২৪ জুন ২০১৭, শনিবার, ১২:১৩

যানজটে নাভিশ্বাস

যাত্রীদের ক্ষোভ সড়কমন্ত্রীর ওপর * ৩০ মিনিটের পথ যেতে ছয় ঘণ্টা * ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন ও লঞ্চের ছাদে যাচ্ছে মানুষ

সড়ক ও মহাসড়কে যানজটে নাকাল হচ্ছেন ঘরমুখো মানুষ। স্বজনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে যাওয়া লাখ লাখ যাত্রী যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ির ভেতরেই আটকা থাকছেন। ভেপসা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছেন। অসুস্থ হয়ে পড়ছেন নারী ও শিশুরা। শুক্রবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লার মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল প্লাজা থেকে ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। ৩০ মিনিটের এ পথ যেতে যাত্রীদের সময় লেগেছে ছয় ঘণ্টা। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পার থেকে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল চৌরাস্তা পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটে দুর্ভোগে পড়েন উত্তরবঙ্গগামী যাত্রীরা। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল পর্যন্ত আড়াই ঘণ্টার পথ যেতে তাদের সময় লেগেছে ৬ ঘণ্টা। আবার কোথাও কোথাও সড়ক ভাঙাচোরা হওয়ায় ‘হেলেদুলে’ চলছে বাস। এছাড়া শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী ও পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে এক হাজারের বেশি গাড়ির জট সৃষ্টি হয়। পদ্মা নদী পার হতে লাগছে ৩-৭ ঘণ্টা। ফলে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের যাত্রীদের দুর্ভোগের শেষ নেই।


তীব্র গরমে যানজটের শিকার যাত্রীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা জানান, দফায় দফায় যানজটে কাহিল হয়ে পড়েছেন। তারা সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, মন্ত্রী সড়কের হালহকিকত দেখার জন্য বিভিন্ন স্থানে ছুটে যাচ্ছেন, টেলিভিশনে সেসব দৃশ্য দেখানো হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না, ভাঙাচোরা সড়ক যেমন ভালোভাবে মেরামত হচ্ছে না, তেমনি যানজট নিরসনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপও নেয়া হচ্ছে না। এভাবে লোকদেখানো ফটোসেশন করে মানুষের দুর্ভোগ কমানো যাবে না। মিডিয়ায় তিনি বলছেন, সড়কে যানজট নেই, গাড়ি কোথাও কোথাও ধীরগতিতে চলছে। এসব বলে সমস্যা এড়ানো যাবে না।

পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে স্বস্তিতে ঈদ যাত্রার আশ্বাস দেয়া হলেও বাস্তবে পরিস্থিতি উল্টো। সড়ক ও মহাসড়কের অনেক স্থানে ভাঙাচোরা মেরামত করা হয়েছে ইট-সুরকি ও বালু দিয়ে। নামকাওয়াস্তে সড়ক মেরামতের নামে অর্থের অপচয় করা হয়েছে। এসব সড়কে গাড়ি চলতেই ইট উঠে আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। এতে গাড়ির গতি কমে যাচ্ছে। ভাঙা রাস্তার ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। ভাঙাচোরা সড়ক ও মহাসড়কে যানজটের কারণে গন্তব্যে যেতে দ্বিগুণ সময় লাগছে কোনো কোনো রুটের যাত্রীদের। এতে ঢাকায় গাড়ির সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।

তবে মহাসড়কে যানজট নেই দাবি করে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মহাসড়কে দূরপাল্লার গাড়ির ধীরগতি রয়েছে, কোথাও কোনো যানজট নেই। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ভোগান্তি কম। মন্ত্রী বলেন, এ মুহূর্তে বাংলাদেশের কোথাও যানজট নেই, দু-একটি জায়গায় ধীরগতি আছে, কোথাও গাড়ি থেমে নেই। পর্যাপ্ত গাড়ি ও টিকিট থাকা সত্ত্বেও কৃত্রিম পরিবহন সংকট তৈরি ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পেলে মন্ত্রণালয় থেকে ব্যবস্থা নেয়া হবে। শুক্রবার বিকালে সায়েদাবাদে ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রা পরিদর্শনে গিয়ে সেতুমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

