১৩ জুন ২০১৭, মঙ্গলবার, ১২:৩১

মেগা বাজেটে অর্থহীন চমক

|| হারুন-আর-রশিদ ||

অর্থমন্ত্রীর স্বপ্নের বাজেট ২০১৭-১৮। ১ জুন ২০১৭ সালে অর্থমন্ত্রী মহাখুশি বাজেট ঘোষণা করে। তার জীবনকালের এটা নাকি সেরা বাজেট। বাস্তবতা কী বলছেÑ সে দিকে এবার দৃষ্টি দেয়া যাক। দেশে আয় নেই, অথচ রেকর্ড চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। বিগত ১০ বছর যাবৎ রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা কখনো অর্জিত হয়নি। এবার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য দুই লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি এক লাখ ১২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। প্রতি বছরই অর্থমন্ত্রীর ঘোষিত বাজেটে ঘাটতির অঙ্ক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। হয়তো ভাবখানা এমনÑ অসুবিধা নেই, জনগণ তো আছে। তাদের আমানত থেকে এ টাকা নেয়া যাবে। ‘পকেট কাটা’র এ বিশাল অঙ্কের বাজেট জনগণকে স্বস্তি তো দেবে না, উল্টো তাদের মারাত্মক দুর্ভোগ ও বিড়ম্বনা শুরু হবে ১ জুলাই থেকে। চালাকি জানলেও অর্থমন্ত্রী শেয়ার বাজার বোঝেন না, বোঝেন না চার হাজার কোটি টাকার লোকসানের সারমর্ম! অর্থমন্ত্রীর কাছে ব্যাংকের লুটপাট তেমন কোনো ব্যাপার নয়। কিছু দিন আগে আমার এক বন্ধু যিনি বর্তমানে একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, তার মুখেই শুনলাম এ মন্ত্রীর ব্যর্থতার নানা দিক। সে বলল, বেশি দিন নেই ইসলামী ব্যাংক পাঁচটি সরকারি ব্যাংকের মতো অবস্থায় পড়বে। মানুষের টাকা উত্তোলনের দৃশ্য দেখলে এবং পুঁজি বাজারের পতন এসব দৃশ্যই বলে দেয়, কী ঘটতে যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী জনগণকে থোড়াই কেয়ার করেনÑ যার কারণে জনগণের আমানতের ওপর যত রকম বিপদ আছে, সবগুলোই তিনি এবার ধার্য করেছেন। আবগারি শুল্ক দ্বিগুণ এমনিতেই করেছেন। তিন-চার ধরনের সার্ভিস চার্জ প্রতি বছর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আমানতকারীদের জমা টাকা থেকে কর্তন করে। একটি ব্যাংক স্টেটমেন্ট নেবেন, তার জন্যও বছরে ৫০০ এর অধিক টাকা কর্তন করা হবে। চেকবই নেবেন তার জন্য আবার ৫০ টাকা দিতে হবে। চেকবইয়ের মূল্য বর্তমান বাজেটে বাড়ানো হয়েছে। দেশের একজন ক্ষেতমজুর বা রিকশাওয়ালাকেও ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। ১৫ শতাংশ ভ্যাট থেকে ১৬ কোটি মানুষের কারো মুক্তি পাওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি এবারের বাজেটে। মন্ত্রী মহোদয়, সরকার ২০০৮ সালে যখন ক্ষমতায় এলো তখন প্রতিটি পণ্যের বাজারমূল্য হিসাব করলে আজকের বাজারমূল্য প্রায় পাঁচ থেকে ছয় গুণ বেড়েছে। ছয় টাকার আলু এখন ৩০ টাকা। চাল প্রতি কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে। একটি উদাহরণ নিয়ে ভাবলে যেকোনো সচেতন মানুষ বুঝতে পারবেন, কী হারে সাধারণ মানুষের পকেট কাটছে সরকার। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষগুলো বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ সেটা কথায় নয়, প্রতি বছরের বাজেটে তা অঙ্ক কষে বুঝিয়ে দিচ্ছে। সংসার চালাতে হলে পকেট কাটার বাজেটে পকেট ভর্তি করার বিকল্প পথ সরকারই জনগণকে শিখিয়ে দিচ্ছে। বিগত ১০ বছরে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের বেহাল দশা জনগণ দেখেছে। দুই-একটি ফাইওভার নির্মাণ উন্নয়নের মেগা প্রকল্পে পড়ে না। ইট-পাথরের বিশাল বিশাল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, আর হয়েছে শপিংমল যাতে ভারতীয় বা চীনের পণ্যসামগ্রী দিয়ে এগুলো সাজানো যায়। ঢাকার পরিবেশবিনাশী ‘ইট-পাথরের বস্তি’তে ঢাকা শহরটাকে ঢেকে ফেলা হয়েছে। উৎপাদনশীল খাতে সরকার যতটা না অর্থ ব্যয়ের সুযোগ রাখছে, তার কয়েকগুণ বেশি অর্থ ব্যয়ের সুযোগ থাকছে অনুৎপাদনশীল খাতে। নগরের পার্ক উন্মুক্ত নয়Ñ ইট-পাথর সেখানে আসন গেড়েছে।
