১০ জুন ২০১৭, শনিবার, ৮:৫৪

উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে নারী ও শিশু নির্যাতন

দেশে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে দেশে প্রায় দেড় হাজার ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৫৮টি ধর্ষণ ও ৫৫টি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ১৫টি ও ধর্ষণচেষ্টার ৬০টি ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এ তথ্য জানিয়েছে। পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের প্রথম চার মাসে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, নারী ও শিশু পাচার, যৌন নিপীড়ন, আত্মহত্যা, বাল্যবিবাহ, অপহরণ ছাড়াও বিভিন্নভাবে এক হাজার ৫৬৬টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৫৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৬২, মার্চে ৭১ ও এপ্রিল মাসে ৬৭ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
অন্যদিকে, ২০১৬ সালের হিসাবমতে, গত বছর ৮৪০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে বছরের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি থেকে এপ্রিল) ২৮০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া এ বছরের জানুয়ারি মাসে ১৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৩, মার্চে ১৪ ও এপ্রিলে ১৪ নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
২০১৬ সালে মোট গণধর্ষণের ঘটনা ছিল ১৬৬টি। এর মধ্যে বছরের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি থেকে এপ্রিল) ৪১ নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন বলে মহিলা পরিষদের তথ্যে জানা গেছে।
মহিলা পরিষদ জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে চারজন, ফেব্রুয়ারিতে চারজন, মার্চে তিনজন ও এপ্রিলে চার নারীকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৬ সালের প্রথম চার মাসে এমন ঘটনার সংখ্যা ছিল পাঁচটি। গত বছর ৪৪ নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম চার মাসেই যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ৫৬টি। এর মধ্যে জানুয়ারিতে পাঁচ, ফেব্রুয়ারিতে ১৩, মার্চে নয় ও এপ্রিল মাসে ২৯ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২০১৬ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫১।
আশঙ্কাজনক হারে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কয়েক বছর ধরেই তা বেড়ে চলেছে।
এই অধ্যাপক আরো বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেকোনো মামলার রায় হতে দীর্ঘ সময় লাগে। ফলে কোনো মেয়ে যদি ধর্ষণের শিকার হয়ে মামলা করে, বিচারের এই দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে সে সমাজ, পরিবারের কাছে নানাভাবে অবহেলা-হয়রানির শিকার হয়। এতে করে অনেকের পক্ষেই শেষ পর্যন্ত মামলাটি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। ফলে সমাজে ধর্ষণের বিচার দৃশ্যমান হয় না।
তিনি এও মনে করেন আসলে আমাদের দেশে প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যোগসাজশে অপরাধ কর্মকাণ্ডকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, যার ফলে সঠিক বিচার হয় না। নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার এও একটি অন্যতম কারণ।
নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার প্রকাশিত পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, পারিবারিক ও সামাজিক নৃসংশতার বিষয়টি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে যা উদ্বেগজনক। শিশু হত্যা, শিশু ধর্ষণ, গণধর্ষণ, পারিবারিক ও সামাজিক কোন্দলে আাহত ও নিহত, নারী নির্যাতন, রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাগুলি ছিল উল্লেখযোগ্য এ মাসে।
ধর্ষণ : মে মাসে মোট ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৪ জন নারী ও শিশু। এদের মধ্যে শিশু ৩২ জন। ২৮ জন নারী। ১২ জন নারী গণধর্ষণের শিকার হন ও ২ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। গত পাঁচ মাসের মধ্যে এই মে মাসেই ধর্ষণের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী। এই মাসে সভারে গণধর্ষণের শিকার হয় এক পোশাক শ্রমিক। যশোরে এক হোটেল কর্মীকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে তিন কিশোর।
আত্মহত্যা : মে মাসে সারা দেশে আত্মহত্যা করেছে ৫৪ জন। এদের মধ্যে ২০ জন পুরুষ ও ৩৩ জন নারী ও ১ জন শিশু। পারিবারিক দ্বন্দ্ব, প্রেমে ব্যর্থতা, অভিমান, রাগ ও যৌন হয়রানি, পরীক্ষায় খারাপ ফল, এমনকি পছন্দের পোশাক কিনতে না পারার কারণেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। ঢাকা বিভাগে আত্মহত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশী।
শিশু হত্যা : মে মাসে ২৭ শিশুকে হত্যা করা হয়। নির্যাতনের শিকার হয় ৪৯ জন। এদের মধ্যে পিতা মাতা কর্তৃক খুন হয় ৪ শিশু। ময়মনসিংহের এিশালে এক সঙ্গে ৪২ শিশুর চুল কেটে দেয় এক স্কুল শিক্ষক। নাটোরে আড়াই বছরের এক শিশুকে হত্যা করে প্রতিবেশী।
যৌতুক : মে মাসে যৌতুকের কারণে প্রাণ দিতে হয়েছে ৫ জন নারীকে। নির্যাতনের শিকার হয় ৩ জন। বগুড়ার শিবগঞ্জে যৌতুক না পেয়ে পিটিয়ে অচেতন করে স্ত্রীকে ঘরের মেঝেতে জীবন্ত কবর দেয়ার চেষ্টা করে পাষন্ড স্বামী। রাজধানীতে ১০ লাখ টাকা যৌতুকের দাবিতে ফাতেমা নামে এক গৃহবধূকে হত্যা করে স্বামী।
পারিবারিক কলহ : পারিবারিক কলহে মে মাসে নিহত হন ৪৬ জন, এদের মধ্যে পুরুষ ১৮ জন, নারী ২৮ জন। এদের মধ্যে স্বামীর হাতে নিহত হন ১৯ জন নারী। আর স্ত্রীর হাতে নিহত হন ৮ জন স্বামী । পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, রাগ, পরকীয়া সহ বিভিন্ন পারিবারিক কারণে এই সব মৃত্যু সংগঠিত হয় বলে জানা গেছে। চট্ট্রগ্রামের মিরসাইয়ে পারিবারিক কলহে ছেলের হাতে নিহত হয় বাবা।
সামাজিক অসন্তোষ : সামাজিক অসন্তোষের শিকার হয়ে এই মাসে নিহত হয়েছেন ১৮ জন। আহত হয়েছেন ৪০৩ জন। সামাজিক সহিংসতায় আহত ও নিহতের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। নরসিংদিতে এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিহত হন ১ জন। এ ঘটনায় আহত হয় ২০।
অন্যান্য সহিংসতার ঘটনা- মে মাসে ২ জন এসিড নিক্ষেপের শিকার হয়। মাদকের প্রভাবে বিভিন্ন ভাবে নিহতের সংখ্যা ৩জন, আহত হয় ৩ জন। সড়ক দুর্ঘটনায় এ মাসে নিহত ১৮৫ ও আহত ৩৮৯ জন। তাছাড়া পানিতে ডুবে, অসাবধানবশত, বিদ্যুৎপৃস্ট হয়ে, বজ্রপাতে মৃত্যুবরণ করেছে ৬৬ জন। গণপিটুনিতে নিহত হয় ২ ,আহত হয় ৩ জন। চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয় ৪ জনের। জঙ্গি ও সন্ত্রাসী দমন অভিযানের নামে গণ গ্রেফতার করা হয় ২২৮ জনকে।

http://www.dailysangram.com/post/287498-