২২ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ১২:১৭

সরকারি গুদামের চাল পাচার

ভি-ইনয়েস, ডিও দিয়ে কোটি টাকার বাণিজ্যভ

চট্টগ্রামের হালিশহর কেন্দ্রীয় খাদ্য গুদামের চাল পাচারের ঘটনায় মামলা হয়েছে। গুদামের ব্যবস্থাপক প্রণয়ন চাকমাসহ গ্রেপ্তার পাঁচজনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। প্রণয়নকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। মামলার আরেক আসামি সহকারী ব্যবস্থাপক ফখরুল আলমকে কুমিল্লায় বদলি করা হয়েছে। তবে তিনি এখনো পলাতক।
গত সোমবার রাত থেকে বুধবার পর্যন্ত নগরের হালিশহর ও আকবরশাহ এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে র্যাব ১৬৮.৫ মেট্রিক টন চাল জব্দ করেছে। র্যাব বলছে, গ্রেপ্তারের পর প্রণয়ন স্বীকার করেছেন গুদামের চাল পাচার করা হচ্ছিল। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে তা অবৈধভাবে বিক্রি করা হয়েছিল।
প্রণয়নের ভাষ্যের সূত্র ধরে তদন্ত চালিয়ে সরকারি চালের অবৈধ বাণিজ্যের বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে র্যাব-পুলিশ। তারা বলছে, চাল পাচারের সঙ্গে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা সরাসরি জড়িত। চাকরির পাশাপাশি তাঁরা ঠিকাদারি এবং ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে এ কাজে হাত মিলিয়েছে খাদ্য বিভাগের ঠিকাদার এবং চট্টগ্রামের অসাধু চাল ব্যবসায়ীরা। খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও অসাধু ব্যবসায়ী—এই চক্র নিয়ন্ত্রণ করে সরকারি চাল-গমের অবৈধ বাণিজ্য। প্রতি মেট্রিক টন চাল কেনাবেচা করে অন্তত ১৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। এক হাজার মেট্রিক টন চাল এভাবে হাতবদল করতে পারলে পকেটে আসে অন্তত দেড় কোটি টাকা। গুদামের চাল গুদামে রেখেই ভি-ইনভয়েস (পরিবহন চালানপত্র) এবং ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) ইস্যু করে মুখে মুখে সব কাজ চলে। পরে সুযোগ বুঝে গুদাম থেকে চাল পাঠিয়ে দেওয়া হয় ব্যবসায়ীদের কাছে। সরকারি খাদ্যশস্য প্রকল্পের বিপরীতে নির্দিষ্ট জেলা বা উপজেলায়ও পাঠানো হয় না। পরিবহনের টাকা তারা নিজেদের মধ্য ভাগ করে নেয়। এই চক্রের কারসাজিতে চালের বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে। তারাই বাজার অস্থির করে তুলেছে।
খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে তাদের কেউ নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি। তাদের ভাষ্য মতে, টিআর, জিআর, কাবিখা, ওএমএস এবং পাবর্ত্য চট্টগ্রামের বিশেষ খাদ্য কর্মসূচিসহ বিভিন্ন প্রকল্পের অনুকূলে স্থানীয় প্রশাসন সরকারি খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেয়। চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সরকারি বরাদ্দের খাদ্যশস্য পরিবহন করে ৩৪৬টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। নিবন্ধিত এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এক ব্যক্তির একাধিক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের অনেকেও ঠিকাদার।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বরাদ্দ করা খাদ্যশস্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রামের গুদাম থেকে জেলা-উপজেলার গুদামে পাঠানোর কথা। তবে চক্রটি এখানে কারসাজি করে। নিয়ম অনুযায়ী হালিশহর খাদ্য গুদামের কর্মকর্তারা তাঁদের রেজিস্টারে কোন তারিখে, কোন ট্রাকে, কত মেট্রিক টন খাদ্যশস্য, কোন জেলা বা উপজেলার কোন গুদামে পাঠানো হয়েছে, তা লিখে রাখেন। পাশাপাশি পরিবহন ঠিকাদারের বরাবরে একটি ভি-ইনভয়েস ইস্যু করেন। ঠিকাদার এই ভি-ইনভয়েস নিয়ে যান সংশ্লিষ্ট গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে। ওই কর্মকর্তাও একই পরিমাণ চাল প্রাপ্তির তথ্য তাঁদের রেজিস্টারে লিখেন। এভাবে আনা-নেওয়ায় প্রেরক গুদামে খাদ্যশস্য কমার কথা, প্রাপক গুদামে বাড়ার কথা। নথিপত্রেও তা-ই লেখা থাকে। কিন্তু বাস্তবে সেই খাদ্যশস্য চট্টগ্রামের গুদামেই থেকে যায়।
