৭ জুন ২০১৭, বুধবার, ১০:৩৩

...ঐ ভিখারীর চেয়ে বুদ্ধিমান কি মুহিত!

|| ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী || এ আলোচনা কোথা থেকে শুরু করবো বুঝে উঠতে পারছি না। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যে সুস্থ নেই, সেটা তার কথায় বারবার প্রমাণিত হয়েছে। কথা বলতে বলতে খেই হারিয়ে ফেলেন। কখন কী বলেন মনে রাখতে পারেন না। বিপদে পড়লে বলেন, বুড়ো মানুষ! আর এই অথর্ব লোকটার ধারণা হয়েছে, তার চেয়ে জ্ঞানী লোক এই পৃথিবীতে নেই। আর সে কারণেই ৪ লাখ কোটি টাকারও বেশি এক অবাস্তব অযৌক্তিক বাজেট ঘোষণা করে তিনি বলেন, তার জনমের সেরা বাজেট তিনি দিয়েছেন। কেন সেরা সে ব্যাখ্যা তার নেই। তাছাড়া কোনো ভদ্র ভব্য লোক কোনোদিন এভাবে নিজের কাজকে বিশ্বসেরা বলে ঢাক পেটায় না। বহু আগেই মুহিতের সে কা-জ্ঞান লুপ্ত হয়েছে। অনেকেই বলেছেন, এ বাজেট ভোটের বাজেট। ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য সরকার বাজেটের আকার সাধ্যের চেয়ে অনেক বেশি ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তৈরি করেছেন। এখানে লুটের লাইন যারা খুঁজে পাবেন, তারা সন্তুষ্ট হবেন। তারা মোট জনসংখ্যার তুলনায় নগণ্য। বাকি আম-জনতার জন্য এ বাজেট তাদের পকেট কাটার কৌশল মাত্র।
অর্থমন্ত্রী ২ জুন তার বাজেট পরবর্তী বক্তৃতায় বলেছেন, ‘আমি বক্তৃতায়ই বলেছি যে, প্রত্যেকটা বাজেটই উচ্চাভিলাষী। আগের বারের চেয়ে পরের বার কম হয়েছে, এমন বাজেট একটাও নেই। এ কাজটা আমরা সার্থকভাবে করেছি। এভাবেই ধাপে ধাপে দেশটাকে উন্নততর জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি।’ এরপর সাংবাদিকরা তাকে নানা প্রশ্ন করেন। তারা বলেন, গৃহস্থালি পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাজেট ঘোষণার দিন থেকেই বেড়ে গেছে, ব্যাংকে ক্ষুদ্র আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব তো মানুষের কলিজায় আঘাত, কিন্তু বড় লোকের বেশি টাকার ওপর তেমন শুল্ক রাখা হয়নি, তারপরও অর্থমন্ত্রী এ বাজেটকে শ্রেষ্ঠতম বাজেট বলছেন কীভাবে? জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি। বলেছি যে, ২০১৮ সালে বাড়ানো হবে, যখন এলএনজি আমদানি করা হবে, তখন বাড়বে গ্যাসের দাম।’ এখানেও চরম দায়িত্বহীনতা ও অজ্ঞতার পরিচয় দিলেন আবুল মাল। কারণ গত ১ জুন থেকেই গ্যাসের দাম বাড়ানো কার্যকর হয়ে গেছে। আবার অর্থমন্ত্রী যখন বলেন, জ্বালানি তেলের দাম কমানো হবে, তখন সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলে বসেন যে, জ্বালানি তেলের দাম কমানো হবে না। সুতরাং সরকার যে কে চালায় বোঝা যাচ্ছে না।
ব্যাংক হিসাবধারীদের উপর আবগারি শুল্ক আরোপ নিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এ ব্যাপারে অনেক কথাবার্তা আগেই হয়েছে। সেগুলো বিবেচনায় নিয়েই বলেছি যে, এক লাখ টাকা থাকলেই ভারমুক্ত থাকা যাবে। এর বেশি যাদের টাকা, তাদের আবগারি শুল্ক দিতে হবে। মনে হয় তারা দিতেও পারবেন। আর বড় লোকের সংজ্ঞা দেওয়া তো কঠিন।... যারা এক লাখ টাকা ব্যাংকে রাখতে পারেন, তারা আমাদের দেশের তুলনায় সম্পদশালী। তারা বাড়তি ভারটা বহন করতে পারবেন। সমস্যা হবে না।’
