৭ জুন ২০১৭, বুধবার, ১০:৫৯

সড়কে লাশের মিছিল বাড়ছেই

|| এবছর ৪ মাসে আগের বছরের তুলনায় সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ১১ শতাংশ
||দুর্ঘটনা কমাতে প্রতিবছরের জন্য আলাদা লক্ষ্য ঠিক করে কর্মসূচি নেয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
জাতিসংঘে বাংলাদেশসহ সদস্য দেশগুলো অঙ্গীকার করেছিল ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, গত বছর (২০১৬ সালে) সড়ক দুর্ঘটনায় দিনে গড়ে ২৪ জন মারা গেছেন। এর আগের কয়েক বছরের চিত্র প্রায় একইরকম। অবশ্য পুলিশের হিসাবে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান গড়ে ৬ জন।
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির জরিপে বলা হয়, চলতি বছরে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল সারা দেশে মোট ১হাজার ৩শ’৭২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪২১ নারী-শিশুসহ কমপক্ষে ১৫৫২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ৩৮৩২ জন। বিভিন্ন সড়ক, মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কে এসব দুর্ঘটনা ঘটে।
মে মাসে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। তাদের মধ্যে ৫২ জন নারী ও ৫৮ জন শিশু রয়েছে। এমাসে সংঘটিত ৩৪৬টি দুর্ঘটনায় আহত হন ১ হাজার ১৬ জন। সে হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় গত মাসে দৈনিক ১৩ জন নিহত ও ৩৩ জন আহত হয়েছেন। এই মাসে প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটেছে ১১টি। ১ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত বিভিন্ন সড়ক, মহাসড়ক, জাতীয় সড়ক ও আঞ্চলিক সড়কে এসব প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটে। হিসেব বলছে, সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের হার এপ্রিল মাসের তুলনায় মে মাসে বেড়েছে।
২০১৬ সালের একই সময় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ১২৩৬টি। এতে ৩৮৩ নারী-শিশুসহ ১৩১৪ জন নিহত ও ৩৩৯৩ জন আহত হন। এই হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনার হার গত বছরের তুলনায় এ বছর ১১ শতাংশ বেড়েছে। আর নিহত ও আহতের হার বেড়েছে যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৮২ শতাংশ ও ১২ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
২২টি বাংলা ও ইংরেজি জাতীয় দৈনিক, ১০টি আঞ্চলিক সংবাদপত্র এবং আটটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও সংবাদ সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অবশ্য দাবি করেছেন, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ক্রমান্বয়ে কমছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে অতিরঞ্জিত পরিসংখ্যান প্রকাশ করে, যা বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে জাতিসংঘের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ সই করেছে। বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব সড়ক পরিবহন, স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকারসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের।
এসব মন্ত্রণালয় কোন বছর কত সড়ক দুর্ঘটনা কমানো হবে, এর কোনো কর্মপরিকল্পনা হয়নি। কিছু সড়কের বাঁক সোজা করা এবং মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ছাড়া সরকারের দৃশ্যমাণ কোনো উদ্যোগ নেই।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে ২০১৬ সালে সারা দেশে দুই হাজার ৩১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ১৪৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হন পাঁচ হাজার ২২৫ জন।
২০১৫ সালে সারা দেশে ৬ হাজার ৫৮১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৮ হাজার ৬৪২ জন। আহত হন ২১ হাজার ৮৫৫ জন।
২০১৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছিল ৫ হাজার ৯২৮টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৮ হাজার ৫৮৯ জন। আর আহত হয়েছিলেন ১৭ হাজার ৫২৪ জন।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ২০ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৬ সালে ২ হাজার ৫৬৬টি দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৪৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে ২ হাজার ১৩৪ জন। ২০০৯ সালের হিসাবে ৩ হাজার ৩৮১টি দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৯৫৮ জন নিহত ও ২ হাজার ৬৮৬ জন আহত হয়।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার নামে ধারাবাহিক হত্যাকা- মহামারি আকার ধারণ করেছে। ইরাক বা আফগানিস্তানের ভয়াবহ যুদ্ধে যে প্রাণহানি হয়েছে, বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনা পরিস্থিতি তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু বিষয়টি যেন গা সওয়া হয়ে গেছে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ মতে, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ফুটপাত দখল, ওভারটেকিং, ওভারস্পিড ও ওভারলোড, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রুটি, গাড়ির ত্রুটি, যাত্রীদের অসতর্কতা, ট্রাফিক আইন না মানা, গুরুত্বপূর্ণ সড়কের ক্রসিংয়ে জেব্রা ক্রসিং না থাকা এবং জেব্রা ক্রসিং গাড়িচালক কর্তৃক না মানা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার করা, মহাসড়কে স্বল্পগতি ও দ্রুতগতির যান একই সঙ্গে চলাচল, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো এবং মহাসড়ক ক্রসিংয়ে ফিডার রোডের যানবাহন উঠে যাওয়াই দায়ী।
বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ যানবাহনের মধ্যে ফিটনেসবিহীন যানবাহন রয়েছে ৩ লাখের বেশি। আর যেসব যানবাহনের ফিটনেস আছে, সেগুলোও যথাযথভাবে নেয়া হয় না। কারণ, ৪০ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটি যানবাহনের সনদ দেওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ খালি চোখে একটু দেখেই ফিটনেস দিয়ে দেয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিটনেস সনদ দেয়ার যন্ত্র বিকল হয়ে আছে এক যুগ ধরে।
দেশে চালকের লাইসেন্স আছে সাড়ে ১৫ লাখ। এরও একটা বড় অংশ দেয়া হয়েছে যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া, শ্রমিক ইউনিয়নের দেয়া তালিকা ধরে। অর্থাৎ প্রায় আট লাখ যানবাহনের কোনো চালক নেই। অথচ বাণিজ্যিক যানবাহনের প্রতিটির জন্য দু’জন চালক দরকার হয়।
মন্ত্রীর দেয়া তথ্য মতে দেশে এখন ৩০ লাখ ৮ হাজার ২৫৭টি মোটরযান আছে। এর মধ্যে বাস ৩৯ হাজার ৯৪৫টি, মিনিবাস ২৭ হাজার ১১৮টি, ট্রাক ১ লাখ ১৯ হাজার ৮০৪টি, লরি ৪ হাজার ৬৬৪টি এবং প্রাইভেটকার আছে ৩ লাখ ১০ হাজার ৮২১টি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে প্রতিবছরের জন্য আলাদা লক্ষ্য ঠিক করে কর্মসূচি নিতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের পরিকল্পনা সম্পর্কে তার জানা নেই।

http://www.dailysangram.com/post/287026-