৫ জুন ২০১৭, সোমবার, ৪:০৩

ব্যাংকিং খাতে ঘাটে ঘাটে করের বোঝা মাশুল দিতে হচ্ছে সাধারণের

করপোরেট ট্যাক্স ৪০ শতাংশ; প্রভিশন ও সিএসআর কার্যাক্রমেও কর; জাকাতকে ব্যয় হিসেবে দেখে না ট্যাক্স আইন; লাখ টাকা রাখলেই ৮০০ টাকা কর; ব্যাংকের প্রকৃত আয় কমছে, বঞ্চিত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা

ব্যাংকের মুনাফার ওপর করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধ করতে হচ্ছে ৪০ শতাংশ। ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের ওপর প্রভিশন রাখতে হয়। ওই প্রভিশন গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষার্থে সংরক্ষণ করা হলেও এরও পর ৪০ শতাংশ হারে কর পরিশোধ করতে হয। ইসলামি ব্যাংকগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে আয়ের ওপর জাকাত দিতে হয়। এ জাকাতকে ট্যাক্স আইনে ব্যয় হিসেবে ধরা হয় না। ফলে জাকাত দিতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর জাকাতের পাশাপাশি সমহারে ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। এ দিকে সব শ্রেণীর আমানতকারীর মুনাফার ওপর অগ্রিম আয় কর কেটে রাখা হচ্ছে ১০ শতাংশ। আর কর শনাক্তভুক্ত নম্বর (টিআইএন) না থাকলে এক লাখ টাকার ওপর আমানতকারীদের মুনাফার ওপর কর পরিশোধ করতে হচ্ছে ১৫ শতাংশ। আর ব্যাংকে লাখ টাকা থাকলেই ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক পরিশোধ করতে হবে গ্রাহকদের। ব্যাংকারদের মতে, দেশের ব্যাংক খাতে বাড়তি করের বোঝা বহন করতে গিয়ে সাধারণের মাশুল দিতে হচ্ছে ঘাটে ঘাটে। ব্যাংকের ডিভিডেন্ড দেয়ার মতো প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এতে প্রাপ্য মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, উচ্চ হারে কর পরিশোধ করতে গিয়ে কাক্সিক্ষত লভ্যাংশ দেয়া যাচ্ছে না সাধারণ গ্রাহকদের। এতে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ গ্রাহক।
করপোরেট ট্যাক্স ৪০ শতাংশ : অন্য কোনো লিমিটেড কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে তাদেরকে করপোরেট ট্যাক্স দিতে হয় ৩৫ শতাংশ। আর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি না হলে ট্যাক্স দিতে হয় সাড়ে ৩৭ শতাংশ। অথচ দেশের অর্থনীতির রক্তসঞ্চালনকারী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে মুনাফার ওপর করপোরেট ট্যাক্স দিতে হয় ৪০ শতাংশ হারে, আর পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত না হলে করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধ করতে হচ্ছে সাড়ে ৪২ শতাংশ হারে। তুলনামূলক বেশি হারে করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধ করতে গিয়ে ব্যাংকের প্রকৃত আয় সরাসরি কমে যায়। এ কারণে অধিক হারে মুনাফা করতে ব্যাংকগুলো আগ্রাসী ব্যাংকিং করে থাকে। ব্যাংক ঋণের সুদ হার বেড়ে যায়, যা প্রকারান্তরে সাধারণের ঘাড়ে এসে চাপছে।
প্রভিশন ও সিএসআর কার্যাক্রমে কর : ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় গ্রাহকের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। ব্যবসায় বাণিজ্যে মন্দার কারণে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। আর প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে টাকা এনে। যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যত বেশি ওই ব্যাংকের বেশি পরিমাণ প্রভিশন রাখতে গিয়ে প্রকৃত আয় কমে যায়। ব্যাংকারদের মতে, প্রভিশন ব্যাংকের বকেয়াভিত্তিক অ্যাকাউন্ট হিসেবে স্থানান্তর করা হয়। আয় কর আইনে বকেয়াভিত্তিক অ্যাকাউন্টের ওপর অর্জিত আয়কে কর রেয়াতের সুবিধা পায়। কিন্তু ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তা বকেয়া অর্থাৎ ব্যয় হিসেবে আয় কর আইনে গণ্য করে না। এর ফলে একটি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ১০০ কোটি টাকা হলে আর ওই ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণ ৬০ কোটি টাকা হলে প্রকৃত আয় নেগিটিভ অর্থাৎ লোকসান গুনতে হয়। কারণ ১০০ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফার ওপর ৪০ কোটি টাকা ট্যাক্স দিতে হয়। বাকি থাকে ৬০ কোটি টাকা। এখন প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে ৬০ কোটি টাকা। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নিট মুনাফা শূন্য হয়ে যাচ্ছে।
এ দিকে ব্যাংকগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমকে বাংলাদেশ ব্যাংক অধিক হারে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সিএসআর কার্যক্রমে উৎসাহিত করতে ব্যাংকের বার্ষিক অর্থনৈতিক মানদণ্ডের সূচকে (ক্যামেলস রেটিং) সিএসআরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ যে ব্যাংক যত বেশি সিএসআর করবে মানদণ্ডের সূচকে ওই ব্যাংক তত ভালো নম্বর পাবে। ব্যাংকারদের মতে, এ সিএসআর কার্যক্রমকে করের আওতাভুক্ত করা হয়নি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শুধু তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানে সিএসআর কার্যক্রম করলে তার ওপর ১০ শতাংশ কর রেয়াত সুবিধা দিচ্ছে। যেমনÑ কোনো অন্ধকে ব্যাংক আর্থিক সুবিধা দিলে তার ওপর কোনো ছাড় নেই। কিন্তু এনবিআরের তালিকাভুক্ত কোনো অন্ধদের কল্যাণে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানকে দিলে তার ওপর কর সুবিধা পাচ্ছে। এর পরও ৩০ শতাংশ সিএসআর কার্যক্রমে কর দিতে হচ্ছে। ব্যাংকারদের মতে, এতে দুই ধরনের অসুবিধা হচ্ছে। প্রথমত ব্যাংক সরাসরি প্রকৃত সুবিধাভোগীকে আর্থিক সহায়তা দিতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের সহায়তা করা হচ্ছে তারা শতভাগ সুবিধা পাচ্ছে কি না এ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ব্যাংকারদের মতে, সিএসআর কার্যক্রমকে করের আওতামুক্ত না করায় অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাংক সিএসআর কার্যক্রম এড়িয়ে চলে।
জাকাতকে ব্যয় হিসেবে দেখে না আয় কর আইন : ইসলামি ব্যাংকগুলো শরিয়া ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়ায় ইসলামের ৫টি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম স্তম্ভ বাধ্যতামূলকভাবে জাকাত দিতে হয় ব্যাংকের আয়ের ওপর। কিন্তু জাকাতকে ব্যয় হিসেবে অর্থাৎ বকেয়াভিত্তিক হিসাব হিসেবে গণ্য করে না এনবিআর। এতে কোনো ব্যাংক ৫ কোটি টাকা জাকাত দিলে ৪০ শতাংশ হিসেবে ২ কোটি টাকা কর দিতে হয়।
মুনাফার ওপর কর দিতে হয় সাধারণ গ্রাহকদের : যেসব আমানতকারীর টিআইএন নেই তাদের মুনাফার ওপর থেকে ১৫ শতাংশ কর আদায় করা হচ্ছে। সব ধরনের আমানতের মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ আয়কর দিতে হয় বাধ্যতামূলকভাবে। ব্যাংকাররা জানান, আমানতকারীদের একটি বড় অংশ ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত রয়েছে। তাদের ওপর থেকে করভার প্রত্যাহার না করায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ আমানতকারীরা।
আবগারি শুল্ক ১৫ শতাংশ : ব্যাংক লাখ টাকা থাকলেই আবগারি শুল্ক হিসেবে কেটে রাখা হবে ৮০০ টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে আবগারি শুল্কের হার বাড়ানোর ফলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন অর্থমন্ত্রী। যদিও অর্থমন্ত্রী বলছেন ব্যাংকে যারা লাখ টাকা রাখে তারা সম্পদশালী। এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ও সরকারের সাবেক সচিব শাহ্ আব্দুল হান্নান শনিবার নয়া দিগন্তকে বলেন, ব্যাংক ডিপোজিট এক লাখ টাকার ওপরে হলে তার ওপর ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক ধার্য করা হয়েছে। এটা করা আমি সঠিক মনে করি না। এটা তুলে ফেলা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। কারণ স্থানীয় উৎপাদনের ওপর কর আরোপ করাকে বলে এক্সসাইজ ডিউটি। কিন্তু ব্যাংকের ডিপোজিট কোনোভাবেই উৎপাদনের সংজ্ঞায় আসে না। সুতরাং ব্যাংকের ডিপোজিটের ওপর এক্সসাইজ ডিউটি আরোপ করা আদৌ ঠিক হয়নি, এটি ৫০০ টাকা করাও ঠিক হয়নি, এখন বৃদ্ধি করে ৮০০ টাকা করাও ঠিক হয়নি।
ব্যাংকের প্রকৃত আয় কমছে, বঞ্চিত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা : ব্যাংকের ওপর নানাবিধ কর আরোপের ফলে ব্যাংকের নিট আয় কমে যাচ্ছে। এতে যে হারে বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগের ওপর লভ্যাংশ পাওয়ার কথা ছিল তা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। পাশাপাশি সাধারণের দুর্ভোগও বাড়ছে। ব্যাংকাররা জানান, ব্যাংকের ওপর যেকোনো ধরনের ওপর করারোপ করলে ব্যাংক তার নিজস্ব তহবিল থেকে পরিশোধ করে না। একপর্যায়ে তা জনগণের ওপরই চাপিয়ে দেয়া হয়। এমনিতেই গ্রাহকরা নানা কারণে ব্যাংকবিমুখ, এর ওপর নতুন করে আবগারি শুল্ক বাড়িয়ে দেয়ায় ব্যাংকের প্রতি ব্যাংকগুলোর অনাস্থা আরো বেড়ে যাবে। সব ধরনের গ্রাহকের ওপর নানা ধরনের বাড়তি সার্ভিস চার্জ চাপানো হয়। সব মিলে সাধারণ জনগণেরই মাশুল দিতে হয় শেষ পর্যায়ে এসে।


http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/225847