২৪ জুন ২০১৭, শনিবার, ১২:০২

হাসপাতালে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকি

রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের (পঙ্গু হাসপাতাল) ফটক দিয়ে সম্প্রতি দুটি কয়েল হাতে নিয়ে ঢুকছিলেন রামপুরার ইসমাইল হোসেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এইটা হাসপাতাল না, মশার ঘাঁটি? বাবার ভাঙা কোমরের চিকিৎসা নিতে আইসা তো এখন তাঁর জ্বর উঠছে, আর আমার নিজেরও ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া হওনের দশা।


এরপর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে কথা হয় এক রোগীর স্বজনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এমনিতেই হাসপাতালে বেড না পাইয়া বারান্দায় থাকতে হয়। তার ওপর মশার কামড়ে অস্থির। ভাইয়ের হার্টের চিকিৎসা করাতে আইসা এখন অন্য রোগের ভয়ে আছি। ’
ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, দিনের বেলায়ও রোগী ও তার স্বজনরা মশার কারণে অতিষ্ঠ। অন্যদিকে হাসপাতালের আশপাশের দোকানে দেদার বিক্রি হচ্ছে মশা তাড়ানোর কয়েলসহ নানা উপকরণ। কেউ কেউ কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ব্যবহার করে স্প্রে।
সম্প্রতি বাসাবাড়িতে মশাবাহিত জীবাণু বা ভাইরাসে অনেকে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে সরকারি ও বিশেষজ্ঞ পর্যায় থেকে। কিন্তু হাসপাতালের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিয়ে রোগী ও তার স্বজনরা বেশ উদ্বিগ্ন।
বিশেষজ্ঞরা জানান, চিকুনগুনিয়া কিংবা ডেঙ্গু, জিকা, জাপানিজ এনকেফালাইটিস, ফাইলেরিয়া, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বরসহ সাত-আটটি রোগ বিস্তারে দায়ী মশাবাহিত জীবাণু বা ভাইরাস। ঢাকায় এখন চিকুনগুনিয়া আর ডেঙ্গুতে ভুগছে অনেকে। বাসাবাড়ির পাশাপাশি হাসপাতালগুলোর পরিস্থিতিও মশাবাহিত রোগ-জীবাণু বিস্তারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই ঢাকাসহ দেশের সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালেও মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, হাসপাতালগুলোতে মশা যেমন বিপজ্জনক তেমনি মশা নিধনে হাসপাতালে ব্যক্তিপর্যায়ে ব্যবহৃত নানা কীটনাশকও বিপদ বয়ে আনতে পারে। তাই এ ক্ষেত্রে প্রতিটি হাসপাতালে নিবিড়ভাবে কৌশলগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম এবং মশা নিধনে স্প্রেবিহীন
কোনো কীটনাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে। অনেক দেশে ওয়াটার সল্যুবল নানা ধরনের কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়; যা পানিতে প্রয়োগ করলে এমনিতেই মশার লার্ভা ধ্বংস হয়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও কোনো কোনো সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে এমন কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত হাসপাতালগুলো মশামুক্ত রাখার জন্য এমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আবার সিটি করপোরেশনের বিকট শব্দের ফগার মেশিন দিয়ে বিষাক্ত ধোঁয়া সৃষ্টি করে মশা নিধন প্রক্রিয়াও হাসপাতালে প্রয়োগ করা যায় না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেনশন অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিনের (নিপসম) প্যারাসাইটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, মশার ওষুধে ক্ষতিকর প্রভাব থাকবেই। কয়েলের ধোঁয়ায় নাক, গলা, ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। হাসপাতালে স্প্রে বা মশার কয়েল ব্যবহার কোনোভাবেই ঠিক নয়। তবে মশা নিধনে কার্যকর অন্য কোনো কৌশল প্রয়োগ করা দরকার।
জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও ইউরোলজি হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নুরুল হুদা লেনিন বলেন, ‘ধরুন কিডনির রোগ নিয়ে এলো আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে। কিন্তু মশার কামড় নিয়ে ওই রোগী বাধিয়ে বসল চিকুনগুনিয়া বা ডেঙ্গু। তাহলে তো ওই রোগীর জন্য আরেক বিপদ। রোগী নানামুখী জটিলতায় পড়ে যাবে। তাই মশার উৎপাত নিয়ে আমরা সব সময়ই উদ্বিগ্ন থাকি। ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে কিংবা মশারি ব্যবহার করে সব সময় তো আর মশা থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। তেমনি কোনো নিজস্ব ব্যবস্থাপনাও আমাদের নেই। ’
জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোয়াররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মশার উৎপাত তো আছেই। কিন্তু আমরা হাসপাতালের রোগীদের কয়েল ব্যবহার করতে দেই না। কারণ যেকোনো সময় অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এ ছাড়া মশার কয়েল থেকে শ্বাসতন্ত্রেরও নানা সমস্যা দেখা দেয়। ’
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হাসপাতালকে মশামুক্ত রাখা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কিছুটা জটিলতাও আছে। এর সঙ্গে আছে নিজস্ব বাজেট স্বল্পতা। তবে রোগীদের ক্ষতি না হয় এমন কোনো পদ্ধতির কীটনাশক প্রয়োগ এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় খুব শিগগিরই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ’


http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/06/24/512389