১৫ জুন ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:১৮

পাহাড়ধসে পাঁচ জেলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৪০

সবুজ রাঙামাটি এখন ধ্বংসস্তূপ

আরও একটি লাশ উদ্ধার। এই ছবিই বলে দিচ্ছে পাহাড়ধসের পর রাঙামাটির সবুজ জনপদের অবস্থা এখন কেমন। উদ্ধার তৎপরতায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন পাহাড়ি ও বাঙালিরা। ছবিটি রাঙামাটি শহরের রাঙাপানি এলাকা থেকে গতকাল সকালে তোলা l সুপ্রিয় চাকমা

অতিবৃষ্টির সঙ্গে পাহাড়ধস ও পাহাড়ি ঢলে ছিন্নভিন্ন রাঙামাটির সবুজ জনপদ। পথে পথে ভেঙে পড়ে আছে গাছপালা, বিদ্যুতের খুঁটি। শহরের প্রধান সড়ক থেকে অলিগলির রাস্তায় কেবল ধ্বংসস্তূপ। জমে আছে পাহাড়ধসের ধূসর মাটি। নিচে চাপা পড়েছে জীবন ও সম্পদ। ছোট ছোট ঢিবির মতো রূপ নেওয়া এই মাটি সরিয়ে বের করে আনা হচ্ছে নারী-পুরুষ ও শিশুর প্রাণহীন দেহ। লাশ উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে চলছে স্বজনদের আহাজারি, আর্তনাদ। প্রকৃতির এমন প্রাণঘাতী আচরণ এর আগে কখনো দেখেনি রাঙামাটির মানুষ।
পাহাড়ধসে রাঙামাটির সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ দুদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে রাঙামাটি আসার জন্য মূল সড়কের বাইরেও দুটি বিকল্প সড়ক রয়েছে। কিন্তু তিনটি সড়কই পাহাড় ধসের কারণে বন্ধ। গত মঙ্গলবার ভোর থেকে গতকাল বেলা ১১টা পর্যন্ত জেলার অন্তত ৩০টি স্থানে পাহাড়ধসের খবর পাওয়া গেছে। এই ৩০টি স্থানের বাইরে আরও জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অসংখ্য পাহাড় ধসের ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। দুর্গম যোগাযোগব্যবস্থা ও বিরূপ আবহাওয়ার কারণে ক্ষয়ক্ষতির পুরো চিত্র এখনো পাওয়া যাচ্ছে না।
গতকাল রাঙামাটি থেকে আরও ১২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত এ জেলায় পাহাড়ধসে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০৫। বান্দরবান ও চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থেকে উদ্ধার হয়েছে আরও তিনজনের লাশ। মঙ্গলবার রাতে নতুন করে পাহাড়ধসে কক্সবাজারের টেকনাফে দুজন, খাগড়াছড়িতে একজন ও চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলায় আরও একজন মারা গেছেন। সব মিলিয়ে তিন পার্বত্য জেলা এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় পাহাড়ধসে মারা গেছেন ১৪০ জন। সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

মা–বোন হারিয়ে বাক্রুদ্ধ ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী লতিফা চাকমা। ছবিটি রাঙামাটি শহরতলির তিনামনিঘোনা এলাকা থেকে গতকাল সকালে তোলা

