১১ জুন ২০১৭, রবিবার, ১১:১৯

বন্ধ করো শিশু হত্যা

চলতি বছরের প্রথম ৫ মাসে নিহত ১৩০ জুনের ১০ দিনেই ৮

বড়দের রাগ-বিদ্বেষ, ক্ষোভ-বঞ্চনা, বিরহ-বিরোধ, মান-অভিমান, ঘৃণা-প্রত্যাখ্যানের নৃশংস বলি হচ্ছে শিশুরা। সন্তানের প্রতি চিরন্তন ভালোবাসা ভুলে কখনও মা-বাবাই হয়ে উঠছেন আপন সন্তানের হন্তারক। একের পর এক মর্মন্তুদ ঘটনা সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার স্বার্থহীন অটুট বন্ধনের মানবিক সম্পর্কের বিষয়টি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে কঠিন সত্যের সামনে। কখনও আবার সমাজ ও পরিবারের নানা বিরোধের জেরে ভয়ঙ্কর

হত্যার শিকার হচ্ছে অবুঝ শিশুরা। এমনকি অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে প্রায়ই শিশুদের সহজ টার্গেট বানাচ্ছে দাগি অপরাধীরা। দেশের কোনো না কোনো স্থানে প্রতিদিন নানা কারণে প্রাণ হারাচ্ছে নিষ্পাপ শিশুরা। চলতি বছরের পরিসংখ্যান বলছে, এখন পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন একজন করে শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। সর্বশেষ গত শুক্রবার মধ্যরাতে নোয়াখালীর চাটখিলে সৎমায়ের হাতে খুন হয় রাহিম মান্নান নামের এক শিশু। একই দিন মাগুরার শ্রীপুরে সাধন বিশ্বাস নামের একজন খুন হয়। একই দিন রাজধানী উপকণ্ঠ তুরাগে নিজ বাসা থেকে তিন শিশুর নিথর দেহ ও ফ্যানের সঙ্গে মায়ের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় প্রাথমিকভাবে পুলিশ বলছে, তিন শিশুকে হত্যা করে মা আত্মহত্যা করেছেন। ঘটনাটি আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল- আপন ভুবনেও নিরাপদ নয় শিশুরা। কেবল চলতি মাসের প্রথম ১০ দিনে আট শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। গত মাসে এ সংখ্যা ছিল ২০ জন।


সংশ্লিষ্টদের অভিমত- পারিবারিক, সামাজিক সচেতনতার অভাব, বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা, পর্নোগ্রাফি, মানসিক অস্থিরতা, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কুপ্রভাব, মাদকাসক্তি, অসাবধানতাবশত মারধর, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, মানসিক অসুস্থতার কারণে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটছে।

শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে কেবল মা-বাবার হাতেই প্রাণ গেছে ১১৭ শিশুর। এ ছাড়া চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে দেশে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৩০টি। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ছিল ২৬৫, ২০১৫ সালে ২৯২, ২০১৪ সালে ৩৬৬, ২০১৩ সালে ২১৮ ও ২০১২ সালে ২০৯। চলতি বছরে প্রথম পাঁচ মাসে শিশু অপহরণের ঘটনা ৪৯টি। ২০১৬ সালে ১৮৩, ২০১৫ সালে ২৪৩, ২০১৪ সালে ২০৯, ২০১৩ সালে ৬১ ও ২০১২ সালে অপহরণের ঘটনা ৬৭টি। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে অপহরণের পর শিশু হত্যার ঘটনা ছয়টি। পুরো ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৭, ২০১৫ সালে ৪০, ২০১৪ সালে ৫২ ও ২০১৩ সালে ১৯টি। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৪৪টি। পর্নোগ্রাফিতে ১৪ শিশুকে ব্যবহার করা হয়েছে। অজ্ঞাত নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে ১৪ জনের। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে নিখোঁজের পর ৩৪ শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক তথ্য কমিশনার ড. সাদেকা হালিম শনিবার সমকালকে বলেন, একসময় একান্নবর্তী পরিবার ছিল। পরিবারের সদস্যরা একে অন্যের সমস্যার সমাধানে এগিয়ে যেতেন। এখন স্বামী-স্ত্রী তাদের মধ্যকার দাম্পত্য সমস্যা নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে কারও সঙ্গে শেয়ার করেন না, যার পরিণতি হয় ভয়ানক। অনেকে সন্তানকে হত্যা করে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে।