সরেজমিন শুক্রবার রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলোতে দেখা গেছে, গাড়ির সংকটের কারণে কম ভাড়ায় গন্তব্যে যেতে হাজার হাজার মানুষ ভেতরে মোড়ায় ও বাসের ছাদে বসে রওনা হয়েছেন। বাসের ছাদে যাত্রী বহন ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় ছাড়ছে এসব গাড়ি। বাস সংকটের সুযোগ নিয়ে ৫০-৩০০ টাকা পর্যন্ত বেশি ভাড়া আদায় করছে পরিবহন শ্রমিকরা। সড়ক-মহাসড়কে যাচ্ছে লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি। এছাড়া গাড়ির সিডিউল ভেঙে পড়েছে। গাবতলীর বাস টার্মিনাল থেকে নির্ধারিত সময়ের ২-৫ ঘণ্টা দেরিতে বাস ছাড়ছে। ফলে আগাম টিকিট কেনা যাত্রীরা যাত্রার শুরুতে ঢাকাতেই বিপাকে পড়ছেন। একই চিত্র দেখা গেছে লঞ্চ ও ট্রেনেও। পর্যাপ্ত আসন না থাকায় ট্রেন ও লঞ্চে বাদুড়ঝোলা এবং ছাদে চড়ে বাড়ি ফিরছেন।

সড়কের খারাপ অবস্থার কারণে ভোগান্তির বিষয়ে শুক্রবার দুপুরে মহাখালী বাস টার্মিনালে কথা হয় ঢাকা-নেত্রকোনা রুটে চলাচলকারী হযরত শাহজালাল (র.) এক্সপ্রেসের (বাস) চালক মো. শাহীনুর রহমানের সঙ্গে। যুগান্তরকে এ চালক বলেন, ‘টঙ্গী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত পুরো রাস্তা ভেঙেচুরে বিনাশ হয়ে গেছে। ইট দিয়ে রাস্তা মেরামত করা হয়েছিল দু’দিন আগে। আজ ফেরার পথে দেখলাম ইট উঠে রাস্তা তছনছ হয়ে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত রাস্তা ভালো। ময়মনসিংহ থেকে নেত্রকোনা পর্যন্ত পুরো সড়কই ভাঙাচোরা। আর নেত্রকোনা শহরের রাস্তায় এত বড় বড় গর্ত আছে, যেখানে কেউ চাইলে মাছ চাষ করতে পারবে। এ চালক জানান, শুক্রবার নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় আসতে সাত ঘণ্টা সময় লেগেছে। অথচ এ পথ যেতে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লাগার কথা। ঢাকা-গোপালপুর রুটে চলাচলকারী অগ্রগামী বাসের চালক রিয়াজুল হক বলেন, আশুলিয়ার জামগড়া এলাকার রাস্তা ভাঙাচোরা। গাজীপুরের চান্দুরা থেকে টাঙ্গাইল পর্যন্ত রাস্তা এতই খারাপ যে, গাড়ি চালানো যায় না। এ রাস্তায় যানজট লেগেই আছে। শুক্রবার টাঙ্গাইলে তিন ঘণ্টার পথ যেতে ৭ ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে। ঢাকা-শেরপুর রুটের শাহীমনি বাসের চালক মোজাম্মেল হোসেন জানান, গাজীপুরের টঙ্গী, স্টেশন রোড ও বড়বাজার এলাকায় রাস্তা ভাঙাচোরা। এতে থেমে থেমে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। শুক্রবার শেরপুর থেকে ঢাকায় ফিরতে লেগেছে ৬ ঘণ্টা। অথচ এই পথ আসতে সময় লাগে ৪ থেকে সাড়ে ৪ ঘণ্টা। একটি গ্রুপ অব কোম্পানির কর্মকর্তা এম আবদুল্লাহ আল মামুন মোবাইল ফোনে বলেন, সকাল ৬টায় গাড়ি নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হয়েছি। বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত পুরো পথই যানজটে আটকা ছিলাম। যানজট মাড়িয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌঁছতে বেজেছে সন্ধ্যা ৭টা। অথচ এ পথ আসতে সব মিলিয়ে ৬-৭ ঘণ্টার বেশি সময় লাগার কথা নয়।

