৭ জুন ২০১৭, বুধবার, ১০:৫৬

বিমান ও নৌপথের কার্গোতে ইইউর নিষেধাজ্ঞা

বাংলাদেশকে উচ্চমাত্রার ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত

এবার রফতানি পণ্যবাহী বিমানের কার্গো ফ্লাইট ও নৌপথেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ফলে বাংলাদেশ থেকে বিমানও নৌপথে কোনো কার্গো সরাসরি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে প্রবেশ করতে পারবে না। নিরাপত্তার স্বার্থে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরামর্শমতো যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়ায় নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ল বাংলাদেশ। মঙ্গলবার ইইউর উচ্চপর্যায়ের টিম বাংলাদেশ সফরে এসে সরাসরি কার্গো রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ইইউর টিম বাংলাদেশকে সরাসরি কার্গো রফতানির ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
নিষেধাজ্ঞার ফলে বছরে ৩০ হাজার চারশ’ কোটি টাকার পণ্য রফতানি হুমকির মুখে পড়েছে। দেশের ভাবমূর্তি ব্যাহত হবে। বিমানের ব্যবসায় ধস নামতে পারে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। তবে অন্য দেশের মাধ্যমে রি-স্ক্যানিং করে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে কার্গো রফতানি অব্যাহত থাকবে। এর আগে গত বছরের মার্চে যুক্তরাজ্য-অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানি ঢাকা থেকে বিমানের সরাসরি কার্গো ফ্লাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করছিল।
বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেছেন, শাহজালালে র্যাব ও বিজিবির ডগ স্কোয়াড কাজ করছে। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন দিয়েও ডগ স্কোয়াড নামানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। শুধু এক্সপ্লোসিভ ডিটেনশন সিস্টেম (ইডিএস) মেশিনটি বসানো সম্ভব হয়নি। তারপরও ইইউ এ রকম শর্ত দিয়েছে। তিনি বলেন, ইইউর এ সিদ্ধান্ত দেশের ওপর বড় ধরনের আঘাত। এটা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে বলে তিনি মনে করছেন।
জানা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন ও বিমানকে যে চিঠি দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে সরাসরি কোনো কার্গো পণ্য তারা তাদের দেশগুলোতে প্রবেশ করতে দেবে না। এক্ষেত্রে সব পণ্য ইইউভুক্ত সিভিল এভিয়েশন অনুমোদিত দ্বিতীয় কোনো দেশ থেকে রি-স্ক্যানিং করে নিতে হবে।
অপ্রতুল নিরাপত্তা ও বহিরাগতদের অবাধ প্রবেশের অজুহাতে বিমানে কার্গো নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তারা জানিয়েছে, বিমানের কার্গো রফতানি টার্মিনালটি বহিরাগত জনবল দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এসব জনবল নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও জার্মানিও অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও জনবলের অভাবকে দায়ী করে। একই সঙ্গে তারা পণ্য স্ক্যানিংয়ে বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের গাফিলতি ও অবহেলাকে দায়ী করে আসছে। বাংলাদেশের রফতানির বৃহত্তম গন্তব্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ অবস্থায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের কার্গো ফ্লাইট বন্ধ করায় বিমানকে বড় ধরনের মাসুল গুনতে হবে। একই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমে আসবে। এতে ঝুঁকির মুখে পড়বে তৈরি পোশাকসহ রফতানিমুখী বেশ কিছু পণ্য।