সাদেকা হালিম আরও বলেন, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় জীবনধারণের অনেক কিছুতেই পরিবর্তন হয়েছে। সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার সম্পর্ক আগের মতো দেখা যায় না। প্রতিবেশী তার প্রতিবেশীকে চেনেন না। আবার সন্তানের সিজোফ্রেনিয়াসহ অন্য কোনো সমস্যা হলে মা-বাবা লুকানোর চেষ্টা করে। কোনো মানসিক সমস্যা হলে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হবে- এ ভেবে কাউন্সেলিং করানো হয় না, যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। কোনো সমস্যা দেখা দিলে ব্লেম গেইম না করে সমস্যা সমাধানে পরিবারের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

দীর্ঘদিন ধরে শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন শিশু অধিকার ফোরামের গবেষণা কর্মকর্তা আজমী আক্তার। তিনি সমকালকে বলেন, আমাদের সমাজ এখনও শিশুদের ব্যাপারে সংবেদনশীল নয়। নানাভাবে শিশুরা হয়রানির শিকার হচ্ছে। তাদের জন্য তৈরি করা হচ্ছে মৃত্যুফাঁদ। পারিবারিক, সামাজিক অস্থিরতার কারণেও শিশুরা হত্যার শিকার হচ্ছে। দেখা গেছে, কোনো কারণে মা-বাবা আত্মহত্যা করছে, তার আগে তারা তাদের সন্তানদেরও হত্যার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আবার মা-বাবার হাতে প্রতিবন্ধী শিশু হত্যার নজিরও আছে। বড়দের কোনো অপরাধ শিশুরা দেখে ফেলছে_ শুধু এ কারণেও তাদের প্রাণ যাচ্ছে। এমনও দৃষ্টান্ত আছে, জমিজমা বা কোনো কারণে প্রতিবেশী বা পরিচিতজনদের সঙ্গে বিরোধ, যার শিকার হচ্ছে শিশু।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন সমকালকে বলেন, সহজাতভাবে মানুষের রাগ-ক্রোধ নিম্নমুখী হয়। এসবের প্রকাশের জন্য তারা সহজ টার্গেট নির্বাচন করে। তাই দেখা যায় ছোটদের সঙ্গে নৃশংস আচরণ করে বড়রা রাগ-ক্রোধ প্রকাশ করে। এ ছাড়া আমাদের সমাজে এখন সব কিছুতে এক ধরনের প্রতিযোগিতার চাপ রয়েছে। যে চাপ অনেকের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বাধাগ্রস্ত করে। পারিবারিক ও সামাজিক নানা অসঙ্গতিও অনেকের মনের মধ্যে অশুভ ছায়া ফেলে। যার শিকার হয় শিশুরা। রাষ্ট্রের দায়িত্ব শিশুর জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা।

অধ্যাপক কামাল আরও বলেন, অর্থনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি মানসিকভাবে বিকাশের যে সঠিক পথ সেটা নিশ্চিত করা জরুরি। এর জন্য দরকার পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন আরও দৃঢ় করা। পশ্চিমা বিশ্বও এখন পারিবারিক বন্ধনের দিকে মনোযোগী হচ্ছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি মাহমুদা আফরোজ লাকী সমকালকে বলেন, শিশুদের ওপর অন্যায়-অবিচারের অভিযোগ পাওয়ার পরপরই তা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিশুরা নানা কারণে হত্যার শিকার হচ্ছে, যার জন্য তারা কোনোভাবে দায়ী নয়। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবার, অর্থাৎ সর্বস্তরেই শিশুরা প্রতিহিংসার বলি হচ্ছে। তবে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুরা বেশি যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। তাদের বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় তারা সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। শহরে শিশুর খেলাধুলার ভালো সুযোগও নেই। পারিবারিক অশান্তির কারণে অনেক মা-বাবা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর জীবন ও সন্তানের মায়া ত্যাগ করে তারা নিষ্ঠুর আচরণ করে বসেন। আবার শিশুকে নানা কৌশলে অপহরণ করে হত্যার পর লাশ গুম করাও অপরাধীদের পক্ষে সহজ হয়। আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে অনেক ক্ষেত্রে।

