৬ জুন ২০১৭, মঙ্গলবার, ৭:৪০

দেশের জনগণ করের মহাসড়কে!

|| এম. কে. দোলন বিশ্বাস || আমাদের আমলেই একমাত্র জনবান্ধব বাজেট জনগণ পেয়ে থাকেন। যার ফলশ্রুতিতে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশ এখন উন্নয়নের মহসড়কে। এমন রসালো অবদানের স্লোগান দিয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সর্ববৃহৎ বাজেট দাবি করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের বাজেট ঘোষণা করেছে। লীগবাদী মহাজোট বাজেট নিয়ে যে মন্তব্যই করুক না কেনো সেটা বড় কথা নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের বাজেট বাস্তবায়ন হলে দেশের জনগণ নিতান্তই নিমজ্জিত হবে ভ্যাট কিংবা করের মহাসড়কে।
ব্যবসায়ীদের দাবি পুরোপুরি উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত ভ্যাটের নতুন হার ১৫ শতাংশই রাখা হয়েছে বাজেটে। আগামী ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরে ব্যবসায়ীরা এই হারেই ভোক্তাদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করবেন। ফলে শুধু এক বছরে ভ্যাটের মাধ্যমে জনগণের পকেট থেকে নেয়া হবে প্রায় লাখ কোটি টাকা। বর্ধিত এই ভ্যাটের হার নিশ্চিতভাবে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে। এতে বেশ চাপে পড়বে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষরা। যারা ইতোমধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বেসামাল দামের চাপে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন।
গত ১লা জুন জাতীয় সংসদে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বাজেট প্রস্তাব পেশ করার আগে তা মন্ত্রিসভার বিশেষ এক বৈঠকে অনুমোদন করিয়ে নেয়া হয়। বাজেটটি অনুমোদন করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
৮৩ বছর বয়সী অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতার নামকরণ করেছেন, ‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের’। তবে বাজেটে ভ্যাটের জন্য যেভাবে পীড়াপীড়ি করা হয়েছে, তাতে ব্যবসায়ীরা এই বাজেটকে করের মহাসড়ক মনে করতে পারেন। বাজেট বক্তৃতার দেড় শ’ পাতাজুড়ে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক খাতের বিভিন্ন সাফল্য ও উন্নয়নের নাতিদীর্ঘ ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন। আগামী কয়েক বছর কী করা হবে তাও বলেছেন। কিন্তু কিভাবে তা বাস্তবায়ন করা হবে সেটা উল্লেখ করেননি।
এছাড়া দেশের আর্থিক বা ব্যাংকিং খাত বর্তমানে কী পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছে। খেলাপি ঋণ কেনো বেড়ে চলেছে, তা কমানো যাবে কিভাবে, সরকারি ব্যাংকের অধঃপতনের নেপথ্য কারণ কী? তা বাজেটের কোথাও উল্লেখ নেই। প্রতি বছর দেশ থেকে বিপুল অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে, তা কিভাবে ঠেকানো যাবে। দেশ থেকে দুর্নীতি স্বজনপ্রীতিই বা কিভাবে কমানো যাবে। এসব বিষয় নির্দ্বিধায় এড়িয়ে গেছেন আমাদের বর্ষীয়ান অর্থমন্ত্রী। বরাবরই যা তিনি করে থাকেন এবারও সেটার ব্যতিক্রম হয়নি!
