১২ জুন ২০১৭, সোমবার, ১১:০৭

‘শ্রেষ্ঠ বাজেট’-এর ত্রুটি ও একটি অঙ্গীকার

দেখা অদেখা

|| সালাহউদ্দিন বাবর ||

ভোটের রাজনীতিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ‘জীবনের শ্রেষ্ঠ বাজেট’ নিয়ে বড় বেকায়দায় পড়েছে আওয়ামী লীগ। চতুর্দিক থেকে তীব্র সমালোচনার তীর সরকারের দিকে ছোড়া হচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় ও অন্যান্য মিডিয়ায় এখন অর্থমন্ত্রীর ‘শ্রেষ্ঠ’ বাজেটের প্রতি ধিক্কার আসছে। বলা হচ্ছে, এই বাজেট অবশ্যই পাল্টাতে হবে। খোদ আওয়ামী লীগ বলয়ের অর্থনীতিবিদেরা বাজেটের সমালোচনায় সরব। সংসদে আওয়ামী লীগের এমপিরা বাজেট নিয়ে অর্থমন্ত্রীকে তুলোধোনা করছেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে জনাব মুহিত দেশে প্রায় রেকর্ড সংখ্যকবার বাজেট পেশ করেছেন। কিন্তু এবার বাজেট নিয়ে তিনি যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, তা অতীতে কখনো তাকে করতে হয়নি। তিনি এই বাজেট পেশ করে এত বেশি সন্তুষ্ট ছিলেন যে, অনেকটা গর্ব করেই বলেছেন, এটা তার দেয়া শ্রেষ্ঠ বাজেট। বয়োবৃদ্ধ আমলা রাজনীতিক জনাব মুহিত সবসময়ই একটা গরিমায় ভোগেন। নিজেকে অনেক বেশি বিজ্ঞ ভেবে অন্যদের তুচ্ছ তাচ্ছিল করেন। এবার তার অহমিকায় প্রচণ্ড আঘাত এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাজেটের প্রতি তীব্র বিরূপ সমালোচনা লক্ষ করে শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, বাজেটে ত্রুটি থাকলে তা সংশোধন করা হবে। নির্বাচনের আগে অর্থমন্ত্রী মনে করেছিলেন, তার ‘শ্রেষ্ঠ’ বাজেট দিয়ে বাজিমাৎ করবেন। কিন্তু দেখা গেল, সকলই গরল ভেল। ঘরে-বাইরে সমালোচনার তোড়ে ভেসে গেছে বাজেটের রাজনীতি। অর্থমন্ত্রী আরো বলেছিলেন, উন্নয়ন বাংলাদেশকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এখন দেখা গেল সমালোচনাই তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এত সমালোচনার মুখে অর্থমন্ত্রী এখন আর কোনো কথাই বলছেন না। আওয়ামী লীগের অন্য মন্ত্রী ও নেতারাও এ ব্যাপারে নীরব। দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বাজেটে ভুলভ্রান্তি থাকলে প্রধানমন্ত্রী তা সংশোধন করার কথা বলেছেন। অর্থমন্ত্রীর সাবেক ‘বস’ এরশাদ সাহেবও বাজেটের সমালোচনা করেছেন। স্মরণ করা যেতে পারে যে, অর্থমন্ত্রী মুহিত স্বৈরশাসক এরশাদের আমলের প্রথম অর্থমন্ত্রী হিসেবে একাধিকবার বাজেট পেশ করেছিলেন। এবারের বাজেট দেশের সব শ্রেণীর মানুষের জীবন চরম দুর্ভোগ নিয়ে আসবে। সরকারপ্রধান যখন বলেছেন যে, বাজেটের ত্রুটি দূর করা হবে; তখন অপেক্ষা করা যাক। বাজেট কতটা সংশোধিত হয়। আর সাধারণ মানুষের কতটা স্বার্থ রক্ষিত হয় দেখা যাবে তখন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতঃপূর্বে বলেছেন, তিনি চান আগামী সংসদ নির্বাচন যেন কোনো প্রকার প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) তথা নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বা ১৯১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন চায় না ইসি। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ইসির পক্ষ থেকে যে অঙ্গীকার জাতির কাছে এলো, তা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। জাতির এই আশা পূরণ করা অনেকখানি দায় দুই পক্ষের। কিছু দিন আগে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট সিইসির সাথে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতে বার্নিকাট বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়। নির্বাচন কমিশনও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছে। কী প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিতে তা সম্পন্ন হবে, তা নিয়ে বিশ্বের বড় এই দেশটি নির্বাচন কমিশনের সাথে আলোচনা করেছে। এই আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের দূত বলেছেন, তার দেশ জনগণের অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাও দেখতে চায়। সিইসির সাথে বৈঠকের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উন্নয়নসহযোগী। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্র অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করতে চায়। এ বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, তিনি (প্রধানমন্ত্রী) চান আগামী নির্বাচন যেন কোনো প্রকার প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। মার্কিন দূত বলেছেন, সেটি করার জন্য শুধু সবার অংশগ্রহণই যথেষ্ট নয়, আগামী নির্বাচনে যাতে প্রার্থীরা সুষ্ঠুভাবে প্রচারণা চালাতে পারেন, ভোটারেরা ভোট প্রয়োগ করতে পারেন, এমনকি ভোট গণনা যেন স্বচ্ছতার সঙ্গে হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এসব দাবি আসলে নতুন নয়। বহু দিন ধরে বাংলাদেশের মানুষের আকাক্সা ও দাবি হলো, যাতে দেশে একটি স্বচ্ছ ও প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
দেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে তাতে আগামী নির্বাচন নিয়ে দুশ্চিন্তার অবকাশ রয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং নির্বাচনকালীন সময়ে যে পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া উচিত সেটা নিয়েই উদ্বেগ। সরকার বিরোধী দলের সাথে, বিশেষ করে বিএনপির সাথে যে আচরণ করছে তা কোনোক্রমেই গণতান্ত্রিক নয়। মাঠে ময়দানে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। বিরোধী দলকে সমাবেশ মিছিল করতে দেয়া হচ্ছে না। একটি রাজনৈতিক দল যদি তাদের স্বাভাবিক কর্মসূচি পালন করতে না পারে, তবে তাদের অস্তিত্ব থাকে কিভাবে? নির্বাচনের সময়ও যদি এমন হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তাদের থাকতে হয়, তবে নির্বাচনে অংশ নেয়াই অসম্ভব হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আশা করা কঠিন হয়ে যাবে। আর বিএনপিবিহীন নির্বাচন তো কোনোক্রমেই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তদুপরি, এতে দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকবে না। গত প্রায় ১০ বছর ধরে রাজনীতিতে এমন পরিবেশ বজায় রয়েছে। একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে এমন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় নির্বাচনে অংশ নেয়া তো দূরের কথা, তাদের পক্ষে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানোও কষ্টকর। বিএনপির আরো বড় সমস্যা হচ্ছে, দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শত শত ও বিভিন্ন ধরনের ভুয়া মামলা চালু রয়েছে। এতে দলের বহু নেতাকর্মী এখন কারান্তরালে, অনেকে হুলিয়া মাথায় নিয়ে অস্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। তাদের পক্ষে দলের জন্য কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। একটি চরম বিরূপ অবস্থার মধ্য দিয়ে এখন বিএনপি চলছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলেছে, তারা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চায় না। তাই তাদের প্রতিপক্ষের প্রতি ন্যায়ানুগ আচরণ করা জরুরি।
নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এই অঙ্গীকার এসেছে যে, তারা একটি স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে চায়। কিন্তু তার বাস্তব কর্মপন্থাটি কী, সে সম্পর্কে তো তারা এখনো কিছু বলেননি। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশের সংবিধান নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কমিশনকে যথেষ্ট স্বাধীনতা, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দিয়েছে। তার পরও অতীতে নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ পূর্বসূরিরা কমিশনকে একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে গেছেন। তাদের অধীনে যতগুলো নির্বাচন হয়েছেÑ সেটা জাতীয় হোক বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের হোক; কোনো নির্বাচনই অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর এবং দেশের মানুষের কমিশনের প্রতি কোনো আস্থা নেই। অথচ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্বাচন কমিশনের ভাবমর্যাদা অত্যন্ত উচ্চ। আমাদের নির্বাচন কমিশনের স্বার্থে তাদের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা দরকার। মার্কিন দূতের সাথে সিইসির আলোচনা থেকে এ ধারণা করা যায় যে, তিনি (সিইসি) অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে আগ্রহী। অবশ্য এটা শুধু মুখে বললেই চলবে না। কাজেও প্রমাণ করতে হবে।