বহুল বিতর্কিত ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হলেও পণ্যমূল্য বাড়বে না বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। আবার এমন সব পণ্য ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে, যেগুলো খুব একটা কাজে লাগে না। অন্যদিকে বিদ্যুৎ বিলে এখন ৫ শতাংশ ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। নতুন হারে দিতে হবে ১৫ শতাংশ। কেন? এর কোনো সোজাসাপটা উত্তর দিতে পারেননি অর্থমন্ত্রী। শুধু বলেছেন, ‘৩০ লাখ থেকে ৮০ লাখ টাকা টার্নওভার হলে আগে ৩ শতাংশ হারে কর নেওয়া হতো। এখন ৩৬ লাখ থেকে দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত টার্নওভারে কর দিতে হবে ৪ শতাংশ হারে। তার মানে আগে কর দিতেন এমন অনেককেই এখন আর কর দিতে হবে না। (কিন্তু ব্যাংকে লাখ টাকা থাকলে কর দিতে হবে।) আগে ৮০ লাখ টাকার বেশি টার্নওভার হতো এ সংখ্যা কম ছিল না। আর এ কারণেই বলছি যে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না।’
সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার নিয়ে পুরনো কথাই বললেন অর্থমন্ত্রী। আগে সময় নিয়ে হার রিভিউ করা হতো। বছরে একবার। কখনও কখনও তাও করা হতো না। এটা ঠিক যে, ব্যাংক সুদের হারের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হারে এত পার্থক্য থাকা উচিত না। আগামী এক থেকে দুই মাসের মধ্যে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার নতুন করে নির্ধারণ করা হবে। অর্থমন্ত্রী দারূণ আছেন। কারণ তাকে বাড়ি ভাড়া দিতে হয় না। গ্যাস- বিদ্যুতের বিল দিতে হয় না। বাজার করতে হয় না। এগুলো আপসে আপ হয়ে যায়। ফলে এসব পরিশোধ করতে সাধারণ মানুষকে কী দুর্বিপাকে পড়তে হয়, সেটা ধারণা করার ক্ষমতা তার নেই। ফলে তার কাছে লাখ টাকা যার ব্যাংকে আছে, তিনি সম্পদশালী। অতএব তাকে চোষো। ছিনিয়ে নাও তার টাকা। তাহলে সরকার আর ছিনতাইকারীর মধ্যে কী পার্থক্য থাকলো?
এদিকে প্রবাসী আয় প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে। রফতানি প্রবৃদ্ধিও শ্লথ। তার ওপর ব্যাংকে টাকা রাখলে যদি কমে যায়, তাহলে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে, বাড়বে অর্থ পাচারও। এমন পশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, রফতানি ও রেমিট্যান্স ততোটা কমেনি। রেমিট্যান্স কিছুটা ‘অন্য মাধ্যমে’ বেড়েছে। তবে রেমিট্যান্স যাতে বৈধ চ্যানেলে আসে, সেজন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। ভ্যালারে অর্থমন্ত্রী! অন্য মাধ্যমে আসছে, তাতে আপনি কেন এত প্রীত হচ্ছেন? সে অন্য মাধ্যম তো হুন্ডি। তবে কি দেশে হুন্ডি বৈধ হয়ে গেছে?
