১২ জুন ২০১৭, সোমবার, ১১:১৬

পলিথিনেই সর্বনাশ

বেড়েছে ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য

প্রশাসনের উদাসীনতায় পলিথিনের প্রসার : অনেকেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে

পলিথিনের প্রসার ও বহুমুখি ব্যবহার দেখে আর বোঝার উপায় নেই যে এটি নিষিদ্ধ। আইন করেও পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা গেল না। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিষিদ্ধ জিনিসের ব্যবহার এতোটা বাড়তে পারে তা কল্পনাও করা যায় না। প্রশাসনের উদাসীনতায় দিন দিন পলিথিনের প্রসার বেড়েছে, বেড়েছে ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম। নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবসা করে অনেকেরই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। প্রশাসনকে ম্যানেক করে পলিথিনের ব্যবসা করার সুযোগ দিয়ে সরকারদলীয় এক শ্রেণির নেতারা হয়েছেন কোটিপতি।
পলিথিনে সারাদেশের পরিবেশ বিপর্যস্ত, ভেঙ্গে পড়ছে ড্রেনেজ ব্যবস্থা, উর্বরতা হারাচ্ছে মাটি, বাতাসে ছড়াচ্ছে বিষ, ভরাট হচ্ছে নদী-খাল-বিল, পরিচ্ছন্নতা হারাচ্ছে সড়ক-গলিপথ। পুরান ঢাকার নিষিদ্ধ পলিথিন কারখানার সংখ্যা দু’শ থেকে বেড়ে এখন তিনশ’ ছাড়িয়ে গেছে। এতোকিছুর মধ্যেও একটা সুখবর হলো, পলিথিনের বিকল্প পলিব্যাগ বাজারে আসছে। পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম বলেছেন, আগামী ৫-৬ মাসের মধ্যে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পাটের পলিব্যাগ উৎপাদন শুরু হবে। দুই-তিন মাসের মধ্যে বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আনা হবে। সরকারিভাবে উৎপাদনের পর বেসরকারিভাবেও এই ব্যাগ উৎপাদনে সহায়তা দেওয়া হবে। যদিও এর আগে পাটের বস্তা ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাজধানীরে বিভিন্ন এলাকায় মোবাইল কোর্টের অভিযান চালিয়েও সফল হতে পারেনি পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়।
অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে উৎপাদিত পরিবেশ দূষণের সবচেয়ে বড় নিয়ামক পলিথিন। এ কারনেই পলিথিনের কারখানা বন্ধে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সরওয়ার ইমতিয়াজ হাশমি বলেন, আইন করে পলিথিন উৎপাদন বন্ধ করা যায় নি, অভিযান করেও এটি বন্ধ করা সম্ভব নয়। ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকায় এবং একই বছরের ১ মার্চ থেকে দেশব্যাপী ২০ মাইক্রোনের চেয়ে পাতলা পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাত, মজুদ ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। পরিবেশ সংরণ আইন (সংশোধিত) ২০০২ মোতাবেক এ ব্যাগ উৎপাদন করলে ১০ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান করা হয়। বাজারজাত করলে ৬ মাসের জেল এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। সে সময় নেয়া বেশ কিছু পদক্ষেপে পলিথিনের ব্যবহার অনেকটাই বন্ধ হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার তা বেড়ে যায়। এখন পলিথিনে সারাদেশই সয়লাব।