১৫ জুন ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:২৭

এখন এসে চুক্তির নীতি অনুসরণ করা ও ফ্রেমওয়ার্ক চূড়ান্ত হওয়ার কথা বলা হচ্ছে কেন

বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রী ঘোষিত তিস্তা নদী ও ফেনী নদীর অর্ন্তবর্তীকালীন পানি বণ্টন চুক্তির ‘ফ্রেমওয়ার্ক চূড়ান্ত’ হলো কীসের ভিত্তিতে- এই প্রশ্ন জনমনে দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা ও জট পাকিয়ে থাকা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির মহড়া কি শুরু থেকে আবারো শুরু হচ্ছে, নাকি এর নবতর যাত্রা শুরু হচ্ছে? চুক্তির মূল পক্ষ ভারতের দিক থেকে এমন কোন নিশ্চয়তা মিললো- যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ এতোটা আশ^স্ত হতে পারছে- সে প্রশ্নও উঠেছে।
আরো প্রশ্ন উঠছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কি বাংলাদেশকে তিস্তার পানি না দেওয়ার দাবী থেকে সরে এসেছেন? ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার মমতার বিকল্প প্রস্তাব বিবেচনা করে সে মতো সমীক্ষা চালানোর যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা থেকেও কি তারা বিরত থাকার কথা জানিয়েছে? মমতা ব্যানার্জির বক্তব্য অনুযায়ী সিকিমের বাঁধগুলোর কারণে পশ্চিমবঙ্গে পানি এসে পৌঁছাতে না পারায় তার এলাকাতেই পানির সংকট রয়েছে। তাই বাংলাদেশকে পানি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশের মন্ত্রীর কাছে কি এমন কোন খবর এসে পৌঁছেছে যে তিস্তার সব বাঁধ উন্মুক্ত করে দিয়ে পানিপ্রবাহ ছেড়ে দেয়া হয়েছে? এদিকে নতুন করে একটি অন্তবর্তী চুক্তি করার কথা বলা হচ্ছে। তাহলে আগের চুক্তিগুলো কী ছিলো? সেগুলো কি অন্তবর্তীকালীন ছিলো নাকি স্থায়ী কোন চুক্তি ছিলো। এবিষয়ে বিভ্রান্তি আর ধোঁয়াশাই যেন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
পানি সম্পদ মন্ত্রীর নয়া ‘ফ্রেমওয়ার্ক’ : গত ১৩ জুন মঙ্গলবার পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ জাতীয় সংসদে জানান, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দিক-নির্দেশনায় তিস্তা নদীর অন্তবর্তীকালীন পানি বণ্টন চুক্তির ফ্রেমওয়ার্ক চূড়ান্ত করা হয়েছে। এছাড়া ফেনী নদীরও অন্তবর্তীকালীন পানি বণ্টন চুক্তির ফ্রেমওয়ার্কও চূড়ান্ত করা হয়েছে।’ সংসদে সরকারি দলের সদস্য আবুল কালামের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী আরো বলেন, ‘শিগগিরই সমতা, ন্যায়ানুগতা এবং পারস্পরিক ক্ষতি না করার নীতির ভিত্তিতে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদন করা হবে। ভারতের সঙ্গে আলোচনাপূর্বক চুক্তি স্বাক্ষরের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি বণ্টন বিষয়েও আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকারের মধ্যে শুকনো মৌসুমে ফারাক্কায় গঙ্গা নদীর প্রবাহ বণ্টনের লক্ষ্যে ৩০ বছর মেয়াদী একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ অনুসারে ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতি বছর শুকনো মৌসুমে ফারাক্কায় গঙ্গা নদী পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করেও বিভিন্ন পর্যায়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরকালে শুকনো মৌসুমে তিস্তা নদীর পানি স্বল্পতার কারণে দুই দেশের জনদুর্ভোগের কথা অনুধাবন করে জরুরি ভিত্তিতে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া প্রয়োজন মর্মে যৌথ ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছে।’
আগের ‘চূড়ান্ত’ চুক্তিগুলো কোথায়?
