১৩ জুন ২০১৭, মঙ্গলবার, ১২:৪২

পানি আর যানজটে বিপর্যস্ত রাজধানী

 লঘুচাপের দাপটে ‘আষাঢ়ে বর্ষণ’ হচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে। এর প্রভাবে দেশজুড়ে জনজীবনে ব্যাপক ছন্দপতন ঘটেছে। প্রাক্বর্ষার এ বর্ষণে মনে হচ্ছে আকাশ ফুটো হয়ে গেছে। গত রোববার রাত থেকেই টানা বৃষ্টিতে ডুবে গেছে রাজধানীর অনেক এলাকা। যার ফলে সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ যানজটের। এতে গতকাল সোমবার সকাল থেকেই চরম দুর্ভোগে পড়েছেন নগরবাসি।
এদিকে ঝড়ো হাওয়ার শঙ্কায়, সমুদ্র বন্দরগুলোতে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত জারি করেছে আবহাওয়া অফিস। অন্যদিকে লঘুচাপজনিত জলোচ্ছ্বাসে কক্কবাজোরের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে কুতুবদিয়া। চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় শহরগুলোতেও পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রবল বর্ষণে পাহাড় ধসে রাঙামাটিতে ২ শিশু মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে নোয়াখালীর হাতিয়া ও পাটুরিয়া দৌলতদিয়ায় বন্ধ রাখা হয়েছে নৌ-চলাচল। ঝড়ো হাওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে সিমেন্টের কাঁচামালবাহী দুইটি লাইটারেজ ডুবে যায়।
গতকাল সন্ধ্যা ৬ টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘন্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় সৃষ্ট সুস্পষ্ট লঘুচাপটি উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় ঘনীভূত হয়ে নিম্নচাপে পরিনত হয়েছিল। এটি ক্রমশঃ আরও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে কুমিল্লা ও তৎসংলগ্ন এলাকায় স্থল নিম্নচাপরুপে অবস্থান করছে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালার সৃষ্টি অব্যহত রয়েছে এবং বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করছে। দক্ষিণ-পশ্চিম মওসুমি বায়ু বাংলাদেশের উপর বিস্তার লাভ করেছে। ঢাকা, ময়মনসিংহ, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ী দম্কা/ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা প্রায় (১-৪) ডিগ্রি সে. বৃদ্ধি পেতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় (১-৩) ডিগ্রি সে. হ্রাস পেতে পারে।
এর আগে সকাল ৯টায় আবহাওয়া অধিদফতরের এক বুলেটিনে জানানো হয়, ভোলা ও তৎসংলঘœ এলাকায় অবস্থানরত স্থল নিম্নচাপের প্রভাবে খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। অতি ভারী বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের পাহাড়ী এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধ্বসের আশংকার কথাও জানায় তারা।
গতকাল সারাদিন রাজধানী ছিল বৃষ্টিমুখর। অফিসে যাতায়াত ও ঈদ কেনাকাটায় বাগড়া ঘটায় জ্যৈষ্ঠের শেষ সময়ের বিরামহীন বারিপাত। নাগরিকরা অনেকেই বলাবলি করছেন, আকাশ মনে হচ্ছে ফুটো হয়ে গেছে। তাই এতো বৃষ্টিপাত। ‘আষাঢ়ে বর্ষণের’ মতো থামার যেন কোন লক্ষণ দেখছেন না নগরবাসি। আবহাওয়া অফিসও ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকার আভাস দিয়েছেন।
গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী চব্বিশ ঘন্টায় দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে চ্ট্টগ্রামে ১৯০ মিলিমিটার। বাণিজ্যিক নগরী আরেক দফা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এছাড়া টাঙ্গাইলে ৫৩ মিলিমিটার, ফরিদপুর ৫৬, মাদারীপুর ১০১, গোপালগঞ্জ ৬৩, ময়মনসিংহ ৯২, নেত্রকোনা ১০১, সন্দ্বীপ ৯৬, সীতাকুন্ড ১১৬, রাঙ্গামাটি ১৬৫, কুমিল্লা ৬৫, চাঁদপুর ১২০, মাইজদীকোর্ট ৮৮, ফেনী ৮৭, হাতিয়া ৫০, কক্সবাজার ১০৪, কুতুবদিয়া ১৩৪, সিলেট ৩৫, শ্রীমঙ্গল ৭৬, রাজশাহী ৫, ঈশ্বরদী ৪, বগুড়া ২৫, বদলগাছী ৭, তাড়াশ ২৩, রংপুর ৫, দিনাজপুর ২, ডিমলা ১, রাজারহাট ১২, খুলনা ৩৪, মংলা ৭১, সাতক্ষীরা ৪৬, যশোর ২৬, চুয়াডাঙ্গা ২, কুমারখালী ৩৪, বরিশাল ৭৯, পটুয়াখালী ৩৭, খেপুপাড়া ৫৫ ও ভোলায় গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আগের চব্বিশ ঘন্টায় ৫৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
আর গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘন্টায় ঢাকায় ১৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া বিভাগ। এর মধ্যে গতকাল সকাল ৬টা থেকে পরবর্তী ১২ ঘন্টায়ই হয়েছে ১০৩ মিলিমিটার। বৃষ্টিরতে রাজধানীর অনেক স্থানে কোমড় পানি পর্যন্ত জমে যায়। পানিবিড়ম্বনার সাথে যানজট নগরজীবনকে আরো বিষিয়ে তোলে। অনেক রোযাদার মুসুল্লীকে যানজটে পড়ে রাস্তাতেই ইফতার করতে হয়েছে। বৈরী আবহাওয়ায় কর্মজীবী মানুষকেও পড়তে হয়েছে বিপদে।
কখনো দমকা হাওয়া, কখনো ইল্শে গুড়ি। রাত থেকেই বৃষ্টি। পানিবদ্ধ শহরের অনেক জায়গা। বিভিন্ন জায়গায় উন্নয়ন কাজের প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় খোঁড়াখুড়ির সাথে বর্ষার আগমনী বৃষ্টি মিলে ভোগান্তি বাড়িয়েছে অনেকখানি। সকালে অফিসগামী মানুষ বিপাকে পড়েছেন সবচেয়ে বেশি। কোথাও যানবাহন ছিলো কম, আবার কোথাও বা যানজট। সকালে লাগা যানজট রাত পর্যন্ত নগরবাসীকে ভুগিয়েছে। সময় নিয়ে গন্তব্যে রওয়ানা দিলেও ঠিক সময় পৌঁছানো যায়নি না বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। অফিস ফেরত অনেকেই ইফতার করেছেন রাস্তায়।
গুলিস্তান থেকে ফার্মগেইট পৌঁছাতে দুই ঘণ্টা পার বেসরকারি চাকরিজীবী মো. সেলিমের। তিনি বলেন, সকাল ৮টার দিকে বাসে উঠি, কিন্তু ঠিক সময় অফিসের পৌঁছতে পারলাম না। পুরো পথে যানজটে পড়ে কাওরান বাজার চৌরাস্তার মোড়ের সিগনাল পার হতে সবচেয়ে বেশি সময় লেগেছে।
বৃষ্টিতে ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের সামনের রাস্তায় পানি জমার কারণে এই পথের যানজটের বলে জানান শাহবাগে দায়িত্বরত সার্জেন্ট মশিউর রহমান। সকালে তিনি বলেন, রাস্তায় পানির কারণে আউট গোয়িংয়ে (বহির্গমন) বাজে অবস্থা। এভাবে চলতে থাকলে বিকালে যানজট আরো তীব্র হতে পারে।
টানা বর্ষণে শান্তিনগর, হোটেল রূপসি বাংলার মোড়, মগবাজার ও মৌচাকের রাস্তায়ও যানজট তৈরি হয়েছে বলে জানান রমনা বিভাগের পুলিশের সিনিয়র সহকারি কমিশনার (ট্রাফিক) মো. আলাউদ্দিন। তিনি বলেন, মগবাজার থেকে তেজগাঁও এলাকার দিকে গাড়ি ধীর গতিতে যাচ্ছে; কিন্তু তেজগাঁও থেকে গাড়ি প্রায় স্বাভাবিকভাবে গুলিস্তানের দিকে আসছে।
রামপুরা থেকে গুলিস্তান আসতে অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি সময় লেগেছে বলে জানিয়ে সাইদুর রহমান জিদনি নামে এক ব্যক্তি বলেন, মৌচাক বাজারে অনেক দোকানেই পানি উঠতে দেখেছেন তিনি। রামপুরা সড়কে পানি তেমন না জমলেও অর্ধেক কেটে ফেলে রাখায় নিত্য তীব্র যানজট লাগে বলে জানায় ভূক্তভোগীরা।
গুলিস্তান থেকে গাবতলী মুখী সড়কেও ধীরগতিতে চলছে যানবাহন। আর উত্তরা থেকে মহাখালী রাস্তার প্রায় পুরোটাই যানজটের কবলে পড়েছে। এপথে কাওলা থেকে খিলক্ষেত পযর্ন্ত রাস্তায় পানি জমে গাড়ি চলছে ধীরগতিতে।
পুলিশ পরিদর্শক (ট্রাফিক) মো. সালাউদ্দিন বলেন, সেতু ভবনের সামনে, আর্মি স্টেডিয়ামের সামনে ও কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবের সামনের রাস্তায় পানি থাকায় মহাখালীর দিকে গাড়ি ধীর গতিতে আসছে। তবে এ রাস্তার উল্টোদিকে মহাখালী থেকে কাকলী মোড় পর্যন্ত কিছুটা যানজট থাকলেও এরপর উত্তরার দিকে গাড়ি যেতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না বলে এই ট্রাফিক পরিদর্শক।
উত্তর বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্র বন্দরসমূহের উপর দিয়ে দমকা/ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ার আভাস দিয়ে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দর সমূহকে ৩ নম্বর পুনঃ ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অফিস। একই সাথে উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার সমূহকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
দেশের অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর সমূহের জন্য আবহাওয়ার পূবার্ভাসে বলা হয়েছে, পাবনা, বগুড়া, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, ঢাকা, ফরিদপুর, মাদারীপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালি, নোয়াখালি, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং সিলেট অঞ্চলসমূহের উপর দিয়ে দক্ষিণ/দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে ঘন্টায় ৬০-৮০ কিলোমিটার বেগে বৃষ্টি/বজ্রবৃষ্টিসহ অস্থায়ীভাবে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এসব এলাকার নদীবন্দর সমূহকে ২ নম্বর নৌ হুশিয়ারী সংকেত (পুনঃ) ২ নম্বর নৌ হুশিয়ারী সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। এছাড়া দেশের অন্যত্র দক্ষিণ/দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে ঘন্টায় ৪৫-৬০ কিলোমিটার বেগে বৃষ্টি/বজ্রবৃষ্টিসহ অস্থায়ীভাবে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এসব এলাকার নদীবন্দর সমূহকে ১ নম্বর (পুনঃ) ১ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
এদিকে কৃষি আবহাওয়ার সাপ্তাহিক পূর্বাভাসে গত ৮ জুন বলা হয়েছিল, চলতি সপ্তাহে দৈনিক উজ্জ্বল সূর্য কিরণ কাল ৪.৭৫ থেকে ৬.২৫ ঘন্টার মধ্যে থাকতে পারে। বাষ্পীভবনের দৈনিক গড় ৩.৭৫ মি. মি. থেকে ৫.০০ মি. মি. থাকতে পারে। লঘুচাপের কারণে দক্ষিণ-পশ্চিম মওসুমি বায়ুর প্রভাবে চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের অধিকাংশ স্থানে এবং দেশের অন্যত্র অনেক স্থানে হাল্কা (৪-১০ মি.মি.) থেকে মাঝারী (১১-২২ মি.মি.) ধরণের বৃষ্টি/বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে মাঝারী ধরনের ভারী (২৩-৪৩ মি.মি.) বৃষ্টিপাতসহ দমকা/ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। পরবর্তী সপ্তাহে বৃষ্টিপাতের পরিমান বৃদ্ধি পেতে পারে। এ সময়ে সারাদেশের দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে।

http://www.dailysangram.com/post/287831-