রাষ্ট্রের একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন। এর ভাবমর্যাদা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রতিষ্ঠানটির যে অবক্ষয় ঘটেছে, সে ক্ষেত্রে সরকারকেও দায়িত্ব নিতে হবে। কেননা গত ৫ বছরে যে মন্দ নির্বাচনগুলো হয়েছে। তাতে সরকারি দল আওয়ামী লীগও অংশ নিয়েছে। অংশগ্রহণকারী দল হিসেবে তাদের ভূমিকা মোটেও গণতন্ত্রসম্মত ছিল না। এসব মন্দ নির্বাচন করিয়েই নির্বাচন কমিশনের মর্যাদা ুণœ হয়েছে। তাই কমিশনের মর্যাদাহানির ব্যাপারে সরকারের একটা দায় অবশ্যই নিতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য সরকার বিষয়টি স্মরণ রাখতে হবে। রাষ্ট্রীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ইসির মর্যাদাহানি হলে এটা রাষ্ট্রের জন্যই ক্ষতিকর। ইসি যদি সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়, এর একটা খারাপ পরিণতি সবাইকে আঘাত করবে। ইসি কার্যকরভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে না পারলে দেশে গণতন্ত্রের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। এই বিপর্যয়ে যে আঁধার নেমে আসবে তাতে গণতন্ত্র বাঁচবে না। আর গণতন্ত্র না থাকলে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে তাতে সব কিছু বিপর্যস্ত হয়ে যাবে। এই বিপদ কারোই ডেকে আনা ঠিক হবে না।
প্রধানমন্ত্রী যে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চান না, সেই প্রশ্নহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের অর্থÑ সবার অংশগ্রণের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান। এই বক্তব্য গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক; এমন একটি কাক্সিত নির্বাচনের প্রত্যাশা সবার। কিন্তু এই প্রত্যাশিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার দায়িত্ব কিন্তু বহু পক্ষের নয়। এককভাবে সরকারকেই এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। সবাই যেন নির্বাচনে অংশ নিতে উৎসাহিত হয় তেমন একটি অনুকূল পরিবেশ চাই। বিশেষ করে সব দলমতের প্রার্থীরা যাতে নির্বাচনে আসতে উৎসাহিত হন সে ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। অনেক কারণেই আওয়ামী লীগের নির্বাচনসংক্রান্ত ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন দল শঙ্কায় থাকে। এ দলের নেতাকর্মীদের একটি অংশ নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ বিঘিœত করে। তারা কমিশনের কাজে বাধার সৃষ্টি করে, প্রশাসনকে প্রভাবিত করে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব পালনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। অতীতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা এমনটি। তারা জনগণের ওপর আস্থা না রেখে প্রভাব প্রতিপত্তি এবং অর্থের জোরে বিজয়ী হতে চায়। ভবিষ্যতেও যদি অতীতের এহেন দুঃসহ অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঘটে তবে সব অঙ্গীকার হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। আর একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনে যারাই ক্ষমতায় আসুক, তাতে কারো কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। কোন দল বিজয়ী হলো সেটা মুখ্য বিষয় নয়। ভোটদানের অধিকার যদি নিশ্চিত হয়, সেটাই গণতন্ত্রের বিজয়। আর সেটাই জাতির কাম্য।
সব দল সম্মিলিতভাবে নির্বাচনে যাবে এমন একটি খবর বাংলাদেশের জনগণের কাছে খুব আনন্দের। এমন একটি অবদান রচনার দায়িত্ব দেশের প্রধান দুই বড় দলের। গত দশ বছর ধরে দেশের মানুষ এমন একটি খবরের প্রতীক্ষায় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব যদি সরকার ও বিরোধী দলের ভাগাভাগি করতে হয় তবে এ জন্য সরকারি দলের দায় ষোলো আনার মধ্যে বারো আনা। সবার এক সাথে নির্বাচনে যাওয়ার ক্ষেত্রেও অন্তরায় রয়েছে। তবে সেটা চিহ্নিত হয়েছে। রোগ চিহ্নিত হলে তা সারানো সহজ। বিএনপি দাবি করছে নির্বাচনকালীন একটি সরকারের। তাদের কথা, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নয়। এ দাবির পেছনে তাদের যুক্তি প্রমাণ রয়েছে। আর এমন দাবি নতুনও নয় অসম্ভবও নয়। অতীতে এমন দাবি আওয়ামী লীগের ছিল, সে দাবিতে তারা সংসদে ও সংসদের ভেতরে ও বাইরে আন্দোলন করেছেন। এ দাবি পূরণও হয়েছে। এমন নির্বাচনকালীন সরকার সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছে এবং সে সরকারের অধীনে একাধিকবার নির্বাচনও হয়েছে। সে নির্বাচনের অভিজ্ঞতা চমৎকার ছিল। আওয়ামী লীগের ভূমিকাতেই প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে। এরপর দলীয় তথা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন ছিল বাস্তবে প্রহসনের নির্বাচন। এখন এ দাবিতে বক্তব্য রাখছে বিএনপি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সংবিধানে এমন বিধান নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৯১ সালে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে, তখন কিন্তু সংবিধানে এমন বিধান ছিল না। সব দল আলাপ-আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছিল। এখন সবাই মিলে সংলাপ করে অনুরূপ একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা মোটেও অসম্ভব নয়। এটা মনে রাখতে হবে, দেশ এখন গণতন্ত্রের জন্য অগ্নিপরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। তাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সবকিছু বিবেচনায় এনে আলাপ আলোচনা করে আগামী নির্বাচনকে অর্থপূর্ণ করে তোলাই সবার কর্তব্য।
গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চা না থাকলে সমাজে নানা উপসর্গ দেখা দেয়, যা ইতোমধ্যে দৃশ্যমান। গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে জবাবদিহিহীন শাসন কায়েম হয়। যার পরিণতিতে প্রতিষ্ঠিত হয় কর্তৃত্ববাদী সরকার। তাতে জনসাধারণের রাজনৈতিক মৌলিক মানবাধিকার ুণœ হয়; রাষ্ট্রে আইনের শাসন থাকে না, বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, ক্ষমতাসীনদের সমর্থকেরা নিজেদের হাতে আইন তুলে নেয়। অবিচার অনিয়ম দুর্নীতি সমাজ জীবনকে বিষিয়ে তোলে। এ দিকে, দেশে দুর্নীতির মাত্রা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ, ব্যাংক-বীমা, জনগণের গচ্ছিত অর্থ সম্পদ এখন লোপাট হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়জীবনে এমন শোচনীয় অবস্থা চলছে কিন্তু এর কোনো প্রতিকার প্রতিবিধান হচ্ছে না। সংসদ রয়েছে, কিন্তু সে সংসদে এ নিয়ে তেমন কার্যকর আলোচনা হচ্ছে না। সরকারকে সেখানে কোনো কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় না। তাই এই মুহূর্তে গণতান্ত্রিক এবং জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা কায়েম করা খুবই জরুরি।
বিগত ইসি যতগুলো নির্বাচন করিয়েছে, তার কোনোটি সুষ্ঠু হয়নি। এই বিষয়টি মাথায় রেখে যারা এখন দায়িত্বে রয়েছেন তাদের অগ্রসর হতে হবে। বর্তমান ইসির অধীনে একটি মাত্র বড় নির্বাচন হয়েছে। সেটা কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের। তবে সেই নির্বাচন দিয়ে তাদের সক্ষমতা যাচাই হবে না। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে ৪টি সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হবে। সেসব নির্বাচন কেমন হয় তা রাজনৈতিক দলগুলো পর্যবেক্ষণে রাখবে। গোটা দেশের মানুষ নতুন নির্বাচন কমিশনের কর্মদক্ষতা যাচাই করবে। নির্বাচন কমিশনের অনুকূলে সংবিধান রয়েছে, আইন-কানুন রয়েছে, জনগণের শুভেচ্ছা রয়েছে। তাদের উচিত কোনো অনুরাগ বিরাগের বশবর্তী না হয়ে পূর্ণক্ষমতা প্রয়োগ করে জাতিকে আদর্শ নির্বাচন উপহার দেয়া। বাংলাদেশে বেশ কিছু ভালো এবং কিছু মন্দ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ইতিহাস রয়েছে। কমিশনের দায়িত্ব হলো, মন্দ নির্বাচনগুলোর উদাহরণ না ঘেঁটে ভালো নির্বাচনগুলোর কার্যক্রম অনুসন্ধান করে সেভাবে এগিয়ে যাওয়া। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব মুখ্য বটে; কিন্তু সে সময় যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তাদের ভূমিকাও কম নয়। নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ করার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আর অতীতের অভিজ্ঞতা হচ্ছে যতগুলো নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে, তার প্রতিটির ক্ষেত্রেই সরকারের ভূমিকা পক্ষপাতদুষ্ট এবং বিতর্কিত। সে কারণে নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিটি এখন উঠে এসেছে। ভবিষ্যতে একটি ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি নিঃসন্দেহে গুরুত্ব রাখে।
নির্বাচনে সুশীলসমাজ এবং পর্যবেক্ষকদের একটা ভূমিকা রয়েছে। সুশীলসমাজের পক্ষ থেকে অনুসরণীয় একটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে এখন থেকেই প্রভাব বিস্তারের জন্য কাজ করতে হবে। ভালো নির্বাচনের পক্ষে জনমত তৈরিই রয়েছে। তাদের ভূমিকা হওয়া উচিত তাকে আরো শানিত করা। একই সাথে, নির্বাচনে যারা পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করবেন, তাদের সাহসিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এ জন্য কমিশনকে দেখতে হবে তারা যাতে অবাধে কাজ করতে পারেন। আরো দেখতে হবে যাতে পর্যবেক্ষকদের বেশে কোনো দলীয় লোক অনুপ্রবেশ করতে না পারে। 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/227688