ভাষ্যকাররা বলছেন, বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে সর্বাধিক আলোচনা এবং দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ে ‘প্রায় চূড়ান্ত’ কথাবার্তা হতে দেখা গেছে। এর মধ্যে কোন কোন সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ভূমিকাকে এক্ষেত্রে বাধা বলে জানানো হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, কিন্তু এর মধ্যে হঠাৎ করে দৃশ্যপটে এমন কোন মিরাকলের আবির্ভাব ঘটলো যে- বাংলাদেশের পানি সম্পদ মন্ত্রী যথারীতি একটি ‘ফ্রেমওয়ার্ক’ হাজির করতে সক্ষম হলেন? বলা হচ্ছে, উভয়পক্ষের সমতা ও ন্যায়পরতা এবং পরস্পরের ক্ষয়ক্ষতি না করার নীতির ভিত্তিতে তা চুড়ান্ত করা হবে। এটি অনেক পুরনো কথা। ২০১১ সালে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় এই চুক্তি ‘চুড়ান্ত’ হওয়ার কথা প্রায় নিশ্চিত করে বলা হয়েছিলো। কিন্তু এরপর বলা হলো যে, চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আপত্তিতে শেষ মুহূর্তে তা আটকে গেছে। তাহলে মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর করাকালে সেই ‘চূড়ান্ত চুক্তি’ গেলো কোথায়? পরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি গেলেন। সেসময় দিল্লিতে জোর গুঞ্জন তোলা হয়, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ইতোমধ্যে তিস্তা চুক্তির প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে সবুজ সংকেত দিয়েছেন, সেটা মমতা বন্দোপাধ্যয়ের সমর্থন না পাওয়া গেলেও। তাছাড়া তিস্তা চুক্তির বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের সমর্থন লাগবেই- এমন কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা কেন্দ্র সরকারের নেই বলে দিল্লির কর্মকর্তারা মনে করছেন। এই প্রেক্ষাপটে তখনো একটা ‘চূড়ান্ত চুক্তি’ হওয়ার কথা জোরেশোরে বলা হয়। সেটাই বা গেলো কোথায়? এখন আনিসুল মাহমুদ নতুন কথা বলছেন। প্রশ্ন উঠেছে, তিস্তা নিয়ে কি নতুন করে যাত্রা শুরু হলো? তাহলে এতোদিন কী হলো, আগের চুক্তিগুলোর কী হলো, কোথায় গেল?
মমতার বিকল্প প্রস্তাব খতিয়ে দেখছে ভারত
তিস্তা নদীর পানিবণ্টনের বিরোধিতা করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন, সেটি বিবেচনা করার কথা জানায় ভারত সরকার। মমতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে যেসব ‘অভিযোগ’ করেছেন তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গত ৫ জুন সোমবার দিল্লিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এসব কথা জানান। সেখানে বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে অবধারিতভাবে উঠে আসে তিস্তা চুক্তির বিষয়টিও। এ প্রসঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র বলেন, ‘তিস্তার পানির বিকল্প যে প্রস্তাব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিয়েছেন, সেটি ভারত সরকার খতিয়ে দেখছে।’ এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘প্রথমে নদীগুলোর পানিবণ্টনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হবে। তারপর সেই প্রতিবেদন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’ গত এপ্রিলে দিল্লি সফর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেসময় রাষ্ট্রপতি ভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে এক বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, তিস্তায় পানি স্বল্পতা থাকায় তার ভাগ বাংলাদেশকে দেয়া যাবে না। তার পরিবর্তে পশ্চিমবঙ্গের ছোট তিন নদী-তোর্ষা, ধানসিঁড়ি ও মানসিঁড়ির পানি বাংলাদেশকে দিতে তার আপত্তি নেই। এর আগে একই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে এক বৈঠকেও মমতা তার বিকল্প প্রস্তাব তুলে ধরেন। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মমতার প্রস্তাবকে গুরুত্ব দিয়ে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলিয়ে দিতে যাচ্ছে ভারত। সাংবাদিক সম্মেলনে সুষমাকে প্রশ্ন করা হয়, প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছেন, শেখ হাসিনা ও তার সরকারের মেয়াদের মধ্যেই তিস্তা চুক্তি করা হবে। এখন বাংলাদেশে আগামী বছর সাধারণ নির্বাচনের আগে সেটি করা সম্ভব কি না। জবাবে সুষমা বলেন, ‘চুক্তি কবে হবে তা এখনই নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়।’ তিনি ভারত সরকারের এ যাবৎকালের ঘোষিত নীতির পুনরাবৃত্তি করেই বলেন, ‘তিস্তা চুক্তি ভারত-বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সহমত নিয়েই করা হবে। এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সম্মতি প্রয়োজন। আমাদের ধারণা সেই সম্মতি পাওয়া যাবে।’
ভারত সরকারের ঘোষিত এই নীতির প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত কি ইতোমধ্যে তার নীতি থেকে সরে এসে বাংলাদেশকে তিস্তার পানি দেয়ার কথা বাংলাদেশকে জানিয়েছে কি না তা মন্ত্রী সংসদে জানাননি।
তিস্তায় কি পানি আসতে শুরু করেছে?