তাই অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতাটি এক কথায় গতানুগতিক হিসেবে অভিহিত করা যায়। এখানে নতুনত্বের তেমন কোনো ছোঁয়া ছিল না। অতীতের ধারাবাহিক বাজেট বক্তৃতার প্রতিচ্ছবি। অর্থমন্ত্রী নিজেই বাজেটকে ‘উচ্চাভিলাষী’ অভিহিত করেছেন। কারণ অর্থমন্ত্রী অনেকটা নিশ্চিতভাবেই জানেন, এত বড় বাজেট এক বছরে বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা সরকারের নেই। তাতে কী, তাও জনগণকে দেখানো হলো- দেখ আমরা ৪ লাখ কোটি টাকার বাজেট দিলাম! সরকার মেয়াদ শেষ করার আগে ৫ লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করবে। চলতি অর্থবছরের বাজেটও অর্থমন্ত্রী পুরোটা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। সংশোধন করে তা কমিয়ে আনা হয়েছে। এটিও বছর শেষে বাস্তবায়ন করা যাবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
এক নজরে বাজেট : আগামী অর্থবছরের বাজেটের মূল আকার ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ১৭ শতাংশ এবং সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা নির্ধারিত করা হলেও বাস্তবায়ন ব্যর্থতার কারণে আকার কমিয়ে ৩ লাখ ১৭ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।
মোট রাজস্ব প্রাপ্তি : বাজেটে মোট রাজস্ব প্রাপ্তির প্রাক্কলন করা হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এটি ছিল ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে করা হয়েছে ২ লাখ ১৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরে মোট রাজস্ব প্রাপ্তির মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে আদায় করা হবে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল্য সংযোজন কর মূসক বা ভ্যাট থেকেই আদায় করা হবে ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ভ্যাট থেকে আয় ৭১ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা ধরা থাকলেও আদায় ব্যর্থতার কারণে তা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ৬২ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা।
লাখ কোটি টাকারও বেশি ঘাটতি : বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ গিয়ে ঠেকেছে ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। জিডিপির অংশ হিসেবে যা ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এই ঘাটতির পরিমাণ ৯২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এই ঘাটতির পরিমাণ আরো খানিকটা বেড়ে হয়েছে ৯৩ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা।
যেভাবে ঘাটতি পূরণ : ঘাটতি পূরণের জন্য বাজেটে বৈদেশিক ঋণের প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৫৫ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৩০ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। কিন্তু কাক্সিক্ষত মাত্রায় বিদেশী সহায়তা না পাওয়ার কারণে সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে করা হয়েছে ২৪ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। কিন্তু এরপরও সরকার আশা করছে আগামী অর্থবছরে অর্ধশত কোটি টাকারও বেশি বিদেশী সাহায্য থেকে পাওয়া যাবে। ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৮ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৩৮ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে করা হয় ২৩ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে আগামী অর্থবছরে সরকার ঋণ নেবে ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এ খাত থেকে ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা থাকলেও সংশোধিত বাজেটে তা দ্বিগুণেরও বেশি বাড়িয়ে করা হয় ৪৫ হাজার টাকা। (তথ্যসূত্র : নয়াদিগন্ত- ০২.০৬.২০১৭)
করের খড়গ : আগামী অর্থবছর (২০১৭-১৮) থেকে নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন কার্যকর হতে যাচ্ছে। এ আইন অনুযায়ী আগামী তিন বছর সব পণ্য ও সেবা বিক্রির ওপর অভিন্ন ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য হবে। তবে নিত্যপণ্য, কৃষি ও সেবাখাতের ১০৪৩টি তালিকাভুক্ত পণ্য ও সেবায় ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রস্তাব করা হয়েছে নতুন আইনে। এর মধ্যে চাল, ডাল, মুড়ি, চিড়া, চিনি, আখের গুড়, মাছ, মাংস, শাক-সবজি, তরল দুধ, প্রাকৃতিক মধু, বার্লি, ভুট্টা, ভোজ্যতেল, গম ও ভুট্টার তৈরি সুজি, লবণসহ ৫৪৯টি নিত্যপণ্যে ভ্যাট