ভ্যাট নিয়ে ব্যবসায়ীদের শঙ্কাই বাস্তব হলো। ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাজারে। ১ জুলাই থেকে বাজেট কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও এরই মধ্যে বাজারে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। অথচ অর্থমন্ত্রী বলছেন ১৫ শতাংশ ভ্যাটে বাজারে কোন পণ্যমূল্য বাড়বে না। ১৫ শতাংশ ভ্যাটের ইতোমধ্যেই রড, সিমেন্ট, ঢেউটিন, প্রিন্টিং প্লেটসহ মসলা জাতীয় বেশকিছু পণ্যের দাম এরই মধ্যে বেড়ে গেছে। অথচ এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কেউ নেই।
বাজেট ঘোষণার পর সবচেয়ে বেশি জটিলতায় পড়েছে ইস্পাতপণ্য ও সিমেন্ট। অবকাঠামো নির্মাণের মূল উপাদান রড ও সিমেন্ট বিক্রিতে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা গেছে। একদিনের ব্যবধানে রডের দাম বেড়েছে টনে সর্বোচ্চ আড়াই হাজার টাকা। বস্তা প্রতি ১০-১৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে সিমেন্ট। এছাড়াও বাজেটের প্রভাবে বাজারে বেড়েছে রসুন, আধা, চালসহ আরও অনেক পণ্যের দাম। অথচ এসব পণ্যের সাথে বাজেটের তেমন কোন সম্পর্ক নেই। তাহলে কেন এসব পণ্যো দাম বাড়লো। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণের কথা বললেও আসলে কোথায় বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। কার স্বার্থে তারা কাজ করছে। এসব দেখান আসলে কেউ নেই। বাজেটের কার্যক্রম ১ জুলাই থেকে কার্যকর করার কথা থাকলেও এখনও সব পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিক্রি হচ্ছে। আর যে সব পণ্যের দাম কমার কথা ছিল সেসব পণ্যের দাম এখনও কমেনি। তাহলে এসব অনিয়ম আসলে কে দেখবে।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাজেটের আগে ৪০ গ্রেডের প্রতি টন রডের দাম ছিল ৪০ হাজার টাকা। বর্তমানে তা ৪২ হাজার থেকে সাড়ে ৪২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৬০ গ্রেডের প্রতি টন রডের দাম ছিল ৪৮ হাজার টাকা। বাজেট ঘোষণার পর একই রড বিক্রি হচ্ছে ৫০ হাজার থেকে ৫০ হাজার ৫০০ টাকায়।
রহিম স্টিলের বিক্রয় বিভাগের কর্মকর্তা মো. আব্দুল হালিম বলেন, গতকাল রডের বাজারে লেনদেন ছিল খুবই কম। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই ভ্যাট আরোপের ফলে পণ্য বিক্রিতে অনীহা প্রকাশ করেছে। তবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বিষয়টি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া গেলে পণ্যের দাম স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে।
একই অবস্থা আরেক নির্মাণ উপকরণ সিমেন্টেরও। বাজেট প্রস্তাবের আগে খুচরা বাজারে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) সিমেন্ট ৪১০-৪২০ টাকায় পাওয়া যেত। একই সিমেন্ট গতকাল বস্তা প্রতি ৪২০-৪২৫ টাকায় লেনদেন হয়েছে। মিল মালিকরা আগে কমিশন ও আনুষঙ্গিক খরচ বাদ দিয়ে ৩৭০-৩৯০ টাকার মধ্যে প্রতি বস্তা সিমেন্ট বিক্রি করতেন। বাজেট ঘোষণার পর দুদিন ছুটি থাকায় মিল পর্যায়ে পণ্যটির দাম এখনো বাড়ানো হয়নি।
দেশের অন্যতম সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বিপণন বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রডের ওপর নির্ধারিত প্যাকেজ ভ্যাট তুলে দেয়া হলে পণ্যটির দাম বাড়বে। এতে সিমেন্টের বাজারও অস্থির হবে। তবে দেশীয় চাহিদার তুলনায় সিমেন্টের উৎপাদন বেশি হওয়ায় রডের মতো অতটা হয়তো বাড়বে না।
বাজেটে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণায় বেড়ে গেছে প্রিন্টিং প্লেটের দাম। আগের চেয়ে ৮-১০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে একেকটি প্রিন্টিং প্লেট। বাজেটের আগে যে প্রিন্টিং প্লেট ১০০ টাকায় বিক্রি হতো, এখন তা বেড়ে হয়েছে ১১০ টাকা। এছাড়া ১১৪ টাকার প্লেট বিক্রি হচ্ছে ১২০ ও ১৫০ টাকার প্লেট ১৫৫ টাকায়।