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বরাবর দৃঢ়কণ্ঠে বলে আসছেন, তিস্তা পশ্চিমবঙ্গের নদী। বাংলাদেশকে দেয়ার মত পানি তিস্তায় নেই। উজানে অনেক বাঁধ, সেখানে পানি আটকে আছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘সেই পানি না আসলে পানি কোথায় থেকে দেয়া হবে?’ পশ্চিমবঙ্গের উজানে সিকিমে অন্তত ১৪টি প্রকল্প করে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। তাহলে এখন কি সেই পানি আসা শুরু হয়েছে? অন্যদিকে মমতা ব্যানার্জির তিস্তার বিকল্প প্রস্তাব দিল্লি বিবেচনায় নিয়েছে এবং তা সমাধান করার কথাও বলেছে। পশ্চিমবঙ্গের মতামতের ভিত্তিতেই বিষয়গুলো চুড়ান্ত করা হবে। তাহলে দিল্লি এই মনোভাব কি ত্যাগ করেছে? যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের পানি সম্পদ মন্ত্রী একটি ফ্রেমওয়ার্ক তৈরির ব্যাপারে নিশ্চিত পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম হলেন? এই প্রশ্নগুলোর জবাব আসা জরুরি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে উদ্ধৃত করে গত ২০১৪ সালের মার্চে ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, রাজ্যের কৃষি উৎপাদন বাড়াতে উত্তরাঞ্চলের অতিরিক্ত জমি সেচের আওতায় আনা হবে। এর অংশ হিসেবে আগামী বছর দেড় লাখ হেক্টর জমি সেচের আওতায় আনা হবে। মন্ত্রী বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের সেচ চাহিদা মেটানোর মতো প্রয়োজনীয় পানি তিস্তায় নেই। তাই তিস্তা থেকে পশ্চিমবঙ্গের অতিরিক্ত পানির প্রয়োজন। নিজেদের চাহিদা না মিটিয়ে বাংলাদেশকে পানি দেব কীভাবে?’ এখন প্রশ্ন উঠেছে, পশ্চিমবঙ্গের এই মনোভাব পরিবর্তনের কোন ইঙ্গিত কি বাংলাদেশ বা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে দেয়া হয়েছে- যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ‘ফ্রেমওয়ার্ক’ তৈরির কথা বলছে?