সাংবাদিকরা তাকে আরও প্রশ্ন করেন। তারা জানতে চান যে, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতি হচ্ছে। আর সেই ঘাটতি পূরণ করতে মানুষের করের টাকা ও বাজেটে বরাদ্দ রেখে। আগে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে লুটপাট হলেও এখন বেসরকারি ব্যাংকেও লুটপাট হচ্ছে। আর বাজেট বক্তৃতায় এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর কোনো কথা নেই। লুটপাট প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী শুধু বলেন, ‘এ অনুমানটা গ্রহণ করতে কষ্ট হচ্ছে। আর ব্যাংক খাতে জালিয়াতি হয় সব খানেই, সব দেশেই। আমাদের দেশেও হয়েছিল। কমানোর চেষ্টা করছি। বেসরকারি দু’- একটা ব্যাংকে জালিয়াতি হয়েছে।’ ব্যাংক জালিয়াতি যেহেতু সব দেশেই হয়, অতএব বাংলাদেশও এই জালিয়াতি চিরজীবী হবে, এমন আশাই করেছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রীর কাছে সাংবাদিকরা জানতে চান যে, এবারের বাজেটে উজ্জ্বলতম ও দুর্বলতম দিক কী? জবাবে তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘এর কী জবাব দেবো? আমার সব বাজেটই উজ্জ্বল, কোথায়ও কোনো দুর্বলতা নেই।’ বিপুল রাজস্ব আদায়ে এনবিআর-এর দক্ষতাসহ বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন করলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এমন প্রশ্ন একান্তই অবান্তর। দক্ষতা-সক্ষমতা নিয়ে শুধু আমার নয়, আপনাদের দিক থেকে প্রশংসা আসা উচিত।’
অর্থমন্ত্রী চালের মূল্যবৃদ্ধি সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব দেবার ভার দেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর ওপর। মতিয়া বলেন, চালের দাম বেড়েছে হাওরাঞ্চলে বন্যার কারণে। তবে তিনি বলেন, এটা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ভেতরেই রয়েছে। তিনি বলেন, হাওরে বন্যায় ১৬ লাখ টন চালের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সঙ্কট হবে না বলে তিনি বিশ্বাস করেন। ১৬ লক্ষ টন চাল নেই। দাম বাড়ছে হু হু করে। আর কৃষিমন্ত্রী মতিয়া বলছেন, ‘সঙ্কট হবে না।’ তিনি বলেন, ‘চালের দাম কিছুটা বেড়েছে অস্বীকার করব না। বিতর্কও করব না। তবে অনেকের মধ্যে বাড়িয়ে বলার প্রবণতা কাজ করে।...বাজার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে, এটা বলা ঠিক হবে না। সবাই কিনে কেটে খাচ্ছেন।’ কী মাত্রায় জনবিচ্ছিন্ন হলে কোনো মন্ত্রী এমন কথা বলতে পারেন, বিপন্ন জনগণের সঙ্গে এমন পরিহাস করে যাচ্ছেন, ভাবা যায় না।
আবুল মাল মুহিত যে বাজেট ঘোষণা করেছেন, তার আকার ৪ লাখ ২২৬ কোটি টাকা। কিন্তু এই বাজেট বাস্তবায়নে মোট আয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। বাজেটে ঘাটতি ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক-চতুর্থাংশ টাকার খবর নেই। আর আয় ধরা হয়েছে ভ্যাট ও ট্যাক্স থেকে। যেখানেই হিসাব মেলানো যায়নি, সেখানেই জনাব মুহিত বলেছেন, বৈদেশিক সাহায্য থেকে তিনি এই হিসাব মেটাবেন। সে বৈদেশিক সাহায্য কমতে কমতে ক্ষীয়মাণ হয়ে গেছে। অর্থাৎ এই বাজেট বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সবটাই আগামী নির্বাচনের ধোঁকা।
এই বাজেট পর্যালোচনা করেছেন সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) অন্যতম। তারা বলেছেন, কোনো ধরনের সংস্কার ছাড়া বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে এই বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বাজেটের অনেক প্রক্ষেপণের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। আবার বাজেট দলিলের বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন ও অবাস্তব তথ্য উপস্থাপন করে বাজেটের অঙ্কের হিসাব মেলানো হয়েছে। সিপিডি বলেছে, ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক সহায়তা প্রাপ্তির যে হিসাব দেয়া হয়েছে, তা অঙ্কের হিসাব জানা কোনো শিশুও বিশ্বাস করবে না। সিপিডি’র বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ঘাটতি অর্থায়নের ক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহারের পরিমাণ যেভাবে ধরা হয়েছে, সেটি খুবই চমৎকারভাবে করা হয়েছে। এটি ব্যবহারের পরিমাণ যেভাবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, সেটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, অর্থায়নের ভারসাম্য ও হিসাব মেলানোর জন্য সেটি করা হয়েছে। অর্থায়নের সব উৎস দেখার পর ব্যয়ের হিসাব যখন মিলছে না, তখন পুরোটাই বৈদেশিক সাহায্য থেকে আসবে বলে ধরে নিয়ে যোগ করা হয়েছে। যে অর্থ পাওয়ার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে, সেটি গত চার বছরেও বাংলাদেশে আসেনি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৭০ কোটি ডলার বৈদেশিক সাহায্য এসেছিল। প্রস্তাবিত বাজেটে সেই খাতে ৭৬০ কোটি ডলার পাওয়া যাবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। সিপিডি প্রশ্ন করেছে, এই প্রাক্কলন কতোটা বিশ্বাসযোগ্য?