অব্যাহতির প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে একই সুবিধার প্রস্তাব রাখা হয়- কৃষি, গবাদিপশু ও মৎস্য চাষ খাত সংশ্লিষ্ট ৪০৪টি ক্ষেত্রে। এছাড়াও ৯৩ ধরনের জীবনরক্ষাকারী ওষুধের ওপর এবং গণপরিবহন, সেবা, চিকিৎসা সেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর ভ্যাট অব্যাহতির প্রস্তাব করা হয়েছে। দাতব্য প্রতিষ্ঠানের অবাণিজ্যিক কার্যক্রম, অলাভজনক সাংস্কৃতিক সেবা প্রভৃতির ক্ষেত্রেও রাখা হয়েছে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্য এবং এ বিষয়ে অর্থবিল ২০১৭ পর্যালোচনায় দেখা যায়, আগামী অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে আমদানি ও সরবরাহ পর্যায়ে কাস্টমস আইন, ১৯৬৯-এর অব্যাহতি সংক্রান্ত প্রথম তফসিল সংশোধন করে নতুন মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন ২০১২ কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে।
এই সংশোধনীর ফলে নতুন অর্থবছরে পণ্যের ভোক্তারা প্রস্তাব অনুযায়ী এক সঙ্গে আড়াই কেজি পর্যন্ত পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ভ্যাটমুক্ত সুবিধা পাবেন। এছাড়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সবধরনের অস্থায়ী হোটেল ও রেস্তোরাঁয় খাদ্য দ্রব্য সরবরাহকে ভ্যাট অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। (তথ্যসূত্র : দিনকাল-০২.০৬.১৭)
লাখ টাকার বেশি ব্যাংকে থাকলেই কর : ব্যাংকিং খাতে নানাভাবে করের বোঝা চাপিয়ে দেয়ায় গ্রাহকরা দিন দিন ব্যাংক বিমুখ হয়ে পড়ছে। এবার নতুন করে ব্যাংক লেনদেনের ওপর কর হার বাড়ানো হলো। ব্যাংকে এক লাখ টাকার বেশি থাকলে এখন আগের চেয়ে বেশি কর দিতে হবে। বছরের যেকোনো সময় ব্যাংক হিসেবে ১ লাখ টাকা ডেবিট কিংবা ক্রেডিট হলে এতদিন ৫০০ টাকা আবগারি শুল্ক কাটা হতো। নতুন অর্থবছরের বাজেটে শুল্ক ৮০০ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট প্রস্তাবনায় বলেছেন, ব্যাংক একাউন্টে লেনদেন ১ লাখ হতে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিদ্যমান ৫০০ টাকার পরিবর্তে ৮০০ টাকা, ১০ লাখ হতে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০ টাকার পরিবর্তে ২ হাজার ৫০০ টাকা, ১ কোটি টাকা হতে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ৭ হাজার ৫০০ টাকার পরিবর্তে ১২ হাজার টাকা এবং ৫ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে বিদ্যমান ১৫ হাজার টাকার পরিবর্তে ২৫ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক পরিশোধ করতে হবে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, বর্তমান সরকারের ‘ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন অ্যাট অল লেভেলস’ নীতি ও দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নতির ফলে ব্যাংকিং খাতে লেনদেনের আকার ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বিবেচনায় রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে দ্য এক্সাইজ অ্যান্ড সলট অ্যাক্ট, ১৯৯৪ সংশোধনীর এই প্রস্তাব করছি।’
১৫ শতাংশ ভ্যাটই কার্যকর : দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা ভ্যাট আইন নতুন অর্থবছর থেকে কার্যকরের ঘোষণা বাজেট প্রস্তাবে। যাতে পণ্য ও সেবা বিক্রির ওপর অভিন্ন ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন ভ্যাট প্রযোজ্য হবে। এই হারে ভ্যাট আদায়ের মাধ্যমে ৯১ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের আশা করছেন অর্থমন্ত্রী, যা এনবিআরের মাধ্যমে তার ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ পরিকল্পনার ৩৬.৮ শতাংশ। অর্থমন্ত্রী, বলেছেন, ‘১৯৯১ সাল থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপিত হয়েছে এবং তাতে ভোক্তারা ও ব্যবসায়ীরা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।
২০১২ সালের ‘মূসক ও সম্পূরক শুল্ক আইন’ অনুযায়ী ১৫ শতাংশ কর কার্যকর করার কথা ছিল গত বছরের ১ জুলাই থেকে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে তা পিছিয়ে দেয় সরকার। তখন বিদ্যমান প্যাকেজ করের হার বাড়িয়ে বলা হয়, ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নেয়া হবে।
টার্নওভার করের সীমা বছরে ৮০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থাৎ যেসব প্রতিষ্ঠানের মাসিক টার্নওভার গড়ে ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকার নিচে, তাদের ৪ শতাংশ হারে টার্নওভার কর দিতে হবে। এতদিন ৩০ লাখ থেকে ৮০ লাখ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক টার্নওভারের ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ কর প্রযোজ্য ছিল।