জানা গেছে, মাত্র ১৬ কোটি টাকা বাঁচাতে গিয়ে বিমান এত বড় সমস্যায় পড়ল। এক বছর আগে সিভিল এভিয়েশনকে উচ্চ মাত্রার স্ক্যানিং মেশিন, এক্সপ্লোসিভ ডিটেনশন সিস্টেম (ইডিএস) স্থাপন ও ডগ স্কোয়াডের জন্য ৯০ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছিল সরকার। কার্গো কমপ্লেক্সে উচ্চ পর্যায়ের স্ক্যানিং মেশিন বসানোর জন্য বারবার তাগিদ দেয়া হয়। কিন্তু প্রথম দফায় প্রাক্কলিত ব্যয় ১৬ কোটি টাকা বেড়ে যাওয়ায় ওই টেন্ডার বাতিল করা হয়। প্রথম দফায় প্রাক্কলিত ব্যয় দাঁড়ায় ১০৬ কোটি টাকা। পরে দ্বিতীয় দফায় টেন্ডার করতে গিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শর্ত অনুযায়ী যথাসময়ে এক্সপ্লোসিভ ডিটেনশন সিস্টেম (ইডিএস) ক্রয় করা সম্ভব হয়নি। এ কারণ দেখিয়ে মঙ্গলবার ইইউর উচ্চ পর্যায়ের টিমটি সরাসরি কার্গো রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
জানা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর আগে সিভিল এভিয়েশনকে বিমানের কার্গো কমপ্লেক্সে দুটি উচ্চ মাত্রার স্ক্যানিং মেশিন বসানোর নির্দেশনা দিয়েছিল। এক্সপ্লোসিভ ডিটেনশন সিস্টেম (ইডিএস) নামের দুটি মেশিনের বাজার দর ৩০ কোটি টাকার বেশি হবে না। কিন্তু সিভিল এভিয়েশনের একটি চক্র তাদের পছন্দের কোম্পানি কাজ না পাওয়ায় এতদিন ধরে এই ইডিএস মেশিনটি ক্রয় করতে দেয়নি। নানা ছলচাতুরীর মাধ্যমে সময়ক্ষেপণ করে আসছিল। যার খেসারত হিসেবে এবার ইইউ এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। অভিযোগ আছে, রাডার নিয়েও সিভিল এভিয়েশনে সম্প্রতি একটি প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও দাম বেশি হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে রাডার প্রকল্পটি বাতিল করে দেয়া হয়।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে বছরে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলারের (১ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা) পণ্য রফতানি হচ্ছে। যার বড় অংশ হচ্ছে তৈরি পোশাক। এর মধ্যে বিমানে পরিবহন করা হয় ১৮ থেকে ২০ শতাংশ। টাকার হিসাবে এর পরিমাণ ৩০ হাজার চারশ’ কোটি টাকা। প্রথম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র আর দ্বিতীয় স্থানে আছে ইইউ। পাশাপাশি এ সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এসব নিয়ে বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের শীর্ষ কর্তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
এ প্রসঙ্গে সিভিল এভিয়েশনের পরিচালক ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশান উইং কমান্ডার চৌধুরী জিয়া উল কবির যুগান্তরকে বলেন, সরাসরি কার্গো ফ্লাইট বন্ধ করা প্রসঙ্গে ইইউ সিভিল এভিয়েশনকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো চিঠি দেয়নি। তবে তারা বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকার দেশগুলোতে অন্তর্ভুক্তির কথা জানিয়েছে। অর্থাৎ ইইউ কমিশন ইমফ্লিমেন্টেশন রেগুলেশন (ইইউ) ২০১৫/১৯৯৮ অনুযায়ী বাংলাদেশকে এটাচমেন্ট ৬-১ তে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ অন্তর্ভুক্তির ফলে ইউরোপীয় কমিশন ডিভিশন সি (২০১৫) ৮০০৫-এর আলোকে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো সব এয়ার কার্গো ও মেইল কনসাইনমেন্ট ‘হাই রিক্স কার্গো অ্যান্ড মেইল’ (এইচআরসিএম) হিসেবে বিবেচিত হবে। এতে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত যে কোনো দেশে আনলোড, ট্রানজিট অথবা ট্রান্সফারের উদ্দেশে বহনকৃত সব এয়ার কার্গো ও মেইল কনসাইনমেন্ট ইইউ নিয়ম অনুযায়ী এক্সপ্লোসিভ ডিটেনশন সিস্টেম (ইডিএস) মেশিনে অথবা শতভাগ এক্সরে স্ক্যানিং এবং শতভাগ এক্সপ্লোসিভ ট্রেস ডিটেনশন (ইটিডি) শতভাগ এক্সপ্লোসিভ ডিটেনশন ডগ স্কোয়াড (ইডিডি) মেশিনের মাধ্যমে তল্লাশি করে পাঠাতে হবে।