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, খোদ রাজধানীতই এক হাজারেরও বেশি কারখানায় তৈরী হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন। এর মধ্যে পুরান ঢাকায় আছে তিন শতাধিক কারখানা। বাকীগুলো ঢাকার বিভিন্ন এলাকাসহ আশপাশের এলাকা টঙ্গী, গাজীপুর, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, সাভার, মুন্সীগঞ্জ, দোহার, নবাবগঞ্জ থানা এলাকায়। পুরান ঢাকায় প্যাকেজিং কারখানার আড়ালে অনেকটা প্রকাশ্যেই তৈরী হচ্ছে পলিথিনের শপিং ব্যাগ। কারখানাগুলোতে দিনে নামমাত্র প্যাকেজিংয়ের কাজ হলেও রাতে চেহারা পাল্টে যায়। গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত চলে পলিথিন উৎপাদন। এরপর সেগুলো ‘জরুরি রপ্তানি কাজে নিয়োজিত’ স্টিকারযুক্ত গাড়িতে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুরান ঢাকায় তিন শতাধিক কারখানায় তৈরি হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন ও নাইলনের নেটব্যাগ। হাতল ছাড়া পলিথিন এবং নাইলনের নেট ব্যাগ উৎপাদন করে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং প্রশাসনের অনেক সদস্যই এ সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। সূত্র জানায়, পলিথিন উৎপাদনের জন্য সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে মোটা অংকের মাসোহারা দেয় পলিথিন সিন্ডিকেট। শুধু উৎপাদন নয়, ঢাকার বাইরে সরবরাহ করার জন্যও পুলিশ এই সিন্ডিকেটকে সহায়তা করে থাকে। গভীর রাতে কারখানাগুলোর সামনে ট্রাক দাঁড় করিয়ে পলিথিনের কার্টন ভরা হয়। তখন পুলিশ বাধা দেয়া দুরে থাক, দূর থেকে পাহারা দিয়ে রাখে। সূত্র জানায়, রাজধানীতে গড়ে ওঠা পলিথিনের কারখানারগুলোর মধ্যে পুরান ঢাকায় সবচেয়ে বেশি কারখানা রয়েছে। এর বেশিরভাগই ইসলামবাগ এলাকায়। এ ছাড়া বুড়ীগঙ্গার তীরে, রহমতগঞ্জ, লালবাগ, হোসেন উদ্দিন দ্বিতীয় লেন, আমলিগোলা, কামরাঙ্গীরচর এলাকায় শতাধিক কারখানা রয়েছে। পুরান ঢাকা ছাড়া রাজধানীর মিরপুর, কাওরানবাজার, তেজগাঁও, যাত্রাবাড়ী, সুত্রাপুর, ডেমরা, শ্যামপুর, কোতয়ালী, বংশাল, কামরাঙ্গীরচর, মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় পলিথিনের কারখানা রয়েছে।
পলিথিন ব্যবসায়ীরা জানান, একাধিক শক্তিশালী সিন্ডিকেট বহুদিন ধরে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যেই পলিথিন উৎপাদন করছে। সূত্র বলছে, প্রশাসনকে দেখানোর জন্য পলিথিন সিন্ডিকেট গার্মেন্ট, লবণ ও চিনিসহ ২৩ প্রকার প্যাকেজিং পলিথিন উৎপাদনের অনুমোদন নিয়ে শত শত কারখানায় তৈরি করছে নিষিদ্ধ পলিথিন। ব্যবসায়ীরা জানান, পলিথিন শপিং ব্যাগ তৈরির দেশী মেশিনের দাম পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা আর বিদেশী মেশিনের দাম ১০ লাখ টাকার মতো। পলিথিনের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় পরিত্যক্ত বিষাক্ত পলিথিন সামগ্রী। গ্যাস্ট্রিক, মিকশ্চার, পরিপ্রোফাইল, পলিইথাইল, এইচডিপিসহ বিভিন্ন নামে এসব পলিথিন বিক্রি হয়।
পুরান ঢাকার চকবাজার থানার অদূরে বেগমবাজার, চকবাজার ও মৌলভীবাজারে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার পলিথিন শপিং ব্যাগ বিক্রি হয়। বিভিন্ন মার্কেটে বিভিন্ন পণ্যের মোড়কের জন্য অনুমোদিত পলিথিন সামগ্রীর আড়ালে শপিং ব্যাগের নমুনা রাখা হয়। ওই সব নমুনা দেখিয়ে বিক্রির চুক্তির পর তা গুদাম অথবা কারখানা থেকে সরবরাহ করা হয়। পলিথিন সরবরাহের জন্য ব্যবহার করা হয় নির্দ্দিষ্ট পরিবহনের ট্রাক বা কাভার্ডভ্যান। পুরান ঢাকার প্যাকেজিং বা প্লাস্টিক কারখানার মালিকেরাই মূলত এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের মধ্যে আছেন হাজী