শুভঙ্করের ফাঁকির কবলে বাংলাদেশ
ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিস্তা নদীর পানি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি হবার কথাবার্তা আবারো চাঙা হয়। এই কথিত ‘চুক্তি’ উদ্যোগের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই প্রশ্নগুলোর সমাধান ছাড়াই কোন চুক্তি হলে তা হবে এক বড় রকম শুভঙ্করের ফাঁকি। এসব প্রশ্নের মধ্যে আছে, তিস্তা নিয়ে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার কথা জোর দিয়ে বলা হয়ে থাকে তার মূল ড্রাফট কোথায়? চুক্তির খসড়ায় কী আছে- বাংলাদেশ কি তা জানে? তিস্তার দীর্ঘ প্রবাহজুড়ে বহুসংখ্যক সেচ ও বিদ্যুত প্রকল্প তৈরি অব্যাহত রেখেছে ভারত। এজন্য উজানেই পুরো নদী থেকেই পানি সরিয়ে নিচ্ছে তারা। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ কতোটুকু পানি পাবার যোগ্য হবে? যদি ৫০/৫০ ভিত্তিতে পানি ভাগ করার কথা বলা হয় তাহলে পানির হিসাব ধরা হবে নদীর মূল প্রবাহ থেকে নাকি গজলডোবা বাঁধের গোড়া থেকে- তাও নিশ্চিত নয়। এর ফলে বিশ্লেষকরা বিভ্রান্তিতে পড়েছেন এই নিয়ে যে, গঙ্গা চুক্তির মতো এই চুক্তির পরিণতি হতে যাচ্ছে কি- না। এই আশঙ্কায় জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কীসের ভিত্তিতে তিস্তা চুক্তির কথিত ফ্রেমওয়ার্ক হচ্ছে আর কতটুকু পানিই বা পাবে বাংলাদেশ?
উল্লেখ্য, এর আগে একদিকে চলেছে চুক্তির নামে একের পর এক প্রহসন। চুক্তি না হবার জন্য পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারের উপরেও দোষ চাপানো হয়েছে। অন্যদিকে ভারতীয় অংশে সেচ ও বিদ্যুতের জন্য অসংখ্য বাঁধ আর প্রকল্পের মাধ্যমে স্তব্ধ করে ফেলা হচ্ছে পানির প্রবাহ। এমনকি দীর্ঘ খাল খনন করে তিস্তার পানি মহানন্দা হয়ে ফারাক্কা পয়েন্টে নেয়ার প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে। এভাবে ভারত কার্যত পুরো নদী থেকেই পানি প্রত্যাহার করে চলেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় কৃষি ও পরিবেশের ক্ষেত্রে চরম সংকটে পড়েছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী সিকিমে তিস্তা নদীর উপর কয়েকটি বাঁধ ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে, আরো দশটি বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। এভাবে ৩৫টি প্রকল্পের পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের। সেখানকার সংবাদমাধ্যম, বিভিন্ন ওয়েবসাইটের তথ্য এবং ঢাকার একাধিক সূত্রে এই খবর জানা গেছে। পশ্চিমবঙ্গের সেচমন্ত্রী ইতোপূর্বে বলেছিলেন, এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সঙ্গে পানিবণ্টন নিয়ে ভাবা সম্ভব নয়। সেচমন্ত্রী আরো বলেছিলেন, তিস্তার ওপরে শুধুমাত্র কালিঝোড়ায় একটি পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের বিদ্যুৎ দফতর তাদের অনুমতি নিয়েছিল। কিন্তু তারপরে সিকিমে আরো দু’টি পানিবিদ্যূৎ কেন্দ্র তৈরি হয়েছে এবং একটির কাজ চলছে। ভবিষ্যতে আরো দশটি পানিবিদ্যুৎ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। এতে ভবিষ্যতে তিস্তায় বাংলাদেশ ন্যায্য হিস্যা তো দূরে থাক, আদৌ পানি পাবে কিনা সেটিই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের পানি সম্পদ মন্ত্রীর ‘ফ্রেমওয়ার্ক’ তৈরি কতোটা বাস্তবসম্মত তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েছেন বিশ্লেষকরা।
১৪টি বাঁধে আটকা তিস্তার পানিপ্রবাহ
ভারতের সিকিম থেকে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা পর্যন্ত অন্তত ১৪টি বাঁধে আটকা পড়ে থাকে তিস্তার পানিপ্রবাহ। ফলে গজলডোবা পয়েন্টে যথেষ্ট পানি জমা হতে পারে না। এরকম অবস্থায় যেনতেন প্রকারে একটা ‘তিস্তা চুক্তি’ হলেও তা কোন কাজেই দেবে না বাংলাদেশের। ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, ‘তিস্তায় তো পানিই নেই।’