সিপিডি বলেছে, সার্বিকভাবে এবারের বাজেটে যে করকাঠামো প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ওপর করের চাপ বাড়বে। সহজে আদায় করা যায়, এমন কর আদায়ের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে। ফলে সাধারণ, নিয়মিত ও সৎ করদাতাদের ওপর করের বোঝা আরও বাড়ানো হয়েছে। অথচ সিপিডি করের আওতা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল। তাছাড়া এই বাজেট বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেই। সিপিডি’র বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ভ্যাট নিয়ে বাইরে এত আলোচনা হলো, কিন্তু সংসদে কেউ এ নিয়ে কোনো আলোচনারই উদ্যোগ নিলেন না। ব্যাংকিং খাতের সংস্কার নিয়ে অর্থমন্ত্রী বিন্দুমাত্র মনোযোগ দিয়ে একটি কথাও বললেন না। পুঁজিবাজারের উত্থানের জন্য কোনো কথা তিনি বলেননি। এগুলো সবই রাজনৈতিক অর্থনীতি। এ সব কথা বললে খুবই প্রভাবশালী ব্যক্তিদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়। সিপিডির আর এক বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, বাজেট বাস্তবায়নের হার ক্রমান্বয়ে কমছে। বড় আকারের বাজেট দিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করতে পারলাম নাÑএতে এক ধরনের আর্থিক ভ্রম তৈরি হয়। কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়া যায় না। তাই বাজেট বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন।
বাজেটের এতো যে ত্রুটি, তার সব কিছু ছাপিয়ে গেছে ব্যাংকে লাখ টাকা থাকা নিয়ে অর্থমন্ত্রীর বালখিল্য মন্তব্যে। ব্যাংকে যার এক লাখ টাকা আছে, তিনি খেয়ে না খেয়ে তিল তিল করে তা জমিয়েছেন। হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে সোনালী ব্যাংক থেকে প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টার সহায়তায় যখন দুর্বৃৃত্তরা চার হাজার কোটি টাকা লোপাট করল, তখন এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ইটস নাথিং, চার হাজার কোটি টাকা তো টাকাই না। তার কাছেই আজ লাখ টাকার মালিক হলেন বিরাট সম্পদশালী। তাকে শুষতে হবে। তাই তার সুদ তো বটেই মূল টাকারও একটা অংশ কেটে নেওয়ার ফন্দি করেছেন অর্থমন্ত্রী। এক লাখ টাকায় অর্থমন্ত্রী আবগারি শুল্ক বাড়িয়েছেন তিন শ’ টাকা। আর এক কোটিতে বাড়িয়েছেন এক হাজার টাকা। এটা যে যৌক্তিক নয়, সে কা-জ্ঞান অর্থমন্ত্রীর আছে বলে মনে হলো না।
এদিকে আবার ঐ সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত পরিকল্পনামন্ত্রী মোস্তফা কামাল বললেন যে, ‘বিদেশে টাকা পাচার ঠেকাতে ব্যাংকে রাখা টাকার ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে।’ অর্থনীতির এত বড় ‘প-িত’ও যে মন্ত্রিপরিষদে আছেন, এটা আগে জানা ছিল না। বিদেশে টাকা পাচার করে কারা? লাখ টাকার মালিকরা? এই কা-জ্ঞানও কি ঐ মন্ত্রীর নেই? যারা এই সরকারের আমলে দুর্নীতি-চালিয়াতি জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, তারাই বিদেশে টাকা পাচার করেন, লাখ টাকার মালিকদের সে সাধ্য যে নেই, এটুকু বুঝবার বুদ্ধিও ঐ মন্ত্রীর নেই। কী দুর্ভাগ্য আমাদের! সরকার জানে, কারা বিদেশে কোটি কোটি টাকা পাচার করছে। কই, তাদের ধরার কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না কেনো? আবার আবগারি শুল্ক তো টাকা পাচারে উৎসাহিতই করবে, নিরুৎসাহিত নয়।