মোতালেব, টেপা জাফর, হাজী শফি মাহমুদ, হাজী সাব্বির, হাজী ডাবøু, মোখলেছ মেম্বার, হাজী ওসমান, হাজী লাট মিয়া, হাজী উমেশ, মাউড়া জামিল, খালেদ সাইফুল্লাহ, মোহাম্মদ আলী, আমির হোসেন, মঈনুল, মজিবুর, পলাশ, জুয়েল, মিজান, লতিফ ও সাহাবুদ্দিন। আলাপকালে সোয়ারীঘাটের পলিথিন কারখানার এক কর্মচারী জানান, সোয়ারীঘাট, দেবীদাসঘাট ও কামালবাগে শতাধিক কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে হাজী আনোয়ার, আবদুস ছালাম, পলাশ, জুয়েল, হাসান, হাজী রহিম, হাজী জব্বার, মোটকা আনোয়ার, নাসুর ছেলে বাবু, ফারুক, রহমত, দানা আনোয়ার, শরীয়তপুরের রহমান, মারুফ, পারভেজ, নোয়াখাইল্যা বাবুল, হেংলা আনোয়ার, বিকি, জেকি ও টেপা জাফরের কারখানায় কোটি কোটি টাকার পলিথিন উৎপাদন হচ্ছে।
ইসলামবাগের একজন কর্মচারী জানান, এই এলাকায় জাবেদ হোসেন পাপ্পু, কালা জাহাঙ্গীর, জালাল, দৌলদ্দিন, আব্দুল কাদির, আল-আমিন, আবু, জালাল, আশ্রাফ, লিটন চৌধুরী, শরীয়তপুরের সিরাজ, হাজী আক্কাস, আব্দুল কুদ্দুস, মিজান, আরিফ, হেলাল, এমদাদ, মোখলেছ মেম্বার ও দিনাজপুরের হান্নানের নিষিদ্ধ পলিথিনের কারখানা রয়েছে। কোনো কোনো কারখানা রাতদিন চলে। কোনটাতে দিনে প্যাকেজিং এর কমবেশি কাজ চলে। রাতে তৈরী হয় পলিথিন। সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্য মতে, ঢাকায় প্রতিদিন এক কোটিরও বেশি পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন হয়। এসব ব্যাগের কারনে ড্রেন, নালা, খাল, ডোবা ইত্যাদি অতি দ্রæত বন্ধ হয়ে যায় এবং পানি ও ময়লা নিস্কাশনে বাধার সৃষ্টি হয়।
২০১০ সালে পলিথিনের বদলে পাটজাত ব্যাগ ব্যবহারের আইন পাস করা হলেও তার কোনো কার্যকরী ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি। পাটকে কোনোভাবেই জনপ্রিয় করে তুলতে পারেনি সরকার। এমনকি এ ব্যাপারে কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপও নেয়া হয়নি। দীর্ঘদিন পর বর্তমান সরকার পাটের ব্যাগ ব্যবহারের জন্য তৎপরতা শুরু করেও সফল হতে পারেনি। এদিকে, এতাকিছুর মধ্যেও পলিথিন ঠেকাতে বসে নেই সরকার। বিকল্প হিসাবে আনা হচ্ছে পরিবেশবান্ধব পাটের পলিব্যাগ। জানা গেছে, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) তত্ত¡াবধানে পথিলিনের বিকল্প পাটের তৈরি পলিব্যাগ উদ্ভাবন করেছে বিজেএমসির প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের প্রাক্তন মহাপরিচালক ড. মোবারক আহমেদের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন মোড়ক তৈরিতে ব্যবহৃত হবে। তারা বর্তমানে এই ব্যাগ ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে তৈরি করেছেন। আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আসার পর বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা হবে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত এ পাটের পলিব্যাগ দেখতে প্রচলিত পলিথিনের ব্যাগের মতোই হালকা ও পাতলা। পাটের সু² সেলুলোজকে প্রক্রিয়াজাত করে এ ব্যাগ তৈরি করা হবে। পাটের তৈরি এ পলিব্যাগ মাটিতে ফেললে তা পচে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। এতে পরিবেশ দূষিত হবে না। এ ব্যাগ দামেও সাশ্রয়ী হবে। এভাবে পাটের ব্যবহার বাড়লে ন্যায্যমূল্য পাবেন কৃষক। অতীতের মতোই পাট দিয়েই বিশ্বে সুপরিচিত হবে বাংলাদেশ।

https://www.dailyinqilab.com/article/83426/#sthash.6l0sEpqI.dpuf