১৫ জুন ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:১৯

পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প

১৩শ’ কোটি টাকা ব্যয়ের শ্বেতহস্তীর আধামরা অবস্থা

প্রায় একশ’ কিমি সেচ ক্যানেল বন্ধ বা পরিত্যক্ত * আবাদি জমির পরিমাণ কমে এক হাজার হেক্টরে নেমেছে * অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে প্রকল্প প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যই ভেস্তে যেতে বসেছে

অধিক উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে নব্বই দশকের শুরুতে ১৩শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত ‘পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প’ এখন অন্তঃসারশূন্য একটি আধামরা প্রকল্পে পরিণত হয়েছে। অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে প্রকল্প প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যই ভেস্তে যেতে বসেছে। পাবনা, সিরাজগঞ্জ এবং নাটোর জেলার ১২ উপজেলার ১ লাখ ৯৪ হাজার হেক্টর কৃষি জমি এর আওতায় এনে প্রথম পর্যায়ে ১৮ হাজার ৬৮০ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে প্রকল্পের যাত্রা শুরু হলেও সেচ সুবিধাপ্রাপ্ত জমির পরিমাণ কমে এখন মাত্র এক হাজার হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। সেচ প্রকল্পের কৃষি জমিতে অবাধে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করায়ও আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এছাড়া ২১২ কিমি শাখা ক্যানেলের প্রায় একশ’ কিমি ক্যানেল ত্রুটিপূর্ণ কাজের জন্য পরিত্যক্ত বা বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। অথচ সেচ ক্যানেল সংস্কারের নামে পাউবো প্রতি বছরই লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে থাকে। গত বছর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বরাদ্দ ছিল ৮০ লাখ এবং এ বছরে পাওয়া গেছে ৬০ লাখ টাকা। সংশ্লিষ্ট পাউবো কর্মকর্তারা যথাযথভাবে সংস্কারের জন্য প্রাপ্ত অর্থ অপ্রতুল বলে দাবি করলেও অভিযোগ রয়েছে, সংস্কারের জন্য প্রাপ্ত অর্থের অধিকাংশই লুটপাট হয়। এ জন্য দিন দিন সেচ সুবিধাপ্রাপ্ত জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি কমছে উৎপাদন।


সূত্র জানায়, ১৯৮০ সালের দিকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ পরিচালনা এবং পানি নিষ্কাশনের মাধ্যমে উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে জমি অধিগ্রহণ শুরু হয় এবং ১৯৯২ সাল থেকে ‘পাবনা সেচ ও পলী উন্নয়ন প্রকল্প’ আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। প্রথম পর্যায়ে ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে পাবনার ৯ উপজেলা, সিরাজগঞ্জের ১টি এবং নাটোরের ২টিসহ ১২টি উপজেলার ১ লাখ ৯৪ হাজার হেক্টর কৃষি জমি এর আওতায় আনা হয়। এ সময় সেচ কাজ পরিচালনার জন্য ‘বেড়া পাম্প স্টেশন’ এবং পানি নিষ্কাশনের জন্য নির্মাণ করা হয় ‘কৈটোলা পাম্প স্টেশন’। প্রথম পর্যায়ে ১৮ হাজার ৬৮০ হেক্টর জমিতে সেচ বাস্তবায়নের কথা থাকলেও মাত্র ৫ থেকে ৬ হাজার হেক্টর জমি সেচ সুবিধা পেয়েছে এবং এখন তা মাত্র এক হাজার হেক্টরে নেমে এসেছে। অথচ ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে ২০০ কোটি টাকার ক্যাপ প্রকল্পসহ সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। এ নিয়ে এ যাবত রক্ষণাবেক্ষণ এবং অন্যান্য খাতে প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে আরও প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে কৃষকদের ভাগ্যের উন্নয়ন না হলেও আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন পাউবোর প্রকৌশলী, কর্মকর্তা এবং ঠিকাদাররা। স্থানীয় জনসাধারণ জানায়, নির্মাণের পর থেকে দীর্ঘদিন ধরে কৈটোলা পাম্প স্টেশনের পাল্লা সংস্কার ও মেরামত না করায় এর অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। অথচ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে কোটি কোটি টাকা।

পাউবো সূত্র জানায়, পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পে গত বছর বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল দুই হাজার হেক্টর জমিতে। আবাদ হয়েছিল ৮০০ হেক্টরে। গত মৌসুমে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল মাত্র এক হাজার ৩৫০ হেক্টর। এবার সেচ সুবিধা পেয়েছে মাত্র এক হাজার হেক্টর জমি। আর এর জন্য খরচ দেখানো হয়েছে ৬০ লাখ টাকা।

সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, সেচ প্রকল্পের বিভিন্ন এলাকার কৃষি জমিতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বাড়িঘর। জমির ওপর গড়ে ওঠা এসব বাড়ির আশপাশের জমিগুলোতেও রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, ১০-১৫ বছর আগেও সেচ প্রকল্পের আওতাভুক্ত বেড়া পৌর এলাকার আল-হেরানগরের প্রায় পুরো অংশেই ফসলের আবাদ হতো। অথচ এখন এ এলাকায় কোনো কৃষি জমি নেই। সেখানে অসংখ্য পাকা ভবন, রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিসসহ নানা স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যে এলাকাটি সেচ প্রকল্প থেকে আবাসিক এলাকায় রূপান্তরিত হয়েছে। সচল ক্যানেলগুলো যথাযথভাবে সংস্কার না করায় অকার্যকর হয়ে পড়ছে। বেড়ার হাটুরিয়া, জগন্নাথপুর, পেঁচাকোলা, সাঁথিয়ার বায়া, পানশাইল, রসুলপুর, ঘুঘুদহসহ অনেক এলাকায় সেচ ক্যানেল মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। অনেকে ক্যানেল ভরাট করে দোকানঘর তুলেছে। এ ব্যাপারে বেড়া পানি উন্নয়ন বিভাগ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। প্রকল্পের ক্যানেল সংস্কার কাজেও বিভিন্ন সময়ে উঠেছে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রকল্প শুরু থেকেই বরাদ্দ অর্থের প্রায় ৭০ ভাগই লোক দেখানো নামমাত্র কাজ করে আত্মসাৎ করা হয়েছে।

পাউবোর পানি ব্যবস্থাপনাকারী অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সেক্রেটারি মকবুল হোসেন জানান, আগে একটি অ্যাসোসিয়েশন এবং একটি ফেডারেশন ছিল। ওই সময় আমরা জানতে পারতাম কত বরাদ্দ হল এবং কিভাবে খরচ হচ্ছে। ৫/৭ বছর হল এগুলো ভেঙে দেয়া হয়েছে। তাই এখন এ বিষয়ে জানার উপায় নেই। তিনি বলেন, আমাদের জানা মতে প্রতি বছর যে বরাদ্দ আসে তার সামান্যই সেচ কাজে ব্যয় করা হয়। আর এ কারণেই অনেক সেচ ক্যানেল পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে।

প্রকল্পের বেড়া উপজেলার মোহনগঞ্জ, হরিরামপুর, কৈটোলা, নতুন পেঁচাকোল, মাছখালি, সাঁথিয়া উপজেলার গাগড়াখালী, বায়া, পানশাইল, রসুলপুর, ঘুঘুদহ, ছেচানিয়া, সানিলা, বড়গ্রাম, বোয়াইলমাড়ি, চাঁদপুরসহ অন্তত ৪০টি গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২৪ বছর ধরে তারা প্রকল্পের সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাই বাধ্য হয়ে অনেকেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে প্রকল্প এলাকার মধ্যে অগভীর নলকুপ বসিয়ে ব্যয়বহুল সেচ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। পানি ব্যবহারকারী সমিতির সভাপতি আনছার আলী জানান, প্রকল্পের সেচ সুবিধাভোগী চাষীদের তিনটি ফসল আবাদের জন্য বিঘাপ্রতি বছরে মাত্র ১৮০ টাকা সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। অথচ সেচ সুবিধা বঞ্চিত কৃষকদের নিজ উদ্যোগে সেচযন্ত্র স্থাপন করে জমিতে সেচ দিতে হয়। এতে শুধুমাত্র বোরো ধান উৎপাদনের জন্য কৃষকদের সেচ বাবদ চার হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়। এভাবে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এছাড়া প্রকল্পটির অন্যতম উদ্দেশ্য জলাবদ্ধতা দূরীকরণ হলেও ত্রুটিপূর্ণ কাজের জন্য সাঁথিয়া, সুজানগর ও বেড়া উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমি জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছে। চাষীরা জানান, নামমাত্র সংস্কার কাজ করেই ক্যানেলে পানি ছেড়ে দেয়া হয়। ফলে প্রতিবছরই সেচ ক্যানেলের ডাইক ভেঙে আশপাশের ফসলি জমি প্লাবিত হয়।

জানতে চাইলে বেড়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবদুল হামিদ জানান, আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন পাবনা সেচ প্রকল্প পুরোদমে চালু করার জন্য পরিকল্পিত ভাবে সেচ ও নিষ্কাশন ক্যানেলসহ অন্যান্য অবকাঠামোর উন্নয়ন ও সংস্কার জরুরি। এজন্য গত বছর এবং এ বছরে কমপক্ষে ২৪/২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়। কিন্ত গত বছরে পাওয়া গেছে ৮০ লাখ এবং এ বছর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মাত্র ৬০ লাখ টাকা। এ কারণেই সংস্কার ও উন্নয়ন কাজ ঠিকমতো হচ্ছে না।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/06/15/132670/