এদিকে সড়ক-মহাসড়কে যানজটের কারণে নির্দিষ্ট সময়ে বাস ঢাকায় ফিরতে না পারায় বিপাকে পড়েছেন গাবতলীর বাস কোম্পানিগুলো। হানিফ, সোহাগ, এসআরসহ বিভিন্ন বাস কোম্পানির ঈদ উপলক্ষে গাবতলী বাস টার্মিনালের কাউন্টারে আগাম টিকিট বিক্রি করা হয়েছিল। এসব কোম্পানির বাস ২-৩ ঘণ্টা দেরিতে ছেড়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাস মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও এসআর পরিবহন এমডি জিআর শহীদ যুগান্তরকে বলেন, সড়কের যে অবস্থা, তাতে সিডিউল নেই। ১২টার গাড়ি ২টায়, ২টার গাড়ি ৪টায় ছাড়ছি। প্রতিটি গাড়ি ২-৩ ঘণ্টা দেরিতে ছাড়তে হচ্ছে। এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, যানজটের কারণে ঢাকায় গাড়ি ঢুকতে পারছে না। ফলে নির্দিষ্ট সময়ে গাড়ি ছাড়তে পারছি না।

এদিকে রাজধানীর মহাখালী ও গাবতলী বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, আগের চেয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। ঢাকা-শেরপুর রুটে আগে ৩শ’ টাকা ভাড়া নেয়া হলেও শুক্রবার চারশ’ টাকা ভাড়া নেয়া হয়েছে। ঢাকা-গোপালপুর ২৪০ টাকার ভাড়া এখন ৩০০ টাকা। ঢাকা-নেত্রকোনা ২৫০ টাকার ভাড়া ৩০০ টাকা নেয়া হচ্ছে। ঢাকা-শেরপুর রুটের শাহীমনি বাসের চালক মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ঈদ উপলক্ষে ২০০ টাকার ভাড়া একশ’ টাকা বাড়িয়ে চারশ’ টাকা নিচ্ছি। ঢাকা-নেত্রকোনা রুটের শাহজালাল (র.) এক্সপ্রেসের গাড়িচালক মো. শাহীনুর রহমান বলেন, সরকারি চার্ট অনুযায়ী ঢাকা-নেত্রকোনার ভাড়া ২৯২ টাকা। আগে আমরা ২৫০ টাকা নিতাম। ঈদ উপলক্ষে ৩০০ টাকা নিচ্ছি।

আরও দেখা গেছে, গাবতলীতে বাসের ভেতরে মোড়ায় ও ছাদে যাত্রী বহন করা হচ্ছে। আইন অনুযায়ী, ছাদে যাত্রী বহন নিষিদ্ধ। ছাদে যাত্রী বহনের কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও থাকে। তবুও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই রাজধানীর গাবতলী, সায়েদাবাদসহ বিভিন্ন স্থানে বাসের ছাদে যাত্রী বহন করতে দেখা গেছে। গাবতলীতে দেখা গেছে, ঢাকা-রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটের শ্রাবন্তী এন্টারপ্রাইজের ভেতরে যাত্রীরা গরমে অস্থির হয়ে উঠেছেন। অথচ কড়া রোদের মধ্যেই এই বাসের ছাদে নেয়া হয়েছে জনাপঞ্চাশেক যাত্রী। বাসের ভেতরে একটি টিকিটের দাম ৭০০ টাকা। আর ছাদে বসার জন্য একজন যাত্রীর কাছ থেকে নেয়া হয়েছে ২০০ টাকা। ছাদে যাত্রী নেয়ার কারণ জানতে চাইলে শ্রাবন্তী পরিবহনের বিপ্লব নামের হেলপার বলেন, ‘ভাই, কি করব। সবাই গরিব মানুষ। ২০০ টাকার বেশি দিতে চায় না। ঈদ তো। তাই ইকটু নিয়া গেলাম।’ শ্রাবন্তী পরিবহনের পাশে আবদুল্লাহ, রজনীগন্ধা পরিবহন নামে ঢাকা-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটের আরও দুটি বাসেও একইভাবে ছাদে যাত্রী তোলা হয়।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৩০ কিলোমিটার যানজট : দাউদকান্দি প্রতিনিধি জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দি টোল প্লাজা পার হওয়ার পর মেঘনা-গোমতী সেতুর পশ্চিম পার থেকে নারায়ণগঞ্জ জেলার মেঘনা সেতু পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার যানজট সৃষ্টি হয়। মহাসড়কে চার লেনের গাড়িগুলো মেঘনা সেতু দিয়ে দুই লেন হয়ে ধীরগতিতে চলার কারণে এ যানজটে শত শত পরিবহন থমকে দাঁড়ায়। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা হোমনা সুপার পরিবহনের যাত্রী রকিব উদ্দিন বলেন, সেহরি খেয়ে ভোর সাড়ে ৪টায় ঢাকা থেকে রওনা হয়ে কাঁচপুর সেতুর ওপর থেকে যানজটের শিকার হই। পথে পথে যানজট থাকায় দুপুর ১২টার সময় দাউদকান্দি এসে পৌঁছি। এ যানজটের কারণে অ্যাম্বুলেন্সের রোগীরাও আটকা পড়েন।

