২১ জুন ২০১৭, বুধবার, ২:৫২

মহাসড়কে যত ভয়

সংস্কার ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টিতে

মহাসড়কের কোথাও ভাঙাচোরা, আবার কোথাও চলছে উন্নয়নের কাজ। কোনো স্থানে সড়ক ভালো তো সেতুতে সমস্যা_ এসব নানা কারণে দীর্ঘদিন ধরেই মহাসড়কে যাত্রীদের ভুগতে হচ্ছে। তাই এবার ঈদে ঢাকা ছাড়ার ক্ষেত্রে মানুষের মনে ভয় জাগাচ্ছে মহাসড়ক। গত বছরও ঈদযাত্রায় মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে ভোগান্তির শিকার হতে হয়, যানজটে বসে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মহাসড়কের পুরনো সমস্যাগুলোর সমাধান হয়নি, তাই এবার ভোগান্তির শঙ্কা কমেনি। ঈদযাত্রা স্বস্তিকর হবে_ এমন নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না খোদ সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও।


সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, মহাসড়কের ২৫ ভাগ ভাঙাচোরা। জেলা সড়ক হিসাবে নিলে দেশের মোট সড়কের ৩৭ ভাগই

বেহাল। ওবায়দুল কাদেরও স্বীকার করে বলেছেন, 'জেলা সড়কের অবস্থা মহাসড়কের তুলনায় খারাপ।' প্রতিবছরের মতো এবারও ঈদ যখন দুয়ারে, তখন সড়ক মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে। সওজ কর্মকর্তারাও স্বীকার করছেন, এতে খুব একটা লাভ হচ্ছে না। টানা বৃষ্টিতে সংস্কারকাজ 'ভেসে' যাচ্ছে। পরিবহন খাত-সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, তাহলে বর্ষার আগেই কেন সংস্কার শুরু করা হলো না? সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও একই প্রশ্ন তুলেছেন যাত্রীরা।

ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে মহাসড়ক সচল ও দখলমুক্ত রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল, ঈদের সাত দিন আগে মহাসড়কের সংস্কার শেষ করতে হবে। কিন্তু সেই নির্দেশও বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯ জুনের মধ্যে কাজ শেষ হয়নি। এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন ছিদ্দিক সমকালকে বলেন, মেরামতের কাজ যথাসময়ে শেষ হয়েছে। এখন যে কাজ চলছে, তা মেরামত নয়। কোথাও বিটুমিনের কাজ হচ্ছে না। সড়কের যেসব অংশ ভাঙাচোরা, সেখানে বালু ও ইট ফেলা হচ্ছে। এগুলো সাময়িক ব্যবস্থা; মেরামত নয়।

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, পৃথিবীর কোথাও প্রতি বর্ষায় সড়ক সংস্কার করা হয় না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে উল্টো। যথাযথ মান বজায় রেখে কাজ করলে প্রতি বর্ষার আগে সংস্কারের প্রয়োজন পড়ার কথা নয়। মানসম্মত সড়ক নির্মাণ না করা ও অনিয়মের কারণেই প্রতি বর্ষাতেই দুর্ভোগ হয়। মেরামতের নামে ইট-বালু ফেলা হয়। লাভ কিছুই হয় না, দুর্ভোগ আগের মতো থেকে যায়।

চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ২৬ জুন উদযাপিত হবে পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদের আগে শেষ কর্মদিবস আগামীকাল বৃহস্পতিবার। ধারণা করা হচ্ছে, সেদিন থেকেই শুরু হবে ঈদযাত্রার আসল চাপ। কোটি মানুষ নাড়ির টানে শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে ছুটবেন। মহাসড়কে বাড়বে ভিড়। গত ক'দিনে মহাসড়কে যে যানজট হয়েছে, ঈদযাত্রার ভিড় বাড়লে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এদিকে, গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে দেশের বিভিন্ন এলাকার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন মহাসড়কে ছোট-বড় গর্ত ও ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত রোববার সরেজমিনে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী সেতু থেকে চৌরাস্তা অংশে একই অবস্থা দেখা গেছে। বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে মহাসড়কের বিভিন্ন অংশও। রোববার টঙ্গী সেতু থেকে চৌরাস্তা অংশে ইট ফেলে গর্ত ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সংস্কার কাজ পরিদর্শন করতে যান সড়ক পরিবহনমন্ত্রী। জলাবদ্ধতার কারণে এতে কোনো লাভ না হচ্ছে বলে জানিয়েছেন যানবাহন চালকরা। তারা বলছেন, মহাসড়কের দুই পাশে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় মূল সড়ক সরু হয়ে গেছে, এতেই যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।

ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলার সড়ক যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের জয়দেবপুর-চন্দ্রা-এলেঙ্গা অংশ চার লেন উন্নীত করার কাজ চলছে। প্রতিবছর এ মহাসড়কে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ হয়। গত বছর ঈদে এ মহাসড়কে ভোগরা, চন্দ্রা, এলেঙ্গায় ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল। গতকালও চন্দ্রা, কোনাবাড়ী, মির্জাপুরে ছিল দীর্ঘ যানজট। ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে গতকাল চার লেনের নির্মাণকাজ বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু নির্মাণকাজের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কে এবারের ঈদেও ভোগান্তি হবে উত্তরবঙ্গের যাত্রীদের।

সড়ক পরিবহন সচিব বলেন, যেসব স্থানে উন্নয়নকাজ চলছে, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রায় ফ্লাইওভার নির্মাণকাজ চলছে, সেখানে সড়ক কিছুটা সরু হয়ে গেছে। তার ওপর হাজার হাজার পোশাককর্মী রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করেন। এ কারণে যানজট হয়। ঈদযাত্রায় এ কারণে যেন দুর্ভোগ না হয়, সে জন্য রাস্তা সাময়িকভাবে প্রশস্ত করা হচ্ছে। যাত্রীদের দাঁড়ানোর জায়গা বাড়ানো হচ্ছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুর অংশে যেখানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে, সেখান থেকে পানি নিষ্কাশন করে বালু ও ইট ফেলা হচ্ছে বলে জানান সচিব।

তবে এতে যে সুফল মিলছে, তার নজির নেই। গতকাল বিকেল ৫টায় মহাখালী টার্মিনাল থেকে এনা পরিবহনের একটি বাস ময়মনসিংহের উদ্দেশে যাত্রা করে। রাত ৮টায়ও বাসটি গাজীপুর চৌরাস্তা পার হতে পারেনি। যানজটের কারণে আড়াই ঘণ্টায় ২৭ কিলোমিটার পথও পার হতে পারেনি। আগামীকাল থেকে সময় আরও বেশি লাগতে পারে বলে জানান এনা পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ। সাজেদ রোমেল নামের এক যাত্রী জানান, সোমবার রাত ১০টায় মহাখালী থেকে রওনা করে চৌরাস্তা পার হতে সময় লেগেছে চার ঘণ্টা।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। গত বছরের জুলাইয়ে বহুল প্রত্যাশিত এ মহাসড়ক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। ১৯২ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়কে কোথাও ভাঙাচোরা নেই। সুপ্রশস্ত সড়কের মাঝে চোখজুড়ানো সবুজ ডিভাইডার। মাত্র চার ঘণ্টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া সম্ভব। অর্থনীতির লাইফ লাইনখ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত হলেও সুফল পাচ্ছেন না যাত্রীরা। মহাসড়কের সুফল আটকে আছে কাঁচপুর, মেঘনা ও গোমতী সেতুতে। গত সপ্তাহ থেকে গোমতী ও মেঘনা সেতুতে ওয়েব বেইজড টোল পদ্ধতি চালুর পর টোল প্লাজা থেকে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট হচ্ছে। ঈদযাত্রা শুরু হলে যানজট আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সরেজমিন পরিদর্শনের অভিজ্ঞতায় যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, প্রতি ঈদেই টোল প্লাজার কারণে এই দুই সেতুতে দীর্ঘ যানজট হয়। সরকার যদি ঈদের আগে ও পরে কয়েক দিনের জন্য টোল মওকুফ করে, তাহলে এ সমস্যা থাকত না। সরকারের কয়েক কোটি টাকা ক্ষতি হলেও যাত্রীরা স্বস্তিতে গন্তব্যে পেঁৗছাতে পারবেন। এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন সচিব বলেন, চাইলেও টোল মওকুফ করা যায় না। এর জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন।

ঢাকা-সিলেটে মহাসড়কের প্রবেশপথ নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় ফ্লাইওভার নির্মাণের কারণে যানজট হচ্ছে। গতকালও ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজের কারণে যানবাহন থেমে থেমে চলে। পরিবহন সচিব জানান, ঈদ উপলক্ষে নির্মাণকাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, ভুলতায় আগে থেকেই যানজট হয়। যানজট নিরসনেই ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হচ্ছে। ফ্লাইওভারের কাজ শেষ হলে যানজট থাকবে না।

ঈদযাত্রায় ভোগান্তির ভয় তৈরি করছে আরিচা ও মাওয়া ফেরিঘাট। দুই ফেরিঘাটে পদ্মা পাড়ি দিয়ে দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলার যাত্রীরা ঢাকা ছাড়েন। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের অবস্থা তুলনামূলক ভালো হলেও ফেরিঘাটে পারাপারের বাস-ট্রাকের দীর্ঘ সারি তৈরি হচ্ছে। গতকালও ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক এবং আশুলিয়ার বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়।

ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ককে এক্সপ্রেসওয়েতে উন্নীত করার কাজ চলছে। মাওয়া ফেরিঘাটে যান পারাপারের দীর্ঘ সারি না থাকলেও, নির্মাণকাজের কারণে মহাসড়কে পূর্ণ গতিতে যান চলাচল করতে পারছে না।

http://bangla.samakal.net/2017/06/21/302713#sthash.VT7UzkYc.dpuf