তিস্তা নদী হিমালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে সিকিম এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে বাংলাদেশের যমুনা নদীতে এসে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিক নদী তিস্তার উপর শুধু সিকিমেই তৈরি হয়েছে ৫টি বৃহদাকার ড্যাম। এগুলো হলো, চুংথান্ড ড্যাম, টিনটেক ড্যাম, সেরওয়ানি ড্যাম, রিয়াং ড্যাম ও কালিঝোরা ড্যাম। এছাড়াও বর্তমানে চলমান প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে, লোয়ার লাগিয়াপ, রামমাম-২, রণজিৎ-৩, তিস্তা-৫ এবং রঙ্গিচু। এগুলো সবই পানি-বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এগুলোর জন্য অবশ্যই তিস্তার পানি প্রত্যাহার ও সংরক্ষণ করা প্রয়োজন হবে। সিকিমে আরও ৪টি এধরণের প্রকল্পের প্রস্তার সরকারের হাতে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে গজলডোবা ব্যারেজ ও তিস্তা-মহানন্দা সংযোগ খাল। তিস্তার একটি প্রকল্প ম্যাপ থেকে এমন ১৪টি স্থানে প্রকল্প চিহ্নিত দেখতে পাওয়া যায়। এসব প্রকল্পের কারণে উজান থেকে সিকিম হয়ে যথেষ্ট পরিমাণ পানি যেমন পশ্চিমবঙ্গে এসে পৌঁছায় না, তেমনি পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রবাহও গজলডোবায় আটকে যায়। আর তিস্তার পানি মহানন্দার ক্যানেল দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ কৃষি জমিতে সেচ দেয়া হয়। ফলে বাংলাদেশ কোন পরিমাণ পানির ভাগের জন্য অপেক্ষা করছে তা পরিস্কার নয়। কারণ এখন কেবলই গজলডোবা বাঁধ থেকে চুঁইয়ে নামা সামান্য পানি এবং বৃষ্টির অনিশ্চিত পরিমাণ পানির উপরেই বাংলাদেশকে ভরসা করতে হয়। এই অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গজলডোবা পয়েন্টের হিসেব আমলে নিয়ে বাংলাদেশকে সত্যি সত্যি পানির নায্য হিস্যা দিতে হলে এই ব্যারেজটিই ভেঙে ফেলতে হবে। তবেই পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি আশা করা যায়। আর পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রাপ্তির বিষয়টি তারা সিকিমের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিতে পারে। উজানে তিস্তার যে দীর্ঘ গতিপথ ভারতের সিকিমের ভেতরে এবং সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় প্রবাহিত হচ্ছে, সেখান থেকে ভারত যে পানি প্রত্যাহার করছে বা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র করছে, চুক্তি হলেও তাতেও ঝামেলা বাড়তে পারে আশঙ্কা রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে তিস্তা চুক্তির আওতায় আদৌ বাংলাদেশ এ নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা কখনো পাবে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান হওয়ার যথেষ্ট কারণ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
তিনগুন চাহিদা বাংলাদেশের
বহুল আলোচিত তিস্তা নদীর পানিতে পশ্চিমবঙ্গের যে চাহিদা তার তিনগুন চাহিদা হলো বাংলাদেশের। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির প্রস্তাবিত নদীগুলোতেও ভারতের বাঁধ বিদ্যমান রয়েছে। এসব নদীর পানির হিস্যার বিষয়টি যথারীতি বাংলাদেশের দাবীর তালিকায় রয়েছে। ফলে এসব নদীর পানি কখনোই তিস্তার বিকল্প হতে পারেনা বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞমহল।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, তিস্তায় পশ্চিমবঙ্গের ৩টি জেলার মাত্র ৯টি থানার ১০ থেকে ১২ হাজার বর্গকিলো মিটার অববাহিকা এলাকার ১০ লাখ লোক উপকৃত হয়ে থাকে। এগুলো হলো, দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং, শিলিগুড়ি, মেখলিগঞ্জ, জলপাইগুড়ি, ভক্তিনগর, ময়নাগুড়ি ও মাল থানা। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ অংশে ৮টি জেলার ২৫টি উপজেলার ২০ থেকে ২২ হাজার বর্গ কিলোমিটার অববাহিকা এলাকার প্রায় দেড় কোটি মানুষ সরাসরি উপকৃত হয়ে থাকে। এছাড়া বাংলাদেশে তিস্তা প্রকল্পের মতো বৃহদাকার সেচপ্রকল্পও রয়েছে সম্পূর্ণ তিস্তার পানির উপর নির্ভর করে। পানি না পেলে এই প্রকল্প ১০০ ভাগ মুখ থুবড়ে পড়বে।