গজারিয়া হাইওয়ের ফাঁড়ির ইনচার্জ সার্জেন্ট আবুল হাসেম বলেন, ঈদে ছুটি শুরু হওয়ায় অতিরিক্ত গাড়ির চাপ থাকায় দু’দিকে চার লেনের গাড়িগুলো মেঘনা-গোমতী সেতু দিয়ে দুই লেন হয়ে সংকুচিত হয়ে পড়ে। এ কারণে উভয় দিকের যানবাহন সেতুর ওপর দিয়ে দুই লেনে হয়ে ধীরগতিতে গাড়িগুলো চলাচল করায় এ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। নতুন সেতু না হওয়া পর্যন্ত এ যানজট নিরসন সম্ভব নয়।

বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে হাটিকুমরুল পর্যন্ত ১৫ কিলেমিটার যানজট : সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড় থেকে হাটিকুমরুল গোল চত্বর পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে দীর্ঘ যানজট ছিল। শুক্রবার ভোর থেকে উত্তর ও দক্ষিণ বেঙ্গের প্রায় ২৪ জেলার যানবাহন লম্বা সারিবদ্ধ হয়ে থেমে থেমে চলাচল করেছে। ঢাকা থেকে ঈদে ঘরমুখো মানুষের বাড়তি গাড়ির চাপ ও উত্তর বঙ্গ থেকে ঢাকামুখী অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে যানজট বেড়ে যায়। এতে পণ্য পরিবহন ও যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছতে চরম ভোগান্তি হয়। এছাড়া নকলা সেতুতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে গাড়ি পারাপার করা হচ্ছে। ওই সেতুতে ধীরগতিতে গাড়ি পারাপার হওয়ায়ও যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।

ট্রাকচালক আবদুর রহিমের অভিযোগ, এ সড়কের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ছোটবড় খানাখন্দের সৃষ্টি এবং ঝুঁকিপূর্ণ সরু দুটি সেতু রয়েছে। যে কারণে খুব ধীরগতিতে দেখে-শুনে গাড়ি চলতে হচ্ছে। ঈদ এলেই সড়ক ও জনপথ বিভাগ লোক দেখানো মেরামত কাজ করে দায়িত্ব শেষ করে। এবার তাও করা হয়নি।

সিরাজগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু হেনা মোস্তফা কামাল জানান, মহাসড়কে চলাচলকারী ট্রাক ও লরিগুলোর ধীরগতি এবং দ্রুতগতির যানবাহনগুলো ওভারটেক করার কারণেই মূলত যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া, বৃষ্টির কারণে এসব সড়কের বিভিন্ন স্থানে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। ওইসব খানাখন্দ মেরামত করতে গিয়েও ঈদে ঘরমুখী মানুষদের কিছুটা ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।

