১২ জুন ২০১৭, সোমবার, ১১:০৯

বিবিএসের জরিপ

শহরমুখী গ্রামের মানুষ

বিকেন্দ্রীকরণ দেরি হলে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হবে -- ড. নজরুল ইসলাম

মো. এনামুল হক। বাড়ি কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলায় সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন সোনাহাটে। বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে শিক্ষাজীবন, বিয়ে, রাজনীতি, এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সবই ছিল তার সোনাহাটকে ঘিরে। বড় ছেলে ‘পৃথিবী’র এসএসসি পরীক্ষা দেয়া পর্যন্ত সবই চলছিল আগের মতো। পরীক্ষায় ছেলের গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়ার পর এনামুলের মনোজগতে বড় পরিবর্তন আসে। পৈতৃক ভিটা ছেড়ে পরিবার নিয়ে রংপুর শহরে ভাড়া বাসায় ওঠেন। ছেলেকে রংপুর ক্যান্ট. পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি করান। ছোট মেয়েকেও ভর্তি করান শহরের নামকরা স্কুলে। শুধু এনামুলই নন, এরকম অনেকেই জীবনের নানা প্রয়োজনে গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে ছুটছেন। ফলে গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবও তাই বলছে। বিবিএসের প্রতিবেদনে গ্রাম ছাড়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে বিয়ে, উন্নত শিক্ষা, কাজের সন্ধান, চাকরিসূত্রে বদলি, বন্যা, নদীভাঙন, ব্যবসা, পরিবারের সঙ্গে বসবাস, অবসর কাটানোকে।


সম্প্রতি প্রকাশিত মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস অব বাংলাদেশ (এমএসভিএসবি) প্রকল্পের স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এসব চিত্র উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী মানুষের হার ছিল হাজারে ৩০ দশমিক তিন জন, যা আগের বছর ছিল ২৯ দশমিক পাঁচ। ২০১৪ সালে এ হার ছিল ২৮ দশমিক দুই। ২০১৩ সালে ছিল ২৭ দশমিক দুই। ২০১২ সালে ছিল ২৬ দশমিক দুই এবং ২০১১ সালে ছিল ২৩ দশমিক সাতজন।

এ ছাড়া শহরের মানুষের সঙ্গে গ্রামের যোগাযোগও বেড়েছে। ২০১৬ সালে প্রতি হাজারে শহরের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৩ জনে, আগের বছর ছিল ৯০। পাঁচ বছর আগে ২০১২ সালে এ হার ছিল ৬৯ দশমিক সাত।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম যুগান্তরকে বলেন, আগে জীবিকার তাগিদে মানুষ শহরে এলেও এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। উন্নত জীবনের তাগিদেও শহরে পাড়ি জমাচ্ছে মানুষ। স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা ও নাগরিক জীবনের আরাম আয়েশের কথা চিন্তা করেই শহরের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে। এ অবস্থায় জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে শহরগুলো। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে।

নগর পরিকল্পনাবিদ ড. নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, শুধু উন্নত নাগরিক জীবনের জন্যই নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগও গ্রাম ছাড়ার অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং ঢাকামুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কমিয়ে গ্রামপর্যায়ে উন্নয়ন ছড়িয়ে দিতে হবে। তা ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে সবকিছুরই বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। দেরি হয়ে গেলে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অন্য শহরে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হবে। তা ছাড়া গ্রামে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটানো, নতুন কর্মসংস্থান করতে পারলে শহরমুখী মানুষের চাপ কমবে।

মানুষের জায়গা বদলের এই ধারার বিপরীত চিত্র যে নেই তা নয়। শহর ছেড়ে গ্রামমুখী হওয়ার প্রবণতা গত পাঁচ বছরে কমেছে। বিবিএসের নমুনা জরিপে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে শহর ছেড়ে গ্রামমুখী মানুষের সংখ্যা হাজারে ছিল পাঁচজন, যা আগের বছর ছিল পাঁচ দশমিক এক। ২০১৪ এবং ২০১৩ সালে ছিল পাঁচ দশমিক একজন করে। কিন্তু ২০১২ ও ২০১১ সালে এই সংখ্যা ছিল পাঁচ দশমিক তিন।

জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক একেএম আশরাফুল হক জানান, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ১৯৮০ সাল থেকে দৈব পদ্ধতিতে জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে ও স্থানান্তর সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করছে। শুরুতে নমুনা এলাকার সংখ্যা ছিল ১০৩টি। বর্তমানে দুই হাজারের বেশি নমুনা এলাকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

বিবিএসের জরিপ বলছে, গ্রাম থেকে গ্রামে স্থানান্তরের সংখ্যাও বেড়েছে। ২০১৬ সালে হাজারে স্থানান্তরের এই সংখ্যা ছিল ৩৪ দশমিক পাঁচজন, যা ২০১৫ সালে ছিল ২৫ দশমিক ছয়। ২০১৪ সালে ছিল ২৪ দশমিক তিন। ২০১৩ সালে ২৬ দশমিক ছয়জন, ২০১২ সালে ১৬ দশমিক দুই এবং ২০১১ সালে ছিল ১৫।

এদিকে শহর থেকে শহরে স্থানান্তরের হারও বেড়েছে। ২০১৬ সালে হাজারে এ সংখ্যা ছিল ৯২ দশমিক ছয়জন, যা ২০১৫ সালে ছিল ৬০ দশমিক পাঁচ। ২০১৪ সালে ছিল ৪৮ দশমিক নয়। ২০১৩ সালে ছিল ৪০ দশমিক নয়, ২০১২ সালে ছিল ৪৩ দশমিক পাঁচ এবং ২০১১ সালে এ হার ছিল প্রতি হাজারে ৪২ দশমিক পাঁচ জন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সার্বিকভাবে দেশের বাইরে যাওয়ার হারও বেড়েছে। ২০১৬ সালের জরিপ বলছে, বহির্গমন হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৮ দশমিক পাঁচ জনে, যা ২০১৫ সালে ছিল ৫৪ দশমিক চার। ২০১২ সালে ছিল ৪১ দশমিক নয়। তবে শহর থেকে দেশের বাইরে যাওয়ার হারও বেড়ছে। ২০১৬ সালে হাজারে এ সংখ্যা ছিল ১১৭ দশমিক দুই জন, যা ২০১২ সালে ছিল ৬৯। গ্রাম থেকে বাইরে যাওয়ার এ হার ২০১৬ সালে দাঁড়িয়েছে ৪৭ দশমিক পাঁচজনে, যা ২০১২ সালে ছিল ২৩ দশমিক পাঁচ।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/06/12/131867/