জানা যায়, প্রকল্প বাস্তবায়নের বিপরীতে সরকার চাল-গম বরাদ্দ দিলেও চট্টগ্রামের শ্রমিকরা চাল-গম নিতে চায় না। তাই বরাদ্দের চাল-গম সংশ্লিষ্ট প্রকল্প কমিটি ডিওর মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে বিক্রি করা সেই ডিও হাত ঘুরে চলে যায় চট্টগ্রামের পাইকারি চাল ব্যবসায়ীদের হাতে। অনেক সময় খাদ্যগুদামের কর্মকর্তারা নিজেরাই বেনামে ডিও কিনে নেন। এরপর ডিওগুলো সংগ্রহ করে তা ঠিকাদারদের ভি-ইনভয়েসের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়। সমন্বয় শেষে ডিওর অনুকূলে হালিশহর বা দেওয়ানহাটের গুদাম থেকে চাল-গম ট্রাক ভর্তি করে বের করে নেওয়া হয় পাইকারি বাজারে। এভাবে খাদ্যশস্য বিক্রি করে এবং পরিবহনের ক্ষেত্রে ফাঁক রেখে গুদামের কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা বিপুল টাকা পকেটে ভরছেন।
নিবন্ধিত ঠিকাদারদের একজন বলেছেন, খাগড়াছড়ির জন্য যদি সরকার ১০ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেয় তাহলে চট্টগ্রাম থেকে সেগুলো নিয়ে যেতে এক হাজার ট্রাক (প্রতিটি ট্রাক ১০ টন ওজন বহনে সক্ষম) লাগবে। কিন্তু কখনোই এভাবে খাদ্যশস্য পাঠানো হয় না। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, খাগড়াছড়ির সংশ্লিষ্ট খাদ্যগুদামের কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় নথিপত্র ও সিল নিয়ে চট্টগ্রামে আসেন। চট্টগ্রামে বসেই ৮০ শতাংশ চাল ‘রিসিভ’ দেখান। পরে সেগুলো সরাসরি খোলাবাজারে ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যায়। বাকি ২০ শতাংশ খাদ্যশস্য সংশ্লিষ্ট গুদামে যায় এবং স্থানীয় পর্যায়ে বিতরণ হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঠিকাদার বলেন, ‘তিন মাস আগে আমি হালিশহর থেকে ৩০০ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য খাগড়াছড়ি গুদামে পৌঁছানোর কার্যাদেশ পেয়েছিলাম। হালিশহর গুদাম থেকে ভি-ইনভয়েস সংগ্রহ করি। পরে ফোন করি খাগড়াছড়ির একটি গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে। ওই কর্মকর্তা নিজেই বেনামে ঠিকাদারি ও চাল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তিনি তাঁর রেজিস্টার ও সিল নিয়ে চট্টগ্রামে আসেন। আমার কাছ থেকে ভি-ইনভয়েস নিয়ে প্রাপ্তির জায়গায় সই করে সিল মেরে দেন। আর খাগড়াছড়ি থেকে আসার সময় তিনি কিছু ডিও লেটার নিয়ে আসেন। এসব ডিও দিয়ে তিনি চালগুলো পাহাড়তলীর খোলাবাজারে বিক্রি করে দেন। আমি চাল-গম পরিবহন না করেই টাকা পেয়েছি। সঙ্গে চাল বিক্রির টাকার একটি অংশও। হালিশহর ও খাগড়াছড়ি গুদাম কর্মকর্তারা চাল বিক্রির লভ্যাংশের পাশাপাশি পরিবহন না করেও টাকা পেয়েছেন। অসাধু ব্যবসায়ীরাও কম দামে চাল পেয়েছে। আমার জানা মতে, খাগড়াছড়ির ওই কর্মকর্তা ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকায় প্রতি মেট্রিক টন চালের ডিও কিনেছিলেন। কিন্তু চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারে তিনি প্রতি মেট্রিক টন বিক্রি করেছেন ৪৪ হাজার টাকায়। পাইকারি বাজারে তখন টনপ্রতি চালের দর ছিল ৫০ হাজার টাকা। ’