রাঙামাটি ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ধ্বংসের ভয়াবহতা এতটাই ব্যাপক যে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর সক্ষমতা স্থানীয় প্রশাসনের নেই। চট্টগ্রাম থেকে আসা ফায়ার সার্ভিসের ৬০ জনের উদ্ধারকারী একটি দল গতকাল থেকে কাজ শুরু করেছে।
কাল দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত রাঙামাটি শহরের ভেদভেদী, যুব উন্নয়ন পাড়া ও মানিকছড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, কোথাও কোথাও ঘরবাড়ি দুমড়েমুচড়ে গিয়ে পড়েছে অন্তত ২০০ গজ দূরে। ধ্বংসস্তূপ দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে একসময় বসতি ছিল। রাস্তা ও অলিগলি ধসে গিয়ে মিশেছে বাড়িঘরের সঙ্গে। থমকে গেছে পুরো শহরের জনজীবন। যানবাহন বলতে শহরে কেবল সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলছে।
গতকাল বেলা একটার দিকে শহরের ভেদভেদী এলাকার পশ্চিম মুসলিম পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় বাসিন্দারা ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া স্বজনদের উদ্ধারে ব্যস্ত। বাবা খুঁজছেন সন্তানের লাশ, স্বামী খুঁজছেন স্ত্রীর লাশ, ভাই খোঁজে বোনের লাশ, বড় ভাই খুঁজছেন ছোট ভাইয়ের লাশ। মুসলিম পাড়ায় দুপুরে আলমগীর হোসেন (২৭) নামের একজনের লাশ উদ্ধারের পর কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর ভাই মোস্তফা হোসেন। এর আগে মঙ্গলবার তাঁর বাবার লাশ পাওয়া গেছে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত নিখোঁজ ছিলেন তাঁর ভাই ও বোন।
রাঙামাটির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) প্রকাশ কান্তি চৌধুরী বলেন, ঘটনাটি মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আহত রয়েছে অনেক। এলাকায় বিদ্যুৎ নেই, সড়ক যোগাযোগও বন্ধ। জেলা প্রশাসন মানুষের পাশে রয়েছে।
রাঙামাটি শহরের ভেদভেদী এলাকায় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া দুর্গত মানুষ
গতকাল সকালে চট্টগ্রাম থেকে রাঙামাটিতে পৌঁছাতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় ফায়ার সার্ভিসের ৬০ জনের উদ্ধারকারী দলকে। ফায়ার সার্ভিসের বহরটি প্রথমে চট্টগ্রামের হাটহাজারী হয়ে রাঙামাটি আসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। বিকল্প পথে গিয়েও (কাপ্তাই সড়ক হয়ে) লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত কাপ্তাই থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে রাঙামাটিতে পৌঁছান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এই প্রতিবেদকও তাঁদের সঙ্গে ছিলেন।
নৌকায় ওঠার পর চোখে পড়ে হ্রদের দুই পাশের পাহাড়েও মঙ্গলবারের ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। স্থানে স্থানে ধসে গেছে সবুজ পাহাড়। গাছপালা, ঘরবাড়ি লন্ডভন্ড। নৌকাটি শহরের যত কাছাকাছি এগোচ্ছিল, ধ্বংসের চিহ্নও তত বেশি চোখে পড়ছিল। শহরের রিজার্ভ বাজারের একপাশে কয়েকটি টিনের দোকান গাছপালাসহ হ্রদের ওপরের পাহাড়ের গায়ে লেপ্টে ছিল। ডিসি বাংলোর রাস্তার একটি অংশ ধসে পড়ে গেছে হ্রদে।
চট্টগ্রাম থেকে উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেওয়া ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, কল্পনার চেয়েও বেশি ধ্বংসস্তূপ দেখা গেছে রাঙামাটিতে। প্রশাসনকে উদ্ধারকাজে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে ফায়ার সার্ভিস।
প্রকৃতির এমন বিধ্বংসী আচরণের সঙ্গে পরিচিত নন রাঙামাটির প্রবীণ বাসিন্দারাও। হিটলার চাকমা নামের এক বৃদ্ধ এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না এই বিপর্যয়ের ঘটনা। তিনি বলেন, ‘রোববার রাত থেকে অবিরাম বৃষ্টি পড়েছে। সেই বৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে মঙ্গলবার সকালে এসে ধসে পড়েছে পাহাড়। এমন দুঃখের ঘটনা আমি এই বয়সে দেখিনি।’
মিনু চাকমা নামের আরেক বৃদ্ধা বলেন, ’৯১-এর ঘূর্ণিঝড়েও রাঙামাটিতে এমন ক্ষতি হয়নি।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের উদ্ধার তৎপরতায় পাহাড়ি-বাঙালি ভেদাভেদ ছিল না। দুই সপ্তাহ আগেও রাঙামাটির লংগদু উপজেলায় পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা গেলেও এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় সবাইকে এক করে দিয়েছে। পাহাড়ি-বাঙালি একে অন্যের জন্য কাঁদছেন। একসঙ্গে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন। বাঙালি-অধ্যুষিত ভেদভেদী পশ্চিম মুসলিম পাড়ায় উদ্ধারকাজে যোগ দেন পাহাড়িরা। তেমনি শহরের যুব উন্নয়ন পাড়ায় মাটিচাপা পড়া পাহাড়িদের উদ্ধারেও তৎপর ছিলেন স্থানীয় বাঙালিরা।
যুব উন্নয়ন পাড়ায় মধুমিতা চাকমাকে উদ্ধারে সাহায্য করেন ডালিম বড়ুয়াসহ কয়েকজন বাঙালি। ডালিম বলেন, এখানে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, চাকমা—সবাই মিলেমিশে পরস্পরের সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়েছেন।
এই বিপর্যয় কীভাবে সামাল দেওয়া হবে তা নিয়ে শহরের রাস্তাঘাট, দোকানপাট, অলিগলি, বাজার—সব খানেই চলছে আলোচনা। স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু হারানোর ব্যথায় কাতর এখন পাহাড়ি ও বাঙালিরা।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1218376/