কল্যাণ রুদ্রের রিপোর্ট
সম্প্রতি তিস্তার পানিবণ্টনকে কেন্দ্র করে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একটি রিপোর্ট পাঠিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। পশ্চিমবঙ্গের নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের নেতৃত্বে করা ওই রিপোর্টে তিস্তায় শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি থাকে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রাজ্য সরকারের পাঠানো ওই রিপোর্টে সিকিমে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ পরিদর্শন করার জন্য ভারতের পার্লামেন্টারি কমিটির প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানির ৬০ শতাংশ এ বাঁধগুলোয় আটকে যাচ্ছে। মাত্র ৪০ শতাংশ পানি পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে এসে পৌঁছায়। এতে বলা হয়, শুষ্ক মৌসুমে প্রতি সেকেন্ডে ১০০ কিউবিক মিটার পানি থাকে তিস্তায়। সে সময় পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সেচের পানির চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন প্রতি সেকেন্ডে ১ হাজার ৬০০ কিউবিক মিটার। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সেচ অধিদফতরের দাবি, তিস্তার পানি কমে যাওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের সেচের চাহিদা পুরোপুরি পূরণ করা যাচ্ছে না। এর থেকে বাংলাদেশকে পানির ভাগ দিতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে সেচের পানি মিলবে না। সেচ ছাড়াও তিস্তা থেকে উত্তরবঙ্গে দৈনিক পাঁচ কোটি লিটার পানীয় পানি সরবরাহ করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ সেচ দফতরের অভিযোগ, সিকিমে তিস্তার ওপর যে আটটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে সে বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে কিছু জানানোই হয়নি। উল্লেখ্য, এ মাসের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন। সফরে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হওয়ার আশা করা গেলেও তা শেষ পর্যন্ত হয়নি। এ প্রেক্ষাপটে তিস্তার পানির প্রবাহ যাচাই করতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের নেতৃত্বে একটি দল এ রিপোর্ট তৈরি করেন। এর আগেও কল্যাণ রুদ্র তিস্তা নিয়ে একই ধরণের রিপোর্ট করেছিলেন।
বিশেষজ্ঞ অভিমত

এই সঙ্গে বিশিষ্ট নদী গবেষক হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, তিস্তা নিয়ে পানি বণ্টন নয়- পানি ব্যবহার চুক্তি হতে হবে। অর্থাৎ এই নদীর পানি দুই দেশই নিজ নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করবে। তিন মনে করেন, সামগ্রিকভাবে অভিন্ন নদীর পানিপ্রবাহ একটা ‘প্যাকেজ ডিল’-এর আওতায় নিয়ে বাংলাদেশের প্রাপ্য দাবী করা যুক্তিসঙ্গত হতে পারে। মন্ত্রীর ফ্রেমওয়ার্ক-এর বিষয়ে তাঁর অভিমত, দু’টি কারণের যে কোন একটি হতে পারে- এক. ভারত যেনতেন একটি চুক্তি বাংলাদেশের হাতে ধরিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করতে চাচ্ছে। দুই. বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে স্বান্তনা দেয়ার জন্য মাঝেমধ্যে এধরণের কথা ছেড়ে দেয়ার কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ তিস্তা ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। সরকারের সুযোগ ছিলো এই ঐক্যকে কাজে লাগিয়ে ভারতের কাছ থেকে ন্যায্য হিস্যা আদায় করে নেয়ার। কিন্তু যেকোন কারণেই হোক সরকার তা হাতছাড়া করেছে।

http://www.dailysangram.com/post/288133-