়া এ অতি উৎসাহীরাই এ কাণ্ড ঘটিয়েছে, এ চাটুকাররাই আমাদের তি করছে।’
এইচ টি ইমাম বলেন, এ ঘটনার পেছনে তিনটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত. এই অফিসারের বিরুদ্ধে হয়তো তাদের কোনো ােভ ছিল। তাকে অপমানিত করা ছিল তাদের ল্য। দ্বিতীয়ত. বিভিন্ন সার্ভিসের মধ্যে একটি অসন্তোষ সৃষ্টি করা। আর তৃতীয়ত. সরকারের ইমেজ নষ্ট করা।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভাতেও আলোচনা হয়। এ সময় ুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বোর্ডের সদস্যরা। সভায় মামলার বাদিকে দল থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ ব্যাপারে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইউএনও নির্দোষ। সে বরং শিশুদের আঁকা ভালো ছবিটা ব্যবহার করেছে। কিন্তু অতি উৎসাহী হয়ে অহেতুক মামলা করে সাজু দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে। সে জন্য তাকে ৪৭ ক অনুচ্ছেদ বলে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। একই সাথে কেন স্থায়ী বহিষ্কার করা হবে না সে ব্যাপারে শোকজ করা হবে। আওয়ামী লীগ ইউএনওর পক্ষে।’
এ দিকে ইউএনও তারিক সালমানের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতির অভিযোগে করা মামলা প্রত্যাহারের চিন্তাভাবনা চলছে। একই সাথে বরিশালের ডিসি ও এসপির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। মামলা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসন্তোষ প্রকাশের পর এ চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে।
আইনজীবী সমিতির একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, মামলার বিষয়টি প্রচার হওয়ায় এর বাদি সৈয়দ ওবায়েদ উল্লাহ সাজু বেশ বেকায়দায় পড়েছেন। এ বিষয়ে মামলার বাদি সৈয়দ ওবায়েদ উল্লাহ সাজু বলেন, ‘এ বিষয়টি নিয়ে আইনজীবী সমিতিতে মিটিং রয়েছে। আলোচনা সাপেে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হবে। যেটা পরে সাংবাদিকদের জানানো হবে।’
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য তালুকদার মোহাম্মদ ইউনুস বলেছেন, ‘অনতিবিলম্বে বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধানের জন্য জেলা আওয়ামী লীগের প থেকে আমরা চেষ্টা করছি।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ গতকাল সন্ধ্যায় নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘এক শ্রেণীর চাটুকার বিভিন্ন সময়ই এ ধরনের মামলা করে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলছে। তবে ফালতু একটি অভিযোগে একজন ইউএনওকে গ্রেফতারের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আমরা সবাই ুব্ধ ও বিরক্ত। আওয়ামী লীগ নামধারী ওই নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’
দলের অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌদুরী বলেন, পঞ্চম শ্রেণীর শিার্থীর আঁকা ওই ছবিটি আমরা দেখেছি। বঙ্গবন্ধুর ছবির সাথে বিকৃতি ঘটছে বলে মনে হয়নি। যে কেউ দেখলেই ছবিটির প্রশংসা করবে। ছোট্ট শিশু এমন একটি ছবি আঁকার সাহস করেছে, সেটাই তো আমাদের কাছে বড় পাওয়া। কিন্তু অতি উৎসাহী লোকজনের কারণে মাঝে-মধ্যেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় আমাদের। বঙ্গবন্ধু এবং দলের প্রতি আনুগত্য থাকলে কেউ এমন কাণ্ড ঘটাতে পারে না।’

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/237672