অনেকে বলছে, শিশুদের জন্য সুন্দর বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে চাইলে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন বাড়াতে হবে। অভিভাবকদের কাউন্সেলিং করাতে হবে। শিশুর নিরাপত্তা ও সুন্দর শৈশব নিশ্চিত করার ব্যাপারে উদাসীনতা দূর করতে হবে। অপরাধীদের বিচার দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করা জরুরি। শিশুদের মধ্যেও নানা বিষয়ে সচেতনতাবোধ সৃষ্টি করতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিশুর সঙ্গে মর্মান্তিক ঘটনার তালিকা লম্বা হলেও বিচার নিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা কম। অনেক মামলা বছরের পর বছর ঝুলে আছে। কোথাও আছে তদন্তে গড়িমসি, কোথাও বিচারের জন্য অপেক্ষা বছরের পর বছর। তবে সিলেটের রাজন ও খুলনার রাকিব হত্যা মামলার দ্রুত বিচার শেষ হয়েছে। তা অন্যান্য ঘটনায় বিচারপ্রার্থীদের আশান্বিত করেছে।

আলোচিত কিছু ঘটনা :২০১৬ সালে রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় দুই শিশুসন্তানকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন তাদের মা মাহফুজা আক্তার। তদন্তে বেরিয়ে আসে, সন্তানদের লেখাপড়ার বিষয় নিয়ে অতিমাত্রায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন তিনি। তা থেকে একপর্যায়ে তিনি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। দুই সন্তানকে হত্যা করে দুশ্চিন্তা থেকে 'মুক্তি' পেতে চাইতেন। বনশ্রীর ঘটনায় মাহফুজাকে আসামি করে পুলিশ চার্জশিট দিয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নরসিংদীর সদর উপজেলায় মেজো ভাইয়ের হাতে খুন হয় ইয়াসিন মিয়া (১০), মরিয়ম বেগম (৭) ও মাহিয়া বেগম (৫) নামের তিন ভাইবোন। ওই মাসেই কুমিল্লার রসুলপুর এলাকায় সৎভাইয়ের হাতে মেহেদী হাসান জয় (৮) ও মেজবাউল হক মনি (৬) নামের দুই ভাই খুন হয়। একই মাসে চাঁপাইনবাবগঞ্জে স্বর্ণালঙ্কারের লোভে প্রতিবেশী লাকী আক্তার খুন করে মেহাজাবিন আক্তার মালিহা ও সুমাইয়া খাতুন মেঘলা নামের দুই শিশুকে। চলতি মাসের ৮ জুন যশোরের মনিরামপুরে আল-আমিন নামে এক শিশুকে হত্যা করা হয়। এছাড়া ৭ জুন নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজারে স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।

২০১৫ সালের রাজধানীর খিলক্ষেতে কবুতর চুরির অপবাদ দিয়ে নাজিমুদ্দিন নামের এক শিশুকে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনার ভিডিও ফুটেজও ধারণ করা হয়। এ ছাড়া ২০১৬ সালের জুলাইয়ে সিলেটে চুরির অপবাদ দিয়ে রাজন নামের এক শিশুকে হত্যা করা হয়। একই বছরে কেরানীগঞ্জে মুক্তিপণের টাকা না পেয়ে আবদুল্লাহ নামের এক শিশুকে হত্যা করে হাত-পা বেঁধে লাশ ড্রামের ভেতরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। ২০১৫ সালে মাদারীপুরে ধর্ষণের পর বিষ খাইয়ে দুই শিশুকে হত্যা করা হয়। এগুলো শিশুদের ওপর ধারাবাহিক নিষ্ঠুরতার কয়েকটি নমুনামাত্র। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটে চলেছে এমন বর্বরতা। সংবাদমাধ্যমে যার বিবরণ দেখে শিউরে ওঠেন সবাই। কিন্তু নৃশংসতা থামছেই না।

http://bangla.samakal.net/2017/06/11/300008#sthash.9R08RLHP.dpuf