পরিচালক ফ্লাইট সেফটি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের শর্ত অনুযায়ী আগামী ২ মাসের মধ্যে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ বিমানের কার্গো কমপ্লেক্সে এক্সপ্লোসিভ ডিটেনশন সিস্টেম বসানোর কাজ সম্পন্ন করবে। ইতিমধ্যে এ সিস্টেমটির জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। যে কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে এ মেশিনটি ক্রয় করেছে। শিগগিরই সিস্টেমটি দেশে এসে পৌঁছাবে। তিনি আশা করছেন আগামী ২ মাসের মধ্যে দুটি ইডিএস মেশিন কার্গো কমপ্লেক্সে বসানো সম্ভব হবে।
পরিচালক ফ্লাইট অপারেশন বলেন, আরও ২ মাস আগে এ মেশিনটি বসানোর কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হতো। কিন্তু প্রথম দফায় যে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছিল তাতে বাজেটের চেয়ে টেন্ডার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় প্রথম টেন্ডার বাতিল করা হয়। এতে ২ মাস পিছিয়ে পড়ে সিভিল এভিয়েশন। তবে তিনি বলেন, বর্তমানে সিভিল এভিয়েশনে ৬টি ডুয়েল ভিউ এক্সরে স্ক্যানিং মেশিনসহ পর্যাপ্ত ইটিডি মেশিন রয়েছে। পাশাপাশি সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিএমপি, র্যাব, বিজিবির সহায়তায় স্বল্প পরিসরে এক্সপ্লোসিভ ডিটেনশন ডগ (ইডিডি) টিম মোতায়েন করা আছে। এছাড়াও বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধীন নতুন একটি এক্সপ্লোসিভ ডিটেনশন ডগ (ডগ স্কোয়াড) টিম গঠনের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন আছে। কাজেই তিনি আশা করছেন আগামী ২ মাসের মধ্যে ইডিএস মেশিন দুটি বসানো সম্পন্ন হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানসহ সব দেশ কার্গো রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিমানের কার্গো শাখায় কর্মরত অনেক কর্মীর বিরুদ্ধে চোরাচালানের অভিযোগ আছে। অনেকে একাধিক মামলার আসামি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্যাডার, স্থানীয় সন্ত্রাসী ও গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে। নামমাত্র স্ক্যানের পর এরা টার্মিনালে প্রবেশ করছে। একইভাবে স্ক্যান ছাড়াই অবাধে পণ্যসামগ্রীও বিভিন্ন এয়ারলাইন্সে উঠানো হচ্ছে। এ অবস্থায় কার্গো পণ্যের সঙ্গে বিস্ফোরক বা অন্য কোনো এক্সপ্লোসিভ বিমানের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়ার মতো আশঙ্কার কথাও বলা হয়েছে ইইউর রিপোর্টে। এছাড়া নিরাপত্তা শিথিলতায় কার্গো ফ্রেইটগুলো যেসব দেশের বিমানবন্দরে যাচ্ছে, সেখানে বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কাও করা হচ্ছে। এসব কারণে তারা বিমানে সরাসরি কার্গো নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
এফবিসিসিআইর সাবেক সহ-সভাপতি ও বিমানের সাবেক বোর্ড মেম্বার আবুল কাশেম আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, যুক্তরাজ্য অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানির পর এবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ থেকে আকাশপথে সরাসরি কার্গো নেয়া বন্ধ করে দেয়ায় চরম বিপাকে পড়বে তৈরি পোশাক খাত। আকাশপথে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস ও নমুনা পাঠানোর সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন বিকল্প পথে অন্য দেশের আশ্রয় নিতে হবে। তবে তিনি বলেন, ইইউ তৃতীয় দেশে রি-স্ক্যানিং করে পণ্য নেয়ার ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি।
বিমানের পরিচালক (মার্কেটিং) আলী আহসান বাবু যুগান্তরকে বলেন, ইইউ কার্গো রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পরও মঙ্গলবার তৃতীয় দেশে স্কানিং হয়ে কার্গো পণ্য গেছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। মঙ্গলবার প্রায় ২০ টন কার্গো পণ্য পাঠানো হয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। তিনি বলেন, শিগগিরই এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হবে। কারণ ইতিমধ্যে তাদের শর্ত অনুযায়ী ইডিএস মেশিন বসানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/06/07/130561/