পুলিশের গাড়িও চলে রং সাইডে
৯ জুন ২০১৭, শুক্রবার, ১১:০৫

অরণ্যে রোদন

‘রং সাইডে যাবই, তুই কে?’

|| আনিসুল হক ||

পুলিশের গাড়িও চলে রং সাইডে‘আমি রং সাইডে যাবই, তুই আটকানোর কে?’ এই শিরোনামের একটা খবর প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোয়, ৭ জুন, লিখেছেন শরিফুল হাসান। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যার সময় মগবাজার ওয়্যারলেসের রাস্তায় একটা গাড়ি উল্টো দিক দিয়ে এগোতে থাকলে পুলিশ কর্তারা বাধা দেন। একসময় গাড়ি থেকে মালিক বের হয়ে এসে পুলিশকে তীব্র গালিগালাজ করতে থাকেন, আর বলেন, ‘আমি রং সাইডে যাবই, তুই আটকানোর কে?’
পুলিশের উপপরিদর্শককে যিনি গালিগালাজ করেছেন, তিনি আওয়ামী লীগের থানা কমিটির সভাপতি।
কতগুলো প্রশ্ন মাথায় আসছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা না হয়ে একেবারেই সাধারণ কোনো নাগরিক যদি এই নিয়মভঙ্গের কর্মটি করতেন, তাহলে তিনি কি এই রকম চোটপাট করতে পারতেন? করলে পুলিশ কি তাকে ছেড়ে দিত?
‘রং সাইড’ কথাটার মধ্যেই ‘রং’ কথাটা জ্বলজ্বল করছে। তার মানে এটা রাইট সাইড নয়, ভুল সাইড, অন্যায় সাইড। মানুষমাত্রই ভুল করে, যেকোনো মানুষ বেআইনি বা বেঠিক কাজ করতে পারে। কিন্তু অন্যায় করার সময় তিনি যদি আইনানুগ কর্তৃপক্ষের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন, তাহলে তিনি অনুতপ্ত হবেন, না হম্বিতম্বি করবেন? আমরা প্রায়ই শুনি: ‘আমাকে চিনিস?’ বা ‘জানিস, আমি কে?’ শুনলেই বুকটা কেঁপে ওঠে, বাপরে, কে না কে। তাই তো, অপরপক্ষ সাংঘাতিক কেউকেটা হতে পারেন, তিনি হতে পারেন ভূমিদস্যু, ব্যাংক লুটেরা, পুলিশের বড় স্যারের শ্যালক, এমপি, মন্ত্রী, কিংবা তাঁদের পিএসের ভাগনে। তিনি হতে পারেন বিশাল সাংবাদিক, স্থানীয় কলেজের ছাত্র বা ছাত্রনেতা, ভার্সিটির ‘স্টুডেন্ট’, হতে পারেন আইনজীবী, পেশাজীবী, হকার্স মার্কেটের নেতা, আনসার বাহিনীর সদস্য, শ্রমিক ইউনিয়নের সভ্য, পেশাজীবী ইউনিয়নের সভাপতি, হতে পারেন টক শো-টকার কিংবা কলাম লেখক। এঁদের যে কেউ বলতে পারেন, জানিস, আমি কে? এদের প্রত্যেকেরই আছে ‘ক্ষমতা’।
নিজেকে দিয়েই উদাহরণ দিই (অন্যের উদাহরণ দিতে ভয় লাগে, হয়তো ধরে বসবে)। আমার ক্ষমতা হলো, আমার আছে কলম, আর কে না জানে, পেন ইজ মাইটিয়ার দেন সোর্ড, অসির চেয়ে মসি বড়। লিখে দেব দুই কলম, অমনি ‘বাপ’ ‘বাপ’ বলে মাফ চাইবে আমার অন্যায় কর্মে বাধা দানকারী কোনো ন্যায়সাধক। আমারও যথেষ্ট শালীন যুক্তি থাকবে, তা হলো, আমি বেআইনি কাজ করেছি, আইনের চোখে তা অপরাধ হলে তা প্রতিবিধানের আইনানুগ পন্থা আছে, পুলিশ কেন আমার দিকে চোখ গরম করে তাকাল, কেন সে আমার ড্রাইভারকে গালি দিল ইত্যাদি। আর যেহেতু মন্ত্রীরা আমার ভাই, পুলিশের বড় কর্তা আমার ইয়ার দোস্ত, ওই ক্ষুদ্র পুলিশ সদস্যকে আমি দেখে নেবই। এই হলো আমার ‘ক্ষমতা’।
তার মানে, ক্ষমতা কি তাহলে অন্যায় করে পার পেয়ে যাওয়ার অধিকার? অন্যায় করার পর হম্বিতম্বি করার যোগ্যতা? ক্ষমতা, ক্ষমতার বৈধতা, ক্ষমতা-সম্পর্ক নিয়ে লাখ লাখ পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে। ক্ষমতা যখন বৈধ হয়, তখন তা ক্ষমতা। ক্ষমতা যখন অবৈধ হয়, তখন তা সন্ত্রাস। পুলিশ যখন আইনানুগভাবে কাউকে আটক করে, তখন সেটা ক্ষমতারই প্রয়োগ মাত্র, কিন্তু একজন অপহরণকারী যদি কাউকে আটক করে এবং নিজের বানানো দুর্গে আটকে রাখে, সেটা হলো সন্ত্রাস।
