৫ জুন ২০১৭, সোমবার, ৪:০৫

ভ্যাট অব্যাহতির দীর্ঘ তালিকায় হারাম খাবার ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য

যেসব পণ্য মানুষের জন্য অতি প্রয়োজন সেগুলোর ভ্যাট না কমিয়ে হারাম খাবার আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতির ঘোষণা দেয়া হয়েছে বাজেটে। সরকারের এই কৌশল জনগণের সাথে প্রতারণার শামিল বলে অভিযোগ করছেন ভোক্তারা। সদ্য ঘোষিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে এমন সব পণ্যের ভ্যাট অব্যাহতির ঘোষণা দেয়া হয়েছে যেগুলো মুসলমানদের জন্য হারাম। অন্যদিকে ভ্যাট অব্যাহতির তালিকায় এমন অনেক পণ্য রাখা হয়েছে যেগুলো সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে প্রয়োজনও নেই। শুধু তালিকা দীর্ঘ করার জন্যই বাজেটে কৌশলে এসব পণ্য বাড়ানো হয়েছে। এতে সাধারণ ভোক্তারা ক্ষুব্ধ - হতাশ। 

এদিকে সংসদে বাজেট ঘোষণার পর থেকেই ভ্যাট মুক্ত পণ্যের তালিকা নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে মানুষকে বোকা বানানোর প্যাঁচ ভালোই দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অপ্রয়োজনীয় পণ্যের লম্বা তালিকা যোগ করে ভ্যাট অব্যাহতির পণ্যসংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে বাহবা কুড়ানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু অব্যাহতির তালিকায় এমন অনেক পণ্যের নাম ঢোকানো হয়েছে যেগুলো এ দেশের অনেক মানুষেরই জীবদ্দশায় একবারও দরকার পড়ে না। শুকরের তৈল বা গোসত, ঘোড়া, গাধা, খচ্চর বা ঘোটকের মাংসে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
অথচ মুসলিম হিসেবে এসব আমাদের জন্য হারাম। একটি মুসলিম দেশ হিসেবে এসব হারাম পণ্যের ভ্যাট অব্যাহতি দেয়ার বিষয়েও অন্য কোন দুরভসন্ধি রয়েছে বলেও অভিযোগ করছেন অনেকে। বাজেটে আমদানি ও সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে শূকরের মেদবিহীন মাংসে। বাদাম, চিনাবাদামের ক্ষেত্রেও অব্যাহতি দেয়া হয়েছে ভ্যাট। দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে এসব পণ্যের প্রয়োজনীয়তা কতটা সে প্রশ্ন এখন প্রায় সবার মুখে মুখে।
অন্যদিকে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে মানুষের অতি জরুরী পণ্যে। সাবান, শ্যাম্পু, শেভিং আইটেম, মশার কয়েল, অ্যারোসলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্য অব্যাহতির তালিকায় রাখা হয়নি। ফলে সাধারণ মানুষকে ভ্যাট থেকে বাঁচানোর যে চেষ্টার কথা প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, বাস্তবে তাতে শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে।
এবারের বাজেটে ভ্যাট অব্যাহতির ঘোষণায় অর্থমন্ত্রীর শুভংকরের ফাঁকি স্পষ্ট। বিশেষ করে ভ্যাট অব্যাহতির ঘোষণা দিতে গিয়ে বাজেট বক্তব্যে অনেক বেশি মানবিক হওয়ার চেষ্টা করেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, বিদ্যমান ১৯৯১ সালের আইনে মাত্র ৫৩৬টি পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি ছিল। নতুন আইন কার্যকর করতে গিয়ে ওই সংখ্যা বাড়িয়ে এক হাজার ৪৩ করা হয়েছে। চাল, ডাল, মুড়ি, চিঁড়া, চিনি ও আঁখের গুড়, মাছ, মাংস, শাক-সবজি, তরল দুধ, প্রাকৃতিক মধু, বার্লি, ভুট্টা, গম ও ভুট্টার তৈরি সুজি, লবণসহ ৫৪৯টি পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতির প্রস্তাব করেছেন তিনি।
অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যে সবচেয়ে বড় শুভংকরের ফাঁকি হচ্ছে, প্রতিটি সবজিকে এখানে একেকটি পণ্য হিসেবে ধরা হয়েছে। ৯৩ ধরনের জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, গণপরিবহন সেবা, জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। কৃষি, গবাদি পশু ও মৎস্য চাষ খাতের প্রায় ৪০৪টি ক্ষেত্রে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। একেকটি কীটনাশক, আগাছানাশক ও ছত্রাকনাশককে একেকটি পণ্য হিসেবে ধরে ভ্যাট অব্যাহতি দিয়ে পণ্যের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ভ্যাট অব্যাহতির তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এতে প্রয়োজনীয় পণ্যের সংখ্যা খুবই কম।
অন্যদিকে অর্থমন্ত্রী যেসব পণ্যকে মৌলিক খাদ্য তালিকায় ফেলে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেয়ার কথা বলেছেন সেসবের মধ্যে রয়েছে জীবন্ত ঘোড়া, গাধা, খচ্চর ও ঘোটক, জীবন্ত গবাদিপশু, জীবন্ত ছাগল, ভেড়া, পাতি হাঁস, হংসী, টার্কিসহ বিভিন্ন জীবন্ত পক্ষি, হাঁস-মুরগির মাংস বা নাড়ি-ভুঁড়ি। অব্যাহতির তালিকায় শূকরের মাংসকেই একাধিক পণ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। যেমন একস্থানে বলা হয়েছে ‘শূকরের মাংস, তাজা, ঠান্ডা অথবা হিমায়িত (২.৫ কেজি পর্যন্ত মোড়ক বা টিনজাত ব্যতিত)’।
আরেক স্থানে বলা হয়েছে ‘শূকরের মেদবিহীন মাংস অথবা গৃহপালিত পক্ষিগুলোর মেদ (গলানো নহে) তাজা, ঠান্ডা, হিমায়িত, লবণাক্ত, শুকনা বা ধূমায়িত (২.৫ কেজি পর্যন্ত মোড়ক বা টিনজাত ব্যতিত)’। আমদানি ও সরবরাহ উভয় পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতির তালিকায় রাখা হয়েছে ২.৫ কেজি পর্যন্ত মোড়ক বা টিনজাত ব্যতিত কাঁটা ছাড়ানো মাছ এবং মাছের অন্যান্য মাংস (কিমাকৃত হোক বা না হোক) তাজা, ঠান্ডা বা হিমায়িত।
ভ্যাট অব্যাহতির তালিকায় রাখা হয়েছে মাছের গুঁড়া, যা সাধারণের কাছে অপরিচিত একটি পণ্য। শামুক ও কাকড়া বাদে জলজ অমেরুদন্ডী প্রাণী আমদানি-সরবরাহ পর্যায়েও এ সুবিধা রাখা হয়েছে। বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, আলুর মতো সবজি খোলা বিক্রি হয় অলিতে-গলিতে। এসব পণ্যে ভ্যাট বসানো সম্ভব নয় বলে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
প্রতারণার আরেকটি নতুন দিক হচ্ছে, এইচএস কোড অনুযায়ী একেকটি সবজিকে একেকটি পণ্য হিসেবে গণনা করে অব্যাহতিপ্রাপ্ত পণ্যের তালিকা লম্বা করা হয়েছে মাত্র। তবে সবজির তালিকায় আজগুবি পণ্যও রাখা হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে শুকনা শাক-সবজি, জেরুজালেম ডাঁটাগাছ, সাগু তরুমজ্জা, ডুমুর ও গাব। মসলায় আড়াই কেজি পর্যন্ত ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হলেও সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে। ফলে দাম বাড়িয়ে ভ্যাট অব্যাহতি দিয়ে ক্রেতাদের বোকা বানানোর চেষ্টা রয়েছে ভ্যাট আইনে। তবুও এমন সব মসলা রয়েছে অব্যাহতির তালিকায়, যার নাম সাধারণের কাছে অপরিচিত।
এসবের মধ্যে রয়েছে ফেনেল, জুনিপার, থাইম, জই, বাজরা, ক্যানারাই বীজ, চীনাবাদাম। আরো কিছু পণ্য রয়েছে অব্যাহতির তালিকায়, যা এ দেশে কেউ কেনে কি না সে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে; যেমন সামুদ্রিক আগাছা, লেকোস্ট সিম ইত্যাদি।

http://www.dailysangram.com/post/286781-