৬ জুন ২০১৭, মঙ্গলবার, ৭:৫৫

বুড়িগঙ্গা দূষণে দায়ী সরকারি সংস্থাও

হাজারীবাগের ট্যানারি স্থানান্তর হলেও কমছে না দূষণ

দূষণ ও দখলে হারিয়ে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা। হাজারীবাগের ট্যানারি স্থানান্তর হলেও কমছে না দূষণ। তাছাড়া দুই পাড়ের জমি দখল করে ঘরবাড়িসহ নির্মাণ করা হয়েছে রঙ-বেরঙের ভবন। গড়ে উঠেছে কলকারখানা, ডায়িং ফ্যাক্টরি। ইটিপি বিহীন এসব কারখানার বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে নদীতে। বুড়িগঙ্গা খেকো এসব লোকজনকে সহযোগিতা করছেন সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তা, পুলিশ রাজনৈতিক প্রভাবশালী কিছু নেতা। এমনকি কোনো কোনো সরকারি সংস্থাও বুড়িগঙ্গা দূষণের সাথে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে জড়িত বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, বুড়িগঙ্গা নদীর দুই শতাধিক পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের হাজার হাজার টন বর্জ্য পরিশোধন ছাড়া নিপ্তি হচ্ছে। রাজধানীর হাজারীবাগের চামড়া কারখানার দূষণের সাথে কামরাঙ্গীরচর, ইসলামবাগ, পোস্তা, লালবাগসহ নদীর পাড়ে অবস্থিত কয়েক শত পলিথিন ও প্লাস্টিক রিসাইকিং কারখানা, কেরানীগঞ্জের দুই শতাধিক ডায়িং কারখানাসহ হাজারেরও অধিক বিভিন্ন কারখানা এবং শ্যামপুর, পাগলা-ফতুল্লা এলাকায় শত শত কারখানা থেকে কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি নদীতে মিশে পানি দূষিত হচ্ছে। বছরের পর বছর এসব কারখানা থেকে হাজার হাজার টন বর্জ্য নদীতে নিপে করলেও নির্বিকার সংশ্লিষ্ট সংস্থা পরিবেশ অধিদফতর। এসব কারখানা থেকে টনে টনে বর্জ্য নদীতে নিপে করা হচ্ছে। নদীর দুইপাড়ের গৃহস্থালির বর্জ্য, স্থাপনা ভাঙা সুরকি নদীতে নিপে করা হচ্ছে বুড়িগঙ্গায়। সবচেয়ে বেশি বর্জ্য নিপে করছে স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন। এসব সংস্থার ড্রেনের পানি পরিশোধনের পর নদীতে নিেেপর বিধান থাকলেও এখন পর্যন্ত ঢাকায় বর্জ্য ট্রিটমেন্টের জন্য কোনো তরল বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন করতে পারেনি ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন কর্তৃপ। উপরন্তু নারায়ণগঞ্জের পাগলায় অবস্থিত ওয়াসার একমাত্র ট্রিটম্যান্ট প্ল্যান্টটি বিগত কয়েক বছর অকেজো রয়েছে। কিন্তু প্ল্যান্টের রণাবেণ বাবদ প্রতি মাসে বিশাল অঙ্কের অর্থের অপচয় হলেও কোনো কাজে আসছে না একমাত্র প্ল্যান্টটি। সিটি করপোরেশনের মাতুয়াইলে একটি বর্জ্য ডাম্পিং স্টেশন থাকলেও ড্রেনেজ বর্জ্য পরিশোধনের কোনো প্ল্যান্ট নেই এই সংস্থার। যার ফলে তাদের ড্রেনের মাধ্যমে বিষাক্ত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে বুড়িগঙ্গায়।
সূত্র জানায়, বুড়িগঙ্গার পানি থেকে প্রকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। নদী দুইপাড়ে ছড়িয়ে পড়ছে মশা-মাছিসহ পানি ও বায়ুবাহিত বিভিন্ন রোগবালাই। স্থানীয়রা জানান, বুড়িগঙ্গা নদী তীরের এলাকাজুড়ে উৎকট গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। নদী পাড়ের মহল্লা থেকে ভ্যানগাড়িতে ময়লা এনে নদীতে নিপে করা হচ্ছে। তাছাড়া পানি বাড়ার সাথে সাথে ময়লা আবর্জনাও বেশি ফেলা হচ্ছে নদীতে। চর কালিগঞ্জ এলাকার ব্যবসায়ী সেলিম, আমান, হাবিবসহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, নদীর পানির অসহ্য দুর্গন্ধে এখানকার মানুষ দিশেহারা। বহুদূর পর্যন্ত গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। তাছাড়া সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্টসহ সময় নানা ব্যাধি লেগেই থাকে। বুড়িগঙ্গা দূষণের ব্যাপারে ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী তাকসিন আহাম্মেদ বলেন, ওয়াসার মাধ্যমে যৎসামান্য নদীদূষণ হচ্ছে। ওয়াসার সুয়ারেজ লাইনের বর্জ্য ট্রিটম্যান্ট করতে কয়েকটি প্ল্যান্ট নির্মাণকাজ হাতে নেয়া হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি প্রল্পগুলো সমাপ্ত করতে ওয়াসা রাতদিন কাজ করে যাচ্ছে। দ্রুত এ সমস্যা সমাধান করতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
