টানা বর্ষণে হবিগঞ্জে খোয়াই নদীর পানি বেড়ে বন্যা দেখা দিয়েছে। উমেদনগরের নবীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে মঙ্গলবার তোলা ছবি -যুগান্তর
২১ জুন ২০১৭, বুধবার, ৩:০৯

হুমকিতে বাঁধ ঝুঁকিতে হবিগঞ্জ শহর, উৎকণ্ঠা

খোয়াই নদীর উজানে ধেয়ে আসা ভারতের ড্যামের পানিতে ঝুঁকিতে পড়েছে হবিগঞ্জ শহর। এ নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় শহর রক্ষা বাঁধের কোথাও কোথাও ফাটল দেখা দিয়েছে। বাঁধ ভেঙে গেলে মূল শহর ৮-১০ ফুট এবং নিম্নঞ্চল ডুবে যাবে ২০-২৫ ফুট পানির নিচে। এ নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় শহরবাসী। তৎপর প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা। সতর্কতা জারি করে চলে মাইকিং। সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের দাবি, বাঁধের ফাটল সংস্কার করা হয়েছে। ফলে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। মঙ্গলবার বিকাল চারটার দিকে খোয়াই নদীর উজানের বাল্লা সীমান্তে নদীর পানি কমতে শুরু করায় শঙ্কা কিছুটা কমেছে। তবে ত্রিপুরায় ভারী বর্ষণ হলেই বাঁধ রক্ষা করা কঠিন হতে পারে। আরও কিছুদিন ত্রিপুরা বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।


মঙ্গলবার বিকালে হবিগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ পরিদর্শন করেন হবিগঞ্জ সদরের এমপি আবু জাহির। পরে তিনি যুগান্তরকে বলেন, খোয়াই নদীর উজানে থাকা ভারতের ড্যাম থেকে আসা পানিতেই আকস্মিকভাবে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী কেএম আনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, শহর রক্ষা বাঁধের ফাটল সংস্কার করা হয়েছে। ফলে এখন আর বাঁধে ভাঙনের আশংকা নেই।

হবিগঞ্জ শহর ও শহরতলি এলাকায় বাঁধের তিনটি স্থানে ভাঙনের শঙ্কা দেখা দিলে সোমবার রাত থেকেই স্থানীয় লোকজন সেখানে বালির বস্তা ফেলে বাঁধ রক্ষার কাজে যোগ দেয়।

পাউবো সূত্র বলছে, সোমবার ভোর থেকেই খোয়াই নদীর পানি বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ চুইয়ে পানি প্রবেশ করতে থাকে। শহরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক নেমে আসে। রাত সাড়ে আটটায় বন্যার পানি প্রবেশ করছে- এমন গুজব ছড়িয়ে পড়লে মুসল্লিরা তারাবি নামাজ শেষ না করেই বাসায় ফিরে যান। গভীর রাতে প্রশাসনের উদ্যোগে ভাটি এলাকার একাধিক স্থানে বাঁধ কাটতে গেলে স্থানীয় লোকজন লাটিসোটা নিয়ে বাধা দেয়। জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক সাবিনা আলম জানান, বানিয়াচং উপজেলার সুজাতপুরে নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় শহর রক্ষা বাঁধের ওপর থেকে ঝুঁকি কিছুটা কমেছে।

মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় হবিগঞ্জ প্রান্তে খোয়াই নদীর পানি বিপদসীমার ২৭৫ সেমি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। অপরদিকে উজানের বাল্লা সীমান্তে নদীর পানি ১০০ সেমি. হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার ১১১ সেমি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