আমরা সবাই ক্ষমতার স্বাদ পেতে চাই, অনেকেই ক্ষমতা পেলেই রং সাইডে যাই, অন্যায়-অনিয়ম করি। উল্টো দিকে গাড়ি চালানোর কথাই ধরুন। উল্টো দিকে গাড়ি চালাতে দেখেছি মন্ত্রীদের, সাংবাদিকদের, এমপিদের, ফোর হুইল ড্রাইভ দামি গাড়িওয়ালাদের, পতাকা স্ট্যান্ডওয়ালা গাড়ির চালকদের, উল্টো পথে চলতে দেখেছি পুলিশের গাড়িকে, টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতীকসংবলিত গাড়িকে, অসংখ্য মোটরসাইকেলকে এবং একাধিক স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় দোতলা বাসকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি উল্টো দিকে যাবে, এটা তাদের অধিকার, এটা আমরা মেনে নিয়েছি। কারণ, তাদের ক্ষমতা আছে। তাদের বাধা দিলে বাধবে লড়াই, আর সে লড়াইয়ে কেউ জিততে পারবে না, সরকার না, পুলিশ না, সাংবাদিক না। কাজেই ওদের যেতে দাও। পুলিশ কিংবা ছাত্রদের গাড়ি রং সাইডে যেতে দেখলে সেটাকে কেউ প্রতিবাদযোগ্য কিংবা নিবারণযোগ্য বলে ভাবেও না।
বাংলাদেশ বহুদিন গরিব ছিল, উপনিবেশিত ছিল। এখানে মানুষ বেশি, সম্পদ কম, তাই আমরা ‘অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম’ আর ‘যোগ্যতমের ঊর্ধ্বতন’—এই দুই নিয়মে চলতে শিখেছি। কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরিয়ে দিতে হবে, তাহলেই কেবল আমি জয়লাভ করব, টিকে থাকতে পারব। আপনি নিয়ম মেনে গাড়ি চালালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকবেন, আর ৪০ গজ রং সাইডে গেলেই দুই ঘণ্টা সময় বাঁচিয়ে নিতে পারবেন। এখন আপনিই ঠিক করুন, আপনি কী করবেন। হ্যাঁ, যদি সবাই নিয়ম মানত, যদি কেউ অজায়গায় গাড়ি পার্কিং না করত, বাসগুলো যেখানে-সেখানে না থামত, ফুটপাত ও রাস্তার অনেকটা বেদখল না থাকত, পুলিশও ট্রাফিক সিগন্যাল মানত এবং আধা ঘণ্টা পরপর লিখিত বা অলিখিত প্রটোকল নিয়ে ভিআইপিরা চলাচল করে কোনো একটা দিকের পথ রুদ্ধ করে না দিত, তাহলে হয়তো আইন মানাটা সবার জন্যই লাভজনক হতো। কিন্তু এখানে ভিআইপিদের জন্য রাস্তা বন্ধ করে আগে-পিছে লাল বাতির লাঠিওয়ালা পুলিশ ভেঁপু বাজিয়ে চলে যায়, আর লাখ লাখ অগুরুত্বপূর্ণ নাগরিক ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে থাকে। কাজেই এই দেশে টিকে থাকতে কিছু চালাকি করতেই হবে। এটা শুধু আওয়ামী লীগের থানা সভাপতি করেন বা গাড়ির সামনে পেশা বা পদের পরিচয় লাগানো ব্যক্তিরা করেন বা ছাত্ররা করে তা-ই নয়, সুযোগ পেলে রিকশাওয়ালারাও করে থাকেন। রিকশাওয়ালারা তো ভিআইপি নন, তাঁরা কেন এ রকম করেন?
ক্ষমতাসংক্রান্ত এই কথাটা নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে: পাওয়ার টেন্ডস টু করাপ্ট, অ্যাবসোলুট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসোলুটলি। ক্ষমতার প্রবণতা হলো দুর্নীতিগ্রস্ত করা, আর চরম ক্ষমতা চরমভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে। আমরা পাঁচ বছরের জন্য দেশ চালানোর জন্য যাঁদের নির্বাচন করি, তাঁরা আইন দ্বারা সংজ্ঞায়িত ক্ষমতা লাভ করেন, তাঁরা সেই ক্ষমতা রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রশাসনযন্ত্রের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্বারা প্রয়োগ করেন। ক্ষমতা স্তরে স্তরে বিন্যস্ত থাকে। আবার কোনো প্রতিষ্ঠানেরও ক্ষমতা থাকে, একজন হেডমাস্টারের ক্ষমতা থাকে, একজন শিক্ষকেরও কিছু ক্ষমতা থাকে। ক্ষমতাসীন দলের থানা কমিটির সভাপতির কাগজ-কলমে কোনো ক্ষমতা নেই, কিন্তু বাস্তবে যে প্রভূত ক্ষমতা আছে, তা যেকোনো বাস্তববাদী মানুষই স্বীকার করে নিতে বাধ্য। তিনি উল্টো দিকে গাড়ি চালানোর মাধ্যমে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চাইলে আমরা বিস্মিত হই না।
