২৪ জুন ২০১৭, শনিবার, ১২:০৬

৮ পরিবারে বেদনার ঈদ

নির্বাক। নিরন্তর অপেক্ষা। জানে না তাদের এ অপেক্ষার প্রহর কবে শেষ হবে? এভাবেই কাটছে গুমের শিকার ৮ বিএনপি নেতাকর্মীর পরিবারের দিনকাল। গুম হওয়া ৮টি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদের কোনো প্রস্তুতি নেই তাদের। হয়নি কোনো কেনাকাটা। নেই কোনো আনন্দ। কেবল স্বজনদের ফেরার আশায় তারা তাকিয়ে আছেন তাদের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া স্বজনেরা আবার ফিরে আসবে। সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন শুরু করবে। কর্মক্ষম হয়ে পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনবে। সরকারের কাছে ভিকটিমের পরিবারের একটাই দাবি, জীবিত অবস্থায় তাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হোক। যদি তারা দোষী হয়ে থাকেন তাহলে আইনের মাধ্যমে বিচার করা হোক।

২০১৩ সালে ৪ঠা ডিসেম্বর ঢাকার শাহীনবাগ, নাখালাপাড়া, উত্তরা এবং বসুন্ধরা এলাকার বাসা ও রাস্তা থেকে র্যাব পরিচয়ে ৮ জনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরা হলেন, সাজেদুল ইসলাম সুমন (৩৭), আদনান চৌধুরী (২৯), আল আমিন (২৮), মো. মাসুম (২৮), জাহিদুল করিম তানভীর (৩০), মাজহারুল ইসলাম রাসেল (৩০), কাউসার হোসেন (৩২) ও রানা (৩০)। এরপর থেকে তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। ওদিকে নিখোঁজদের পরিবারগুলো তাদের উদ্ধারের দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে একাধিকবার মানববন্ধন করেছেন। সরকারের অনেক ব্যক্তির কাছে তারা ধর্না দিয়েছেন। কিন্তু তাদের কাছে তারা কোন আশার বাণী শুনতে পাননি।
শাহীনবাগের ৫৫৩ নম্বর সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার দুই মেয়ে হাফসা ও আরোরাকে নিয়ে বসে আসেন তাদের মা। সুমনের বৃদ্ধা মা হাজেরা খাতুন ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে শয্যাশায়ী। সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম তুলি জানান, তার ভাই পেশায় শেয়ার ব্যবসায়ী। ২০১৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর র্যাব’র পরিচয় দিয়ে বাসা তাকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন। পরে র্যাব কার্যালয়ে যোগাযোগ করে তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তার ভাইসহ যে ৮ বিএনপি’র নেতাকর্মীদের গুম করা হয়েছে তাদের উদ্ধারের জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন থেকে সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়েছিল। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তার ভাইয়ের অপরাধ কি? তার ভাই ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক। এটাই কি তার অপরাধ? এটা যদি তার অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে তার ভাইয়ের বিচার করা হোক।
অন্যদিকে, শাহীনবাগের ৬৪০ নম্বর বাসায় গিয়ে দেখা যায়, আদনান চৌধুরীর পিতা রুহুল আমীন নির্বাক বসে আছেন। সন্তান নিখোঁজের বেদনা নিয়ে তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা দিন কাটাচ্ছেন। আদনান ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি জানালেন, ২০১৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর তাকে র্যাব’র পরিচয় দিয়ে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রায় পৌনে ৪ বছর হয়ে আসছে।
তার সন্তানের খোঁজ নেই। আদনানের মা ছেলের কথা ভাবতে ভাবতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সামনে ঈদ। কিন্তু, আমাদের মধ্যে কোনো ঈদের আনন্দ নেই। শুধু একটাই অপেক্ষা আদনান কখন ফিরে আসবে। আদনানের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী।
এদিকে, রাজধানীর পূর্ব নাখালপাড়ার ৩২২/ডি নম্বর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নীরব কিছু মানুষের মুখ। মাসুমের পরিবারের সদস্যরা অপেক্ষায় থাকতে থাকতে নির্বাক হয়ে গেছেন। ঈদের আনন্দের কোনো রেশ নেই তাদের পরিবারে। তার বোন ফাওজিয়া ইসলাম প্রশ্ন করেন, আর কত অপেক্ষা? তার ভাইকেও একই দিন উত্তরার একটি প্রাইভেট কোচিং থেকে ধরে নিয়ে গেছে র্যাব’র পরিচয় দিয়ে। মাসুম তিতুমীর কলেজের ফিন্যান্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। ছাত্রদলের রাজনীতি করতো।
তিনি তার ভাইয়ের মুক্তি দাবি করেন। মাসুমের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার কুলাউড়া গ্রামে। অপরদিকে, বাড্ডার একেএম রহমতুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের গলিতে নিখোঁজ আল আমিনের বাসা। আল আমিনের বোন শারমিন খাতুন জানান, তার ভাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স সম্পন্ন করেছে। তাকেও র্যাব’র পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে আল আমিন নিখোঁজ। সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার আটকের বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তাই অপেক্ষার প্রহর গোনা ছাড়া আমাদের কি করার আছে। তিনি দাবি করেন তার ভাই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। এদিকে, নিখোঁজ তানভীরের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর র্যাব’র পরিচয় দিয়ে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ নেই। তানভীরের মা নিলুফা বেগম ছেলের শোকে অসুস্থ। তার খালাতো বোন আঁখি আক্তার জানান, তানভীর কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। সামনে ঈদ। অন্যদিকে নিখোঁজ রানার বোন মিনারা বেগম জানান, তার ভাই বাড়ি থেকে বের হন। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তার সন্ধান পেতে অনেক দৌড়াদৌড়ির পর এখন তারা আল্লাহ্র উপর ভরসা করে অপেক্ষায় আছেন। যদি কোনোদিন ফিরে আসে রানা। এসব পরিবারের মতো রাসেল ও কাউসারের পরিবারেও ঈদের আনন্দের বদলে বিরাজ করছে অপেক্ষার দুঃসহ যন্ত্রণা।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=71410&cat=3/