বিশাল অঙ্কের বাজেট ঘোষণা করে সরকার বোঝাতে চাচ্ছে, ‘দেশ এগোচ্ছে, বড় হচ্ছে অর্থনীতি।’ যদি তা-ই হয়, তাহলে মানুষ স্রোতের মতো ঢাকায় ভিড় করছে কেন। গ্রাম-উপজেলায় মানুষ কর্ম খুঁজে পাচ্ছে না কেন? জনগণকে প্রশ্ন করলে জবাব একটাই, ক্ষেতে যা ফসল হয় তা দিয়ে সংসার চলে না। উপজেলায় সরকার কয়টা ভারী শিল্প স্থাপন করেছেÑ তার একটি হিসাব অর্থমন্ত্রীর কাছে জনগণ জানতে চায়। ‘এটা আমার সেরা বাজেট’ এ কথা বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর দেয়া যায়, কিন্তু জনগণ তাদের ব্যাপারে কী ধারণা পোষণ করে সেটা একবার অনুসন্ধান করুন। একজন উঁচু মাপের ব্যাংকার আমাকে বললেন, অর্থমন্ত্রীর বই এখন ব্যাংকের সেলফে থাকতে হবে। মতিঝিল অফিসপাড়ার ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা বলছেনÑ অন্য লেখকদের বই কেনার সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে, কারণ তার প্রতি বছরই দুই-একটি বই প্রতিটি ব্যাংকে হাজার কপি কিনতে হয়, অন্যথায় চাকরি নিয়ে বিপদ পদে পদে। বিদ্যাবুদ্ধি জাহির করার জন্য এ আরেক মেঘা প্রকল্প।
দেশের অর্থনৈতিক প্রকল্পের একটির ‘স্বাস্থ্য’ও ভালো নেই। জনগণের আমানতের জায়গাগুলো রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। লভ্যাংশের হার, সুদ, কমিশন সব কিছুই তলানিতে ঠেকেছে। সাধারণ মানুষ টাকা আমানত রেখে নিশ্চিন্তে যে একটু জীবনযাপন করবে সে রাস্তাও এবারের (২০১৭-১৮) বাজেটে বন্ধ হয়ে যাবে। সরকার নিজে আয় রোজগারের পথ খুলতে যেখানে ব্যর্থ, সেখানে সরলপথের বিনিয়োগ ব্যবস্থাটাকে কেন জটিল করে তোলা হচ্ছে এটা অবশ্যই চিন্তার বিষয়। আস্থার জায়গাটা ছিল ব্যাংক, সেখানেই বিপদ এখন বেশি। এক লাখ টাকা আমানত রাখলে বছর শেষে দেখা যাবেÑ সার্ভিস চার্জ, এক্সাইজ ডিউটি, ভ্যাট, লভ্যাংশের ওপর সুদ ইত্যাদি নানা খাতে টাকা কাটলে মূল টাকাই ছোট হয়ে যায়। লাভের কথা বাদই দিলাম। ব্যাংকের এক কর্মচারী বললেন, স্যার দেশের যা অবস্থা তাতে আপনাদের থেকে টাকা কর্তন না করলে আমাদের বেতন হবে কিভাবে, সে জন্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব নিত্যনতুন আইন করছে। জনগণকে বাজেট নিয়ে প্রশ্ন করলে সরল উত্তরÑ সরকার আমাদের বোকা মনে করে। বিত্তবানেরা স্বপ্ন ছোঁয়ার মেগা বাজেটে উপকৃত হবেন বেশি। তারা অর্জিত আয় বিদেশে পাচার করবেন। অন্য দিকে, ফ্যাট-গাড়ি-বাড়ি কিনবেন স্বজনদের নামে। তাদের ব্যাংকে টাকা রাখার প্রয়োজন নেই। কালো টাকা সাদা করার সব পথ উন্মুক্ত। কষ্টটা গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। সিপিবি বলেছে, ‘এই বাজেট গরিব মারার সর্বশ্রেষ্ঠ বাজেট’। সিপিডি ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, এ বাজেটে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে এবং মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এ বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য নয়, অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আবু আহমেদ বলেছেন, ঘোষিত বাজেটের সাইজ বিশাল, কিন্তু এতে বিনিয়োগবান্ধব তেমন কিছুই নেই। অতিরিক্ত ট্যাক্স আরোপ, ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধি এবং উচ্চহারে ভ্যাট আরোপ করায় বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হতে পারেন।