গবেষকেরা বলছেন, ক্ষমতামাত্রই দুর্নীতি করে না, সব ক্ষমতা খারাপ নয়। ভালো ক্ষমতাও আছে। তবে ক্ষমতার একটা বৈশিষ্ট্য হলো, ক্ষমতাধর লোকেরা নিজের চারপাশে তাঁদেরই রাখেন, যাঁরা তাঁদের মন জুগিয়ে কথা বলেন। তাঁরা যখন কোনো অন্যায় করেন, কেউ তার প্রতিবাদ করেন না, কেউ তাঁদের সুবুদ্ধি দেন না। কেউ যদি সুবুদ্ধি দেনও, ক্ষমতাবানেরা সেটা পছন্দ করেন না, সেই ভিন্নমত বা সমালোচনাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা সাধারণত তাঁরা করে থাকেন। আব্রাহাম লিংকন একটা কথা বলেছেন, ‘প্রায় সব মানুষই বিরূপতা সহ্য করতে পারে, কিন্তু যদি কোনো মানুষের চরিত্র তুমি পরীক্ষা করতে চাও, তাকে ক্ষমতা দিয়ে দেখো।’
গত বইমেলায় কিশোর-তরুণদের জন্য একটা বই লিখেছি। নাম এক লক্ষ লাইক। তাতে এক তরুণ সমাজের নানা অসংগতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করে। ভিআইপি নামধারীদের রং সাইডে যাওয়া বন্ধ করতে সে একটা যন্ত্র তৈরি করে। রাস্তায় এমন একটা ফাঁদ সে বসায়, যাতে উল্টো দিকে গাড়ি গেলেই টায়ারে পেরেক ঢুকে যায়। সত্যি সত্যি এই যন্ত্র ঢাকায় আনা হয়েছিল, শেরাটন হোটেলের পাশের রাস্তায় বসানোও হয়েছিল। পরে পুলিশ সেটা সরিয়ে নিয়ে নিজের এবং দেশের মান বাঁচিয়েছে। কারণ, সব ভিআইপি গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স রং সাইড দিয়ে যাচ্ছিল এবং সেসবের টায়ার ফেটে যাচ্ছিল।
আমাদের ক্ষমতাবানেরা কবে বৈধ ক্ষমতাটুকুই কেবল বৈধভাবে প্রয়োগ করা শিখবেন?
আমরা যখন সভ্য হব, গণতান্ত্রিক হব, তখন যদি কেউ বলে, আমি রং সাইডে যাবই, দেখি তুই কী করতে পারিস, তখন পুলিশ তাকে বলবে, আমি রাষ্ট্র কর্তৃক আইনগতভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত, তোমার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা আমি নিতে পারি এবং তাই নিচ্ছি।
কিন্তু কথাটা এই যে রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। তবে আমাদের গণতন্ত্র এমনি যে মালিকই বাড়িছাড়া, ক্ষমতাহারা প্রায়। কেয়ারটেকার আর পাহারাদারেরাই মালিক বনে গেছেন। এবং সূর্যের চেয়ে বালুর তাপ বেশি। দেশের সবখানে নানা ধরনের লীগ, সমর্থক গোষ্ঠী, পরিষদ, তাদের পাড়া কমিটি, শাখা কমিটির অগণিত সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, আহ্বায়ক। তাঁদের তাপে রাস্তার মাটি তপ্ত কড়াই, জনগণের পা সেখানে পড়ামাত্রই পুড়ে যেতে বাধ্য। ৮ জুনের প্রথম আলোয় খবর আছে, যশোরে জেলা ছাত্রলীগের পাঠাগারবিষয়ক সম্পাদকের মোটরসাইকেল আটক করায় ট্রাফিক পুলিশ কার্যালয়ে ঢুকে মারধর করেছে ছাত্রলীগের ছেলেরা। বুঝুন অবস্থা। বলতে পারেন, আপনারাই বুঝুন, আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝি।
কবে যে আমরা সভ্য হব, গণতান্ত্রিক হব!
বহু বছর আগে কনফুসিয়াসকে জিলু জিজ্ঞেস করেছিল, রাজপুত্রের সেবায় করণীয় কী? কনফুসিয়াস উত্তর দিয়েছিলেন, তার কাছে সত্য উদ্‌ঘাটন করবে। তাতে তিনি যদি অসন্তুষ্ট হন, তবু।
একজন সভাপতি আর একজন পাঠাগারবিষয়ক সম্পাদকের ওপরে বর্ণিত কীর্তি হিমশৈলের চূড়ার সামান্য আভাস মাত্র! পানির নিচে হিমশৈলের বেশির ভাগটাই ডুবে আছে, পানিই যেমন তার সবচেয়ে ভালো জানে, পানির মতো ছড়িয়ে থাকা জনগণও তা খুব ভালোভাবেই টের পায়।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

http://www.prothom-alo.com/opinion/article/1210321/