দুই ফেরি ঘাটে হাজারও গাড়ির জট : মানিকগঞ্জ, গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী), লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ), শিবচর (মাদারীপুর) প্রতিনিধি জানান, দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার গাড়ি যাতায়াতের অন্যতম রুট হচ্ছে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া এবং শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি ফেরি পারাপার। এ দুই ফেরিঘাটে শুক্রবার এক হাজারের বেশি গাড়ির দীর্ঘ লাইন ছিল। শিমুলিয়া ঘাট এলাকায় শুক্রবার ভোর থেকেই গাড়ির চাপ বাড়তে থাকে। সকাল ১০টায় এ ঘাটে ৭ শতাধিক যানবাহন পারাপারের অপেক্ষায় ছিল। বিআইডব্লিউটিসি’র শিমুলিয়া ঘাট ব্যবস্থাপক শাহ নেওয়াজ জানান, শুক্রবার সকাল থেকেই যাত্রী ও যানবাহনের চাপ ছিল। ঘাট এলাকায় ছোটবড় মিলিয়ে ৭ শতাধিক যানবাহন পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে প্রাইভেট কারের সংখ্যাই বেশি রয়েছে। এদিকে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি রুটে স্পিডবোটে অতিরিক্ত ৮০ টাকা বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়েছে। অপরদিকে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটেও শত শত গাড়ির চাপ ছিল।

পাটুরিয়া ঘাটে দায়িত্বরত নৌ পুলিশের ইনচার্জ সামসুল আলম জানালেন, অতিরিক্ত যাত্রী বহনের দায়ে এ রুটে এমভি শাপলা ফুল ও এমভি নিপু নামের দুই লঞ্চকে তিন হাজার টাকা করে জরিমানা করেছেন মেরিন ম্যাজিস্ট্রেট।

ঝুঁকি নিয়েই ট্রেনের ছাদ ও ইঞ্জিনে যাত্রীরা : জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ট্রেনের ছাদে ও ইঞ্জিনের বগিতে যাত্রীদের বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে। রেলওয়ে কর্মীদের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ ঈদ করতে বাড়ি রওয়ানা হন। সরেজমিন দেখা গেছে, শুক্রবার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সকাল ৯টায় রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেন ছাড়ার কথা থাকলেও সেই ট্রেনটি ছেড়েছে বেলা সাড়ে ১১টায়। শুক্রবার একতা, ধুমকেতু, এগারসিন্ধুর, রাজশাহী এক্সপ্রেস, চট্টলা, জয়স্তিকা, মহানগর প্রভাতি, হাওর, লালমনি এক্সপ্রেসসহ ২৭টি আন্তঃনগর ট্রেন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছেড়ে গেছে। রংপুরসহ দুটি ট্রেন বিলম্বে চলাচল করলেও বাকি ট্রেনগুলো যথাসময়ে ছেড়ে গেছে। প্রতিটি ট্রেনের ছাদে যাত্রীদের উঠতে দেখা গেছে। ট্রেন স্টেশনে প্রবেশমাত্রই লোকজন হুড়হুড় করে উঠতে থাকে, ভেতরটা মুহূর্তে ভরে গেলে উঠে ছাদ ও ইঞ্জিনে। কমলাপুর থেকে ছেড়ে যাওয়া প্রতিটি ট্রেনই বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে বিরতি দেয়। ওই সময় লোকজনে ভরে থাকা ট্রেনগুলোতে আরও শত শত যাত্রী ঠেলে ঠেলে উঠেন। বিমানবন্দর স্টেশনে প্রতিটি ট্রেন কানায় কানায় ভরে যায়!

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন ট্রেনচালক ও গার্ড জানান, ঈদের সময় যাত্রীরা ইঞ্জিনেও মৌমাছির মতো বসে থাকে। ছাদ তো দেখাই যা না লোকজনের ভিড়ে। যাত্রীদের সহযোগিতায় ট্রেন বিরতি দেন তারা। গার্ডের বগিটি লোকে ভরা থাকে। ঈদের সময় কী করে ট্রেন চলে সেটি আল্লাহতালায় ভালো জানেন। স্বাধীনতার পর থেকে ঈদের সময় আজও পর্যন্ত কোনো বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। প্রচণ্ড যাত্রীর চাপে অনেক সময় বগি দেবে যায়।

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার সিতাংশু চর্ক্রবতী যুগান্তরকে বলেন, ঈদ উপলক্ষে সব কয়টি ট্রেন সিডিউল অনুযায়ী চলাচল করছে। ২/১টি ট্রেন বিলম্বে চলেছে, এটিকে সিডিউল বিপর্যয় কিছুতে বলা যাচ্ছে না।