বর্ষা মৌসুম হওয়ায় বর্তমানে ঢেউটিনের বাজারে বিক্রয় মন্দা চলছে। তার পরও বাজেটের প্রভাবে দাম বেড়েছে নির্মাণসামগ্রীটির। বাজেটের পর সাপ্তাহিক বন্ধের দিনও গতকাল বানপ্রতি (৭২ ফুট) সর্বোচ্চ ৫০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হয়েছে ঢেউটিন। তবে মিল মালিকরা দাম বাড়ালে খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে দাম আরো বাড়বে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
নয়াবাজারের টিন বিক্রেতা নয়ন তালুকদার বলেন,বর্ষায় এমনিতেই টিন বিক্রি কমে যায়। তার মধ্যে বেড়েছে টিনের দাম। বাজেট ঘোষণার পর থেকে আর তেমন টিন বিক্রি হচ্ছে না।
আমদানিকৃত কাপড়ের ওপর শুল্ক আরোপের ফলে বেশি দামে পোশাক বিক্রি হচ্ছে বলে বাজার অনুসন্ধানে দেখা গেছে। সরকার যদি ভ্যাট না কমায় তাহলে এ শিল্পের অনেক ক্ষতি হবে। এর এ ক্ষতির দায়ভার সরকারেই নিতে হবে।
বাজেটের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে মসলা জাতীয় পণ্যের বাজারেও। মসলা জাতীয় পণ্যের সম্পূরক শুল্ক দ্বিগুণ করার একদিনের ব্যবধানে জিরার দাম বেড়েছে কেজিতে ২০ টাকা। যদিও ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জিরার বুকিং দর ও স্থানীয় বাজারে মসলাটির চাহিদা স্বাভাবিক রয়েছে।
বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে সিরিয়া ও ইরান থেকে আমদানি করা জিরাও। বাজেটের আগে সিরিয়া থেকে আমদানি করা প্রতি কেজি জিরা বিক্রি হয়েছিল ৩৫৫ টাকায়। বাজেট ঘোষণার ৪ দিনের ব্যবধানে তা বিক্রি হয় ৩৮০-৩৯০ টাকা কেজি দরে। এছাড়া ২০ টাকা বেড়ে ভালো মানের ইরানি জিরা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩৭০-৩৮০ টাকায়।
বাজেট ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতার বিষয়ে সরকার কঠোর অবস্থান নেবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, বাজেট বাস্তবায়নের আগেই দাম বাড়ানোর এ প্রবণতা ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফার কৌশল।
১৫ শতাংশ ভ্যাটের হার নিয়ে গত এক বছর ধরেই ব্যবসায়ীরা বিরোধীতা করে আসছিল। তাদের আশঙ্কা ছিল ভ্যাটের এক হার কার্যকর করা হলে বাজারে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ্য করেন, এখনও বড় ব্যবসায়ীরা ভ্যাট আদায় করে থাকেন। কিন্তু তারা তা যথাযথভাবে পরিশোধ করেন না। আর ভ্যাট মুক্ত টার্নওভারের যে, পরিমাণ দেয়া হয়েছে এতে ছোট ব্যবসাযীরা ভ্যাটের আওতায় আসবে না। কিন্তু বাস্তবে ঠিক তার উল্টো দেখা যাচ্ছে। বাজেট বাস্তবায়ন শুরু না হতেই নিত্য পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। সরকার কিসের ভিত্তিতে বলছে বাজারের কোন প্রভাব পড়বে না। আর যদি প্রভাব পড়ে তাহলে এর দায়ভার কে নিবে। ভ্যাট নিয়ে ব্যবসাযীরা আন্দোলনের হুমকি দিলেও সরকার তা আমলে নিচ্ছে না। কিন্তু বাজেটে সরকার আমানতের উপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি করাতে তা নিয়ে সারা দেশে বেশি হৈ চৈ হুেমছ। আর এতে করে ব্যাটের ইস্যু কিছুটা চাপা পড়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব শুভাশীষ বসু এ প্রসঙ্গে বলেন, মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সংস্থা বাজারে দ্রব্যমূল্যের ওপর নজরদারি করে। রমজান উপলক্ষে এ কার্যক্রম অব্যাহত আছে। নজরদারিতে যদি বাজেট ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়, তাহলে আইন অনুযায়ী শাস্তির বিধান প্রয়োগ করা হবে। প্রমাণসাপেক্ষে এ বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেয়ার পরিকল্পনাও আছে আমাদের।