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, নতুন করে ব্যাংকে টাকা রাখার ওপর কর বাড়ানো হলো। এটা ব্যতিক্রমধর্মী পশ্চাৎপসরণ। সার্বিকভাবেই তো আমানতের ওপর সুদ কমছে। ফলে আমানতকারীরা দু’ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সুদ কমছে, করও বাড়ছে। আমানতকারীরা এখন শঙ্কিত। তারা কোথায় যাবেন। সিদ্ধান্তটা আত্মঘাতী। এর ফলে ছায়া অর্থনীতির পরিমাণ বাড়বে। লেনদেন যেভাবে ব্যাংকিং খাতে হওয়ার সুযোগ ছিল, তা আর হবে না। এতে আর্থিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা কমবে। আমরা চাই, দেশে বৈধ আর্থিক মাধ্যমে লেনদেন বাড়–ক। তবে অতিরিক্ত করের মাধ্যমে তা নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। আবার এ সব টাকা নিয়ে অদক্ষ সরকারি ব্যাংক টিকিয়ে রাখা হচ্ছে। এটা কোন ধরনের নীতি? জনগণকে নিরুৎসাহিত করে আমরা অদক্ষ ব্যাংক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। এটা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। জনগণ এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাবে বলে আমি মনে করি। কারণ সরকার কারও হিসাব থেকে এভাবে টাকা কেটে নিতে পারে না। সবাই তো সুদের ওপর কর দিচ্ছেই। এটা তো দিনে দুপুরে ডাকাতি।
উপসংহার
গোয়ালন্দ উপজেলার উত্তর দৌলতদিয়ার কিয়ামউদ্দিন পাড়ার বাসিন্দা রতন শেখ পেশায় একজন ভিক্ষুক। তিনি পঙ্গু। তার দু’টি পা নেই। গত ২৮ বছর ধরে তিনি দৌলতদিয়া লঞ্চঘাটে ভিক্ষা করেন। তিনি ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দেয়ার মনস্থ করেন। স্থানীয় এনজিও কেকেএস একথা জানতে পেরে তার সহায়তায় এগিয়ে আসে। কেকেএস পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) মাধ্যমে গত বছর ১৭ ফেব্রুয়ারি রতন শেখকে এক লাখ টাকা দেন একটি মুদি দোকান করার জন্য। তাকে মুদি দোকান করে দেয়া হয়। বেশ চলে যাচ্ছিল রতন শেখের। কিন্তু পাঁচ-ছয় মাস পর তিনি আবার ভিক্ষা করা শুরু করেন। বিষয়টি ধরা পড়ায় এনজিও’র লোকজন তার বাড়িতে গিয়ে হাজির হন। তিনি মাফ চেয়ে নেন। তারপর তিনি রমজানে ভিক্ষাবৃত্তির জন্য ঢাকা আসার পরিকল্পনা করেন। বিষয়টি জানতে পেরে কেকেএস’র কর্মকর্তারা রতনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। রতন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে ২৮ মে তাদেরকে ঐ এক লাখ টাকা ফেরত দিয়ে দেন। রতন শেখ এখন ঢাকায় ভিক্ষা করেন। তার মুঠো ফোন আছে। তিনি ঐ মুঠোফোনে জানান, তার বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা থাকে। এক ছেলে স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। টাকা দিয়ে দোকান করেছিলেন। কিন্তু সে দোকানের আয়ে সংসার ঠিকমতো চলে না। এ কারণে তিনি তার আগের পেশা বেছে নিয়েছেন।
এ থেকে আশা করি অর্থমন্ত্রী এক লাখ টাকার মাজেজা বুঝবেন। একজন ভিক্ষুকও এক লাখ টাকা দিয়ে কিছু করতে পারে না, ফিরিয়ে দেয়। সেখানে অর্থমন্ত্রী এক লাখ টাকার ওপর আবগারি শুল্ক আরোপ করে ঐ ভিক্ষুকের চেয়ে কি বুদ্ধিমান হলেন?

 

http://www.dailysangram.com/post/287088-