যত পরিবর্তন ভ্যাট আইনে : ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটের সবচেয়ে আলোচ্য বিষয় ছিল ভ্যাট আইন কার্যকর। ২০১২ সাল থেকে বিভিন্ন ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আইনে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। সঙ্গে বিধিমালারও কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। আগামী ১ জুলাই থেকে এই ভ্যাট আইন কার্যকর হবে। পরিবর্তনগুলো হলো: ১.টার্নওভার তালিকাভুক্তি সীমা ৩৬ লাখ টাকা পর্যন্ত কর অব্যাহতি দেয়া হবে। ২.মূসক নিবন্ধন সীমা ৮০ লাখ থেকে বাড়িয়ে দেড় লাখে উন্নীত করা হয়েছে। ৩৬ লাখ থেকে দেড় কোটি টাকা বিক্রিসম্পন্ন ব্যবসায়ীকে ৪ শতাংশ হারে টার্নওভার কর দিতে হবে। দেড় কোটি টাকার বেশি বিক্রি হলে শুধু ভ্যাট নিবন্ধন নিতে হবে এবং ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। ৩. নতুন বিধান অনুযায়ী সরবরাহ গ্রহণ ও তার অনুকূলে মূসক চালান থাকলেই রেয়াত গ্রহণ করতে পারবেন। ৪. সহযোগীর সংজ্ঞা থেকে আত্মীয় বাদ দেয়া হয়েছে। ৫. দেশীয় শিল্প যে ধরনের সুরক্ষা ১৯৯১ সালের আইন অনুযায়ী পেতো, নতুন আইনের অধীনেও ওই সুরক্ষা অব্যাহত রাখা হয়েছে। ৬. বাণিজ্য সুরক্ষার জন্য আমদানি পর্যায়ে এক হাজার ৬৬৬টি এইচএস লাইনের আওতায় বিদ্যমান সব পণ্যে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ৭. নিত্যপণ্যে অব্যাহতি :-সব প্রকার কৃষিজ পণ্য, হাঁস-মুরগি, গবাদি পশু, পশুর মাংস, মাছ, ফলমূল, শাকসবজি, ভোজ্য তেল, চিনি, গুড়, লবণ, তুলা, পাট, রেশম সুতা মূসকের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। ৮. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সব অস্থায়ী হোটেল ও রেস্তোরাঁ খাদ্যদ্রব্য সরবরাহকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ যেসব হোটেলে খাওয়াদাওয়া করে, তাতেও ভ্যাট হবে না। ৯. জীবনরক্ষাকারী প্রায় সব ওষুধে মূসক অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ১০.সমাজকল্যাণ কার্যক্রমকে মূসকের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ কার্যক্রমে ৫ শতাংশ ভ্যাট অব্যাহতি। ১১. কৃষিকাজে ব্যবহৃত উপকরণ, যেমন : বীজ, সেচ সেবা, কীটনাশক, যন্ত্রপাতি মূসকের আওতার বাইরে। ১২. ডেইরি, ফাউন্ড্রি, পাটশিল্পের কাজে ব্যবহৃত সব যন্ত্রপাতিতে মূসক অব্যাহতি। ১৩. সব ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কর্মকা- ভ্যাটের আওতার বাইরে। ১৪.ব্যাংকিং ও বিমা খাতের কমিশন ব্যতীত সব বিষয়ে মূসক অব্যাহতি প্রদান। ১৫. জীবনবীমা সম্পূর্ণ অব্যাহতিপ্রাপ্ত। ১৬. স্টক মার্কেট ও তার সব কাজে মূসক অব্যাহতি। ১৭. কম্পিউটার ও কম্পিউটার যন্ত্রাংশের নতুন করে মূসক অব্যাহতি। ১৮. দেশীয় সব সফটওয়্যার উৎপাদন ও সরবরাহকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। ১৯. বাংলাদেশে উৎপাদিত ফ্রিজ, টিভি, এসি, মোটরসাইকেলে বিদ্যমান অব্যাহতি বহাল রাখা হয়েছে। (তথ্যসূত্র : যায়যায়দিন- ০২.০৬.১৭)
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম এর সাথে সহমত পোষণ করে আমরাও বাজেটকে মনে করি, ‘অবাস্তব ও পকেট কাটার বাজেট’ হিসেবেই। আমরা বলতে চাই, বাজেটের লক্ষ্যমাত্রাগুলো অতি উচ্চাভিলাষী, অবাস্তব এবং বাস্তবায়ন দুঃসাধ্য হবে। ভ্যাট ও ব্যাংকে জমাকৃত অর্থের ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানোর মাধ্যমে সাধারণ জনগণের পকেট কেটে আদায় করা হবে রাজস্ব। মূলত সরকার আগামী ২০১৯ সালের নির্বাচন সামনে রেখে নিজেকে জনপ্রিয় করতে এ বিশালাকারের বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে।
আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ, যা চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। এই লক্ষ্যমাত্রা কোনোভাবেই অর্জিত হবে না। ওই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে অবশ্যই বিনিয়োগ জিডিপির ৩২ থেকে ৩৩ শতাংশ দরকার হবে। কিন্তু আমাদের বর্তমান অবস্থা সেখানে নেই। এটা এখন ৩০ শতাংশ। আগামী এক বছরে এ হার ২ শতাংশ বাড়বে এমন কোনো সম্ভাবনা আমরা দেখছি না। এখানে জনগণের সাথে এক ধরনের তামাশা করা হচ্ছে। বাজেটে ব্যয়ের ব্যাপ্তি রাজস্ব অর্জনের ব্যর্থতার চেয়ে বেশি। যা কোনো ক্রমেই প্রত্যাশিত নয়।

http://www.dailysangram.com/post/286884-