নদীতে বর্জ্য নিেেপর বিষয়ে ঢাকা দণি সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলেন, সিটি করপোরেশন সব সময় দূষণের বিরুদ্ধে কাজ করছে। সিটি করপোরেশনের ড্রেনের মাধ্যমে শুধুমাত্র বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার জমানো পানি নদীতে পড়ছে। এসব পানিতে দূষণকারী কিছু নেই। তাছাড়া একাধিকবার ওয়াসাকে নদীতে সুয়ারেজ বর্জ্য নিপে বন্ধ করতে লিখিত ও মৌখিকভাবে বলা হয়েছে। তারপরও তার কর্ণপাত করছে না। সিটি করপোরেশনের ড্রেনেজ পানি রিফাইন করতে প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন আছে। আশা করি অচিরেই এ সমস্যা মিটে যাবে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) আহ্বায়ক আবু নাসের খান এ প্রতিবেদককে বলেন, পরিবেশ বাঁচাতে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট দফতরকে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিতে হবে। এসব উদ্যোগের মধ্যে পরিবেশ ও নদীতে দূষিত বর্জ্য নিপেকারী কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান দূষণ করছে তাদেরও দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। আর বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর মধ্যে যেসব সীমানা পিলার বসানো হয়েছে তার অধিকাংশই নদীর মাঝখানে। এসব পিলার স্যাটেলাইটের মাধ্যমে স্থাপন হলে সঠিক যায়গায় বসানো সম্ভব হবে এবং উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা বন্ধ করে ভরাটকৃত যায়গা ড্রেজিং করে নদীর আগের অবস্থা ফিরিয়ে দিতে হবে। পাশাপাশি জনসচেতনা বাড়াতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এসব বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক রাইসুল আলম মণ্ডল নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতার পরেও পরিবেশ অধিদফতর পরিবেশ বাঁচাতে সব রকম প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আইন অমান্যকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে এবং কিছু প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা করা হয়েছে। অচিরেই বুড়িগঙ্গা দূষণমুক্ত হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
অন্য দিকে আদি চ্যানেল উদ্ধারে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপ। বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল (সোয়ারীঘাট হতে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত) উদ্ধার করে পানির স্বাভাবিকপ্রবাহ ফিরিয়ে দিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশের আলোকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে কয়েকটি সংস্থার সমন্বয়ে ট্রাস্ক ফোর্স গঠন করা হলেও কাজের অগ্রগতি সামান্য। পুরো চ্যানেলটি সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি দখল করে রেখেছে। এসব বিষয়ে জাতীয় নদী রা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আতাহারুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে নদী রা কমিশন কাজ করে যাচ্ছে। অচিরেই বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলসহ অন্যান্য নদীদখল ও দূষণের কবল থেকে উদ্ধার হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এ জন্য নদীরা কমিশনের নিজস্ব লোকবল, মেশনারিজ ও তদারকির মতা বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহাজান খান নয়া দিগন্তকে বলেন, নদীদূষণ ও দখলের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর পদপে গ্রহণ করছে। কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না। এরই মধ্যে দূষণ ও দখল রোধে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তার মধ্যে নদী পাড়ে ওয়ার্কওয়ে, পার্ক নির্মাণ করা হচ্ছে। দূষণ রোধে বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে বলে জানান তিনি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/226167