এবার অনুন্নয়ন ব্যয় বিদায়ী অর্থবছরের (২০১৬-১৭) চেয়ে ২১ শতাংশ বেশি। এই ব্যয়ের মধ্যে ৫৩ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা সরকারি কর্মচারীদের বেতনভাতা পরিশোধেই চলে যাবে, যা মোট অনুন্নয়ন ব্যয়ের ২২ শতাংশ। আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ব্যবধান এবং বিদেশী অনুদান বাদ দিলে বাজেটে এক লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকার ঘাটতি, যা পূরণ হবে ব্যাংক থেকে ধার কর্জ, বিদেশী ঋণ এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে অর্থ পাওয়ার ওপর। অর্থবিশারদদের প্রশ্ন, আয় ও ব্যয়ের মধ্যে এত বড় ব্যবধান রেখে প্রতি বছর ঘাটতি বাজেট নামে যাকে অবহিত করা হয়, তা কখনো কল্যাণমূলক বাজেট হিসেবে সমর্থনযোগ্য নয়। বিশাল ঘাটতি উন্নয়নশীল বিশ্বে কোথাও দেখা যায় না। বর্তমান সরকারের দুই টার্মে অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত ২০০৯-১০ অর্থবছরে এক লাখ ১৩ হাজার ৮১৫ কোটি টাকার বাজেট দিয়ে চমক সৃষ্টি করেছিলেনÑ যা এবারের বাজেটে চারগুণেরও বেশি অর্থাৎ চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করে বড় ধরনের চমক উপহার দিলেন। অতীতে তার কোনো বাজেটই গরিবের স্বার্থ রক্ষা কিংবা মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখেনিÑ এসব কথা দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন। যাতায়াত ভাড়া বর্তমান সরকারের আমলে চার থেকে পাঁচ গুণ বেড়েছে। নিত্যবাজার খরচ সাত থেকে আট গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি চ্যানেলে একজন ভোক্তার বক্তব্য তুলে ধরছি। তিনি বলেছেন, শুধু সবজিতেই আমার ৯০০ টাকা খরচ হয়েছে আজ। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে বাজেটের বিশালত্ব দেখিয়ে লাভ নেই। বাজেট হতে হবে ১৭ কোটি মানুষের পকেট উন্নয়নের বাজেট। সেটা আমরা দেখছি না। একজন রসিকজনের কথা তুলে ধরছিÑ বাজেটের যে হাল অবস্থা তাতে মনে হয়, টাকা নিতে হবে ব্যাগ ভরে আর সওদা আনতে হবে পকেটে করে। ৭০-এর দশকে আড়াই টাকার সওদা আনতে দুটো ব্যাগ লাগত, যা বহন করার জন্য একজন মিন্তি জোগাড় করতে হতো। এখন চার হাজার টাকার বাজার করতে একটি ব্যাগই যথেষ্ট। হাইব্রিড সামগ্রী যার অর্থ ডাক্তারি ভাষায় পুষ্টিহীন খাদ্য ব্যাগভরে প্রতিদিন আমরা কিনছি। এতে চিকিৎসা ব্যয় কত যে বাড়বে তা ভুক্তভোগীরাই শুধু জানেন। পাকস্থলী, কিডনি, লিভার ও হাড়ের নানা ব্যাধি মানুষের মধ্যে গণহারে সংক্রমিত হচ্ছে। কোনো মানুষই মানসিক ও দৈহিকভাবে বলতে পারবে না, আমি শতভাগ সুস্থ। খাদ্যে বিষক্রিয়ায় মাটি পর্যন্ত আক্রান্ত, ফসল তো আক্রান্ত হবেই। মাটি ফরিয়াদ করছে, হে আল্লাহ তুমি আমাকে উর্বরতা শক্তি দান করেছিলে; কিন্তু তোমার শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ নানা বিষাক্ত সার ব্যবহার করে আমাকে সুস্থ থাকতে দিচ্ছে না। মানুষ সৃষ্টি জগতের সাথে যেমন আচরণ করবে ঠিক তেমন আচরণ তারা প্রকৃতি থেকে পাবে। বর্তমানে সেটাই ঘটছে।
লেখক : গবেষক
E.m: harunrashidar@gmail.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/227971