চট্টগ্রামের উপজেলা পর্যায়ের খাদ্যগুদামের একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘ডিওর ব্যবসা করে ব্যবসায়ীরা। গত জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে উপজেলা পর্যায়ের একটি সড়ক মেরামতের জন্য ১২ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ হয়েছিল। প্রকল্প কমিটি চাল না নিয়ে টাকা নেওয়ার আগ্রহ দেখায়। আমি প্রতি মেট্রিক টন ২৯ হাজার টাকা দরে ডিও কিনে নেই। পরে খাতুনগঞ্জের একজন ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করি ৪৬ হাজার টাকা টন দরে। লাভ হয়েছে দুই লাখ চার হাজার টাকা। ’
হালিশহর ও আকবরশাহ এলাকা থেকে চাল জব্দের পর প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে র্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারি চাল গুদামেই থাকে। মাঝখানে প্রকল্পের বরাদ্দ, পরিবহন, ভি-ইনভয়েস, ডিও ইত্যাদি ধাপ পেরিয়ে চালগুলো চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারে চলে যায়। গুদাম থেকে চাল বের করার সময় ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করেন কর্মকর্তারা। ’
চাল জব্দের মামলার পলাতক আসামি হালিশহর গুদামের সহকারী ব্যবস্থাপক ফখরুল আলমও ঠিকাদারি ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, তিনি স্ত্রী সালেহা আলমের নামে সুহৃদ ইন্টারন্যাশনাল, ছেলে সাজিদের নামে মেসার্স সাজিদ এন্টারপ্রাইজ, বাবা আবুল কালামের নামে মেসার্স কালাম অ্যান্ড সন্স ও আত্মীয় আবু নাছেরের নামে ছিদ্দিক এন্টারপ্রাইজসহ একাধিক সদস্যের নামে ঠিকাদারি লাইসেন্স নিয়েছেন। দুটি ট্রাকও আছে তাঁর। সেগুলো খাদ্যশস্য পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। এর আগেও অনিয়মের অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। চাকরি থেকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল তাঁকে।
জানা যায়, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে সরকার বিদেশ থেকে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভিয়েতনাম থেকে চালবাহী একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে। এসব চাল খালাসের আগ মুহূর্তে গত রবিবার খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাইলো বিভাগের চলাচল ও সংরক্ষণ পরিচালক চিত্ররঞ্জন বেপারী চট্টগ্রামের হালিশহর খাদ্যগুদাম পরিদর্শন করেন। এ সময় রেজিস্টার অনুযায়ী সেখানে প্রায় পাঁচ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুদ থাকার কথা ছিল। কিন্তু তিনি অন্তত দুই হাজার মেট্রিক টন চাল বেশি মজুদ দেখেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানান তিনি। এরপর হালিশহর গুদামের ব্যবস্থাপক প্রণয়ন চাকমা ও ফখরুল আলম মিলে বাড়তি মজুদের চাল তড়িঘড়ি করে সরানোর উদ্যোগ নেন। কারণ প্রকল্পে বরাদ্দের চাল সংশ্লিষ্ট জেলা বা উপজেলায় না পাঠিয়ে গুদামেই রেখে দিয়েছিলেন তাঁরা। সেগুলো ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রির কথা ছিল। সে উদ্দেশ্যে ট্রাকে ভরে নিয়ে যাওয়ার সময় খবর পেয়ে র্যাব তা জব্দ করে।
র্যাব-৭-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতা উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে হালিশহর গুদামের ম্যানেজার প্রণয়ন চাকমা স্বীকার করেছেন, ভি-ইনভয়েস ও ডিওর মাধ্যমে চাল পাচার হচ্ছে। ’
খাদ্যশস্য সরকারি গুদামে রেখেই ভি-ইনভয়েস ও ডিও দিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. জহিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আপনি যেভাবে শুনেছেন, সে ধরনের কানাঘুষা আমরাও শুনি। কিন্তু এসব তথ্য বাস্তবে প্রমাণ করা যায় না। ’


http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/07/22/522297