এদিকে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের মতো এ স্টেশন লোকে লোকারণ্য হয়ে আছে। এ স্টেশনে মাত্র দুটি প্লাটফর্ম থাকায় যাত্রীদের দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত থাকছে না। কমলাপুর থেকে ট্রেন আসার আগে শত শত যাত্রী বিমানবন্দর টিন শেড প্লাটফর্মের ওপরে বসে থাকছে। স্টেশনে ট্রেন আসতেই ঠেলাঠেলি করে ছাদে ওঠার প্রতিযোগিতা শুরু হয়।

এদিকে শুক্রবার দুপুরে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন পরিদর্শন ও ঘরমুখো যাত্রীদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা জানান রেলপথমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক। পরে মন্ত্রী উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমান সরকার রেলওয়েতে ব্যাপক উন্নয়ন করে যাচ্ছে। রেলপথ নিরাপদ ও সাশ্রয় হওয়ায় এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। অতিরিক্ত যাত্রী ও সেবা বাড়াতে নতুন লাইন স্থানপথ আরও নতুন ট্রেন আনা হচ্ছে। তিনি বলেন, এবারও ঈদের সময় ট্রেন সময়মতো ছাড়ছে। রেলপথে চড়া যাত্রীরা বেশ খুশি ও সন্তুষ্ট। যাত্রীদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা ট্রেনের ছাদে উঠছেন, তাদের আনন্দ মাটি হয়ে যেতে পারে।

নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই ফিরছেন দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা : শুক্রবার বিকালে ঢাকা নদী বন্দরে (সদরঘাট) সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকা-হুলারহাট-ভাণ্ডারিয়াগামী এমভি টিপু-১২ লঞ্চ যাত্রীতে ভরপুর। ওই লঞ্চের ছাদ, পায়ে হাঁটার পথ, এমনকি প্রবেশ পথেও যাত্রীরা অবস্থান করছেন। তবুও যাত্রী তোলা হচ্ছে ওই লঞ্চে। যাত্রী নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে এ লঞ্চটিকে ছেড়ে যেতে মাইকিং করে বিআইডব্লিউটিএ। কিন্তু সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ওই লঞ্চ ছেড়ে যায়নি। উল্টো যাত্রী তুলেছে। যাত্রীরা অভিযোগ করেছেন, লঞ্চটিতে অন্তত তিন হাজার যাত্রী উঠেছে, যদিও যাত্রী ধারণ ক্ষমতা এক হাজারের বেশি নয়। অতিরিক্ত যাত্রী তোলার একই চিত্র দেখা গেছে, ঢাকা-রাঙাবালী রুটের এমভি গ্লোরি অব শ্রীনগর, ঢাকা-বরিশাল রুটের সুরভী-৮, পারাবত-১২, ঢাকা-ভাণ্ডারিয়া রুটের এমভি ফারহান-১০, ঢাকা-বরিশাল রুটের সুন্দরবন-১০সহ প্রায় সবগুলো লঞ্চে।

সংশ্লিষ্টারা জানান, লঞ্চের ছাদে যাত্রী তোলার কারণে পুরো লঞ্চটিই দুর্ঘটনা ঝুঁকিতে থাকে। এছাড়া বৃষ্টি বা ঝড় শুরু হলেই এসব যাত্রী তাড়াহুড়ো করে নিরাপদ স্থানে যেতে চান। তখনই লঞ্চ একদিকে কাত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। এসব কারণে লঞ্চের ছাদে যাত্রী বহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু অতি মুনাফার লোভে মালিকরা বেশি যাত্রী নেন। ঈদের যাত্রী চাপ বেশি থাকা ও লঞ্চ মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় প্রশাসনও এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে না।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম-পরিচালক মো. জয়নাল আবেদিন বলেন, লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী বহন রোধে তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করছেন। যেসব লঞ্চে বেশি যাত্রী বহন করা হচ্ছে সেগুলোকে যাত্রী নামিয়ে ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে।

সদরঘাট ঘুরে দেখা গেছে, এবার চাঁদপুর, পটুয়াখালী ও অন্যান্য রুটের যাত্রীরা পৃথক তিনটি স্থানে লঞ্চে উঠছেন। এ কারণে টার্মিনাল ভবনে যাত্রীদের চাপ কম ছিল। তবে গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। এ সড়কে ছিল যানজট।


http://www.jugantor.com/first-page/2017/06/24/134984/