২১ জুন ২০১৭, বুধবার, ৩:১১

মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী

ঘরে ঘরে চিকুনগুনিয়া আতঙ্ক

হঠাৎ করেই রাজধানীতে মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। প্রতিদিনই রাজধানীর ঘরে ঘরে ভাইরাসজনিত এ রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি তীব্র জ্বরে ভুগছেন। জ্বরমুক্ত হতে এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগছে। জ্বর সারলেও শরীরের গিরায় গিরায় ব্যথা ও শারীরিক দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে, যা দীর্ঘ দিন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে রোগীদের। এ কারণে মানুষের মধ্যে এখন চিকুনগুনিয়া আতঙ্ক বাড়ছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন প্রতি বছরের মতো এ বছরও প্রচুর পরিমাণ ওষুধ কিনেছে। কিন্তু তাতেও মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া একই এডিস মশা থেকে হচ্ছে, যা স্বচ্ছ পানিতে জন্ম নিয়ে থাকে। বাসায় রাখা গাছের টব, ফ্রিজ-এসির পানিতে এ মশা উৎপন্ন হয়। এ কারণে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে শুধু সিটি করপোরেশন কিছু করতে পারবে না, এ জন্য নগরবাসীকেই আগে সচেতন হতে হবে।
রাজধানীর মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন গত পাঁচ বছরে শতাধিক কোটি টাকা ব্যয় করেছে। দণি সিটি করপোরেশন এ বছর (২০১৬-১৭) মশক নিধনের জন্য ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় ধরেছে। গত বছর (২০১৫-১৬) ব্যয় করে ৯ কোটি ৯০ লাখ। এর আগের বছর (২০১৪-১৫) ব্যয় হয় ১১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। তার আগের বছর ১১ কোটি টাকা বাজেট রাখা হয়। তবে ব্যয় করতে সমর্থ হয় মাত্র দুই কোটি ১৩ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে মশক নিধনের জন্য বাজেট রাখা হয় ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু ব্যয় করতে সমর্থ হয় সাড়ে সাত লাখ টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরের ডিসেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে বাজেট পাঁচ কোটি টাকা রাখা হলেও ব্যয় হয় চার কোটি টাকা।
উত্তর সিটি করপোরেশনে এ বছর (২০১৬-১৭) মশক নিধনের জন্য বাজেট রাখা হয়েছে ২৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। গত বছর (২০১৫-১৬) ১১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাজেট ধরা হয়েছিল ১০ কোটি টাকা। তবে ব্যয় করতে সম হয় সাত কোটি ৮০ লাখ টাকা। তার আগের বছর ৯ কোটি টাকার বাজেট রাখা হলেও ব্যয় করতে পারে সাত কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর আগের দুই অর্থবছরেও সমপরিমাণ বাজেট ব্যয় করেছে উত্তর সিটি করপোরেশন।
এভাবে শতাধিক কোটি টাকা ব্যয়ের পরও কোনোভাবেই মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বরং গত কয়েক বছরে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। এ বছর ডেঙ্গুর পাশাপাশি নতুন করে ভাইরাসজনিত চিকুনগুনিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এডিস মশা থেকেই এ রোগ ছড়াচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর প্রতিনিয়ত চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগী বাড়ছে। কোনো কোনো পরিবারের সবাই একসাথে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। টিকাটুলির হাবিবুল্লাহ বেলালী নামে এক রোগী জানান, প্রথমে ব্যাপক জ্বর আসে। এরপর হাসপাতালে গেলে ডাক্তার রক্ত পরীক্ষা করতে বলেন। পরীক্ষার পর চিকিৎসকেরা জানান চিকুনগুনিয়া হয়েছে। এ রোগে আক্রান্ত হলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ১০৩-১০৪ ডিগ্রি জ্বর থাকে। পায়ের গিরায় গিরায় ব্যথা হয়। স্বাভাবিকভাবে হাঁটাও যায় না। সাত দিন বিশ্রাম নেয়ার পর জ্বর কমলেও শরীরে এখনো ব্যথা রয়েছে বলে তিনি জানান। মুগদার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান বলেন, আমার পরিবারের তিনজনের একসাথে চিকুনগুনিয়া হয়েছে। জ্বরের পাশাপাশি শরীরের অস্থিসন্ধিতে ব্যথা। নিজে চাকরির প্রয়োজনে চার-পাঁচ দিন পরই ঘর থেকে বের হলেও পরিবারের অন্য দুইজন প্রায় ১৫ দিন জ্বরে ভুগেছেন বলে তিনি জানান।