হবিগঞ্জ শহরের ২০ কিলোমিটারজুড়েই এ বাঁধ। বাঁধ ভাঙার আশঙ্কার কথা জানিয়ে সোমবার প্রশাসনের উদ্যোগে মাইকিং এবং মসজিদ থেকে মাইকে বালির বস্তা নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে যাওয়ার আহবান শহরবাসীকে আতঙ্কিত করে তোলে। কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বাঁধ না ভাঙার জন্য দোয়া চেয়ে পোস্ট করেন। অনেকেই রাতভর নদীর তীরে বাঁধের ওপর সময় কাটান। সোমবার রাত থেকেই শহরের কামড়াপুর ও শহরতলির মাছুলিয়া, তেতৈইয়া এলাকায় বাঁধ চুইয়ে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান পাউবোর প্রধান প্রকৌশলী কেএম আনোয়ার হোসেন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এসএম শহীদুল ইসলাম ও নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহিদুল ইসলাম। তাদের উপস্থিতিতে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বালুর বস্তা ফেলা হয়। হবিগঞ্জ পৌরসভার দানিয়ালপুর এলাকায় পানি ঢুকে ১৫০টি বাড়ি প্লাবিত হয়ে পড়েছে। নদীর দু’পারের বাসিন্দাদের অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে কেউ বাঁধের ওপর আবার কেউ অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। কথা হয় বাঁধের ওপর আশ্রয় নেয়া গৃহবধূ করিমুন্নেছার সঙ্গে। তিনি জানান, বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় এখানে আশ্রয় নিয়েছি।

পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহিদুল ইসলাম জানান, বড় ধরনের ঝুঁকির আশঙ্কা নেই। তবুও যেসব এলাকায় বাঁধ চুইয়ে পানি প্রবেশ করছে সেসব এলাকায় বালির বস্তা ফেলে বাঁধ রক্ষা চলছে। তিনি বলেন, উজানে বৃষ্টি থেমেছে শুনেছি। আশা করছি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খোয়াই নদীতে বন্যার পানি কমতে পারে।

ফেঞ্চুগঞ্জ ও শায়েস্তাগঞ্জে বাঁধ রক্ষায় এলাকাবাসী : সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের জুড়িনদী বাঁধ ঝুঁকির মুখে রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধটি রক্ষা করতে শত শত গ্রামবাসী স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে কাজ করলেও পানির তোড়ে যে কোনো সময় ভেঙে যেতে পারে জুড়িনদী বাঁধটি।

সম্প্রতি অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি বাঁধ ছুঁই ছুঁই করলে আতঙ্কিত পিটাইটিকর ও ছত্তিশ গ্রামের বাসিন্দারা সোমবার রাতে বাঁধ রক্ষা করতে মসজিদে মাইকিং করলে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে বাঁধ রক্ষার কাজে এগিয়ে আসেন এলাকার বাসিন্দারা। খবর পেয়ে রাতেই ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার হুরে জান্নাত, ইউপি চেয়ারম্যান জাহিরুল ইসলাম মুরাদ, ইউপি সদস্য শিব্বির আহমদ। গভীর রাত পর্যন্ত এলাকার শত শত মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে বালুভর্তি বস্তা দিয়ে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করেন। ফেঞ্চুগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহিরুল ইসলাম মুরাদ বলেন, পানি বাঁধ ছুঁই ছুঁই করছে খবর পেয়ে এলাকাবাসীকে সাহস জোগাতে ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। বাঁধ যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। এ ব্যাপারে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হুরে জান্নাত বলেন, জরুরি ভিত্তিতে বাঁধ রক্ষা করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ হয়েছে।

এদিকে শায়েস্তাগঞ্জ পৌর এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খোয়াই নদীর পানি বিপদ সীমার ২৮০ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যেকোনো সময় নদীর পাড় ভেঙে প্লাবিত হতে পারে বিশাল এলাকা। তাই স্থানীয়রা ঝুঁকিপূর্ণ স্থান নির্ধারণ করে হাজার হাজার বস্তা বালু ফেলে বাঁধ নির্মাণ করছেন।

মঙ্গলবার সকাল ৬টার দিকে শায়েস্তাগঞ্জের আলাপুর গ্রামে খোয়াই নদীর পাড় উপচে পানি আসছে। সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় লোকজন ও দমকল বাহিনীর সদস্যরা বালুর বস্তা দিয়ে বাঁধ রক্ষা করেন।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ছালেক মিয়া, জেলা পরিষদের সদস্য মো. আবদুল মুকিত, পৌর কাউন্সিলর মো. নোয়াব আলী, ইউপি মেম্বার শামীমুর রহমান স্থানীয় লোকজনকে নিয়ে ঝুঁিকপূর্ণ স্থানে বালুর বস্তা দিয়ে বাঁধ উঁচু করছেন। এ খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবু জাহির।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/06/21/134252/