১১ জুন ২০১৭, রবিবার, ১১:২৮

১০০ টন অবৈধ স্বর্ণ জব্দ হবে কবে?

আপন জুয়েলার্সের ব্যাংক হিসাবের গোপন প্রতিবেদন ফাইলবন্দি

সরকারের কাছ থেকে ‘আশ্বাস পেয়ে’ ধর্মঘটসহ সব ধরনের আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছে জুয়েলার্স সমিতি। বলা হচ্ছে শুল্ক গোয়েন্দারা তাদের বিরুদ্ধে আর কোনো অভিযান পরিচালনা করবে না। সরকারের তরফ থেকে স্বর্ণ আমদানির বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা না দেয়া পর্যন্ত তাদের কোনো প্রকার হয়রানি করা হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হল- তাহলে ১১ জন শীর্ষ স্বর্ণ ব্যবসায়ীর দখলে থাকা ১০০ টন অবৈধ স্বর্ণের কী হবে? ৪৫ হাজার কোটি টাকা মূল্যের বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ কী আড়ালে থেকে যাবে? উচ্চ পর্যায়ের সবুজ সংকেত কী আর পাওয়া যাবে না?
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে শনিবার যুগান্তরের কাছে অনেকে এমন মন্তব্য করেন। তারা বলেন, যেখানে বিপুল পরিমাণ অবৈধ স্বর্ণের দখলদার ও এর অবস্থান সম্পর্কে শুল্ক গোয়েন্দা শতভাগ নিশ্চিত হয়েছে সেখানে গোপন রাখার হেতু কী? তাদের মতে, আইন সবার জন্য সমান হওয়া উচিত। কোনো কাগজপত্র না থাকলে যদি আপন জুয়েলার্সের সাড়ে ১৫ মণ স্বর্ণ জব্দ করে মামলা হতে পারে, তাহলে এর বাইরে থাকা একইভাবে আনা বাকি সব স্বর্ণ জব্দ করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান শনিবার যুগান্তরকে বলেন, দেশে স্বর্ণ চোরাচালানানের যে পুঞ্জীভূত অনিয়ম চলছিল আপন জুয়েলার্সে শুল্ক গোয়েন্দাদের অভিযানের মধ্য দিয়ে তা সামনে চলে এসেছে। তবে শুধু আপন জুয়েলার্স এককভাবে নয়, আইনের প্রয়োগ সমভাবে হতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যুগান্তরে প্রকাশিত একশ’ টন স্বর্ণ মজুদ সংক্রান্ত রিপোর্টসহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো টিআইবির দৃষ্টিতে এসেছে। তারা আশা করছেন, বৈধ স্বর্ণ ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ তৈরি ও এই সেক্টরের জন্য একটি সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়নে এসব প্রতিবেদন সহায়ক হবে। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, একশ’ টন কেন যদি এক তোলা স্বর্ণ কারও কাছে অবৈধভাবে থাকে তাহলে সেখানে অভিযান চালাতে হবে।
এদিকে হাতেগোনা কয়েকজন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর কাছে মজুদ একশ’ টন স্বর্ণ জব্দ করার বিষয়ে জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। তাছাড়া অবৈধ স্বর্ণ ব্যবসার ওপর একটি বিশদ অনুসন্ধান এখনও চলমান। অনুসন্ধানে যাদের বিরুদ্ধে অবৈধ ব্যবসার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে আপন জুয়েলার্সের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলা করা হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কয়েকজন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর ব্যাংকিং লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য তারা পেয়েছেন। এগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে। এছাড়া আনুষঙ্গিক আরও কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে। এগুলো শেষ করে তা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠানো হবে।
সূত্র জানায়, শুল্ক গোয়েন্দা শীর্ষ পর্যায়ের ১১ জন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর কাছে থাকা ১০০ টন অবৈধ স্বর্ণের বিষয়টি গত সপ্তাহে নিশ্চিত হয়। বার আকারে এসব স্বর্ণ কোথায় মজুদ আছে তা তারা রেকি করে। এরপর এ বিষয়ে অভিযান পরিচালনা করার জন্য সার্বিক প্রস্তুতি নেয়া হয়। কিন্তু উচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত তা স্থগিত রাখা হয়।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, শুক্রবার রাতে এ বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে একটি বৈঠক হয়। সেখানে কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠক থেকে বিষয়টি সুরাহা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব এবং বর্তমানে এসডিজি (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল) বিষয়ক সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
এদিকে গতকাল দুপুরে এ বিষয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে একটি বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। সাংবাদিকদের প্রায় দু’ঘণ্টা বসিয়ে রেখে বেলা আড়াইটায় ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হয়। এ সময় এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জানান, ‘প্রধানমন্ত্রীর এসডিজি বিষয়ক সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ আশ্বস্ত করেছেন- ‘আপনারা কমিউনিটিকে বলতে পারেন, তারা যেন ধর্মঘটে না যায়। তাদের দাবির ব্যাপারে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’
প্রসঙ্গত, ঘটনার সূত্রপাত বনানীর রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’ছাত্রীকে ধর্ষণ ঘটনায় আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমের ছেলে সাফাত আহমেদের সম্পৃক্ততা। বিষয়টি এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। এ ঘটনার সূত্র ধরে আপন জুয়েলার্সের প্রতিটি শোরুমে শুল্ক গোয়েন্দা অভিযান চালায় এবং বিপুল পরিমাণ অবৈধ স্বর্ণালংকার জব্দ করে।
এর পরিপ্রক্ষিতে জুয়েলারি সমিতি দু’দফা ধর্মঘট ডেকে প্রত্যাহার করে নেয়। রোববার থেকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। দাবি ছিল আপন জুয়েলার্সের স্বর্ণ ফেরতসহ হয়রানি বন্ধ ও স্বর্ণ আমদানি নীতিমালা প্রণয়ন। সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালকের অপসারণ দাবি।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/06/11/131590/