স্বাস্থ্য অধিদফতরে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) এক জরিপ থেকে জানা যায়, চিকুনগুনিয়ার জন্য রাজধানীর ২১ এলাকাকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। গত ১৫ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিকুনগুনিয়ার বিস্তার প্রতিরোধ সংক্রান্ত এক সভায় জরিপের এ ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টর, মধ্যবাড্ডা, গুলশান-১, লালমাটিয়া, পল্লবী, মগবাজার, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, রামপুরা, তেজগাঁও, বনানী, কুড়িল, পীরেরবাগ, রায়েরবাজার, নয়াটোলা, শ্যামলী, উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর, মনিপুরীপাড়া, মোহাম্মদপুর, মহাখালী, মিরপুর-১ ও কড়াইল বস্তি অন্যতম।
রাজধানীতে চিকুনগুনিয়ার বিস্তার রোধে স্বাস্থ্য অধিদফতরের উদ্যোগে গত ১৭ জুন ঢাকা মহানগরীর ৯২টি ওয়ার্ডের ৭৫০টি এলাকায় অভিযান চালান হয়। ৭০ সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, ডেন্টাল কলেজ, মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট স্কুল, ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি, নার্সিং ইনস্টিটিউট ও নিপসমের প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও চিকিৎসক ২০৫ দলে বিভক্ত হয়ে চিকুনগুনিয়া রোগের বাহক এডিস মশা নিধনে নগরীজুড়ে এ অভিযান পরিচালনা করে। তারা বাসাবাড়িতে এডিস মশার বংশবৃদ্ধির স্থান শনাক্ত করে ধ্বংস, পরিত্যক্ত কৌটা, ডাবের খোসা, ভাংগা হাঁড়িপাতিল ও অন্যান্য স্থানে জমানো পানি অপসারণ করেন। একই সাথে মেডিক্যাল শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করেন ও নগরবাসীকে স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান করেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রি. জেনারেল সালাহ উদ্দীন নয়া দিগন্তকে বলেন, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া ও আগাম অতিবৃষ্টির কারণে রাজধানীতে মশার উপদ্রব হচ্ছে। এডিস মশা থেকে চিকনগুনিয়া রোগ হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এডিস মশা স্বচ্ছ পানিতে জন্ম নেয়। বাসার ছাদে থাকা গাছের টব, এসি ও ফ্রিজের পানি, অব্যবহৃত গাড়ির টায়ার, নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত চৌবাচ্চা, পরিত্যক্ত টিনের কৌটা, প্লাস্টিকের বোতল, ক্যান, বিস্কুট বা চিপসের প্যাকেট, গাছের কোটর, পরিত্যক্ত বা ভাঙা হাঁড়ি, ডাবের খোসা ইত্যাদিতে পানি জমে সেখানে এডিস মশার জন্ম হচ্ছে। যা থেকে চিকুনগুনিয়া হচ্ছে। রাজধানীর ৯০ শতাংশ বাসার ছাদে টবের পানি নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, মানুষের অসচেতনার অভাবেই এ রোগ ছড়াচ্ছে বেশি। মানুষের বাসার ছাদে থাকা গাছের টবের পানি পরিষ্কার করা আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়। যার যার বাসার ছাদের টবের পানি, এসি-ফ্রিজের পানি তাদেরই অপসারণ করতে হবে।
সালাহ উদ্দীন জানান, বর্তমানে ডিএসসিসির কাছে ২৩ হাজার লিটার এডালটিসাইড, এক হাজার ৮০০ লিটার লার্ভিসাইড ও ১২ হাজার লিটার ম্যালেরিয়া ওয়েল জমা রয়েছে। এ ছাড়া আরো ৫০ হাজার লিটার এডালটিসাইড কেনার পর পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। তিনি জানান, চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় নিয়মিত ৩০৬ জনের পাশাপাশি আরো ১০৮ জন অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়েছে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে। আর জনগণকে সচেতন করতে এরই মধ্যে ১০ হাজার লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। আরো ১৫ হাজার বিতরণ করা হবে।
আইইডিসিআর সূত্রে জানা যায়, চিকুনগুনিয়া প্রথম ধরা পড়ে ১৯৫২ সালে আফ্রিকায়, পরে বিশ্বের অন্য দেশেও তার বিস্তার ঘটে। বাংলাদেশে প্রথম ২০০৮ সালে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। ২০১১ সালে ঢাকার দোহার উপজেলায় এ রোগ দেখা গেলেও পরে বিচ্ছিন্ন দু-একটি রোগী ছাড়া এ রোগের বিস্তার আর বাংলাদেশে ল করা যায়নি। তবে এ বছর ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে এ রোগ।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/230208