৫ জুন ২০১৭, সোমবার, ৪:০১

ভ্যাট আবগারি শুল্কে আতঙ্ক

নতুন ভ্যাট আইন জীবনযাত্রা ব্যয় বাড়াবে -মির্জ্জা আজিজ : মানুষকে ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে দূরে রাখতে ব্যাংক আমানতে আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে -সালেহউদ্দিন

অর্থনৈতিক রিপোর্টার : নতুন বাজেটে একক ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ, ব্যংক আমানতে আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি আর সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর ঘোষণায় আতঙ্কিত সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা। বাজেট ঘোষণার দিনই বেড়েছে গ্যাসের দাম যা শিল্পদ্যোক্তাদের চাপে ফেলে দিয়েছে। একই সময়ে নিম্ন আয়ের মানুষের প্রধান খাদ্য মোটা চালের বাজার চড়া। এই পরিস্থিতিতে আগামি ১ জুলাই থেকে ১৫ শতাংশ একক হারে ভ্যাট কার্যকর হলে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়বে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। এর উপরে নতুন বাজেটে সরকার হাত দিয়েছে সাধারণ মানুষের আয়ে। সঞ্চয়ের মুনাফার ওপর নির্ভরশীল লাখো পরিবারকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে ব্যাংক আমানতে আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি আর সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমানোর ঘোষণা দিয়ে। এমনিতেই বর্তমানে ব্যাংক মুনাফার যে হার তা থেকে মূল্যস্ফীতি বাদ দিলে লোকসান হচ্ছে আমানতকারীদের। এর ওপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি তাদের ক্ষতির হার আরও বাড়িয়ে দেবে। যারা সঞ্চয়পত্রের মুনাফাও ওপর নির্ভরশীল তাদেরও আয় কমে যাবে অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী দুই মাসের মধ্যে এই মেয়াদী বন্ডের সুদহার কমিয়ে আনলে। সামনের দিনগুলো কিভাবে চলবে তা নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ আর ব্যবসায়ীরা আতঙ্কের মধ্যে আছেন নতুন বাজেট নিয়ে।
জনগণের ওপর ভয়াবহ বোঝা চাপিয়ে দেওয়া বাজেটকে অর্থমন্ত্রী ‘জীবনের শ্রেষ্ঠতম বাজেট’ বললেও এটাকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না অর্থনীতিবিদ আর বিশ্লেষকরা। ‘নতুন ভ্যাট আইনের ১৫ শতাংশ ভ্যাট জীবনযাত্রার খরচ বাড়াবে’- এমন মত দিয়েছেন সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, “এই আইনটি বাস্তবায়ন করার সময় নির্ধারণ সঠিক হয়নি। এমনিতেই এখন ধান-চালের দাম বাড়ছে। নতুন আইনের কারণে অন্য পণ্যের দামও বাড়ার আশঙ্কা আছে। এতে সার্বিক জীবনযাত্রা আরও ব্যয়বহুল হয়ে যাবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “সব জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এরপরও মূল্যস্ফীতি নাকি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। কোথায় জরিপ করছে? কীভাবে করছে? কিছুই মাথায় আসে না।”
ব্যাংক সুদে আবগারি শুল্কারোপ প্রসঙ্গে শুক্রবার বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘এক লাখ টাকার আমানতকারীরা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্পদশালী। তারা বর্ধিত আবগারি শুল্ক বহন করতে পারবেন।’ অর্থমন্ত্রীর এই দাবিকে ‘অদ্ভুদ’ বলে মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “এক লাখ টাকার মালিককে যথেষ্ট সম্পদশালী বলাটা একটা অদ্ভুত বিষয়। অবাক লাগে কী করে এসব কথাবার্তা তিনি বলেন।”
“গরিবের সম্পদ হচ্ছে কিছু নগদ টাকা। সেটি বড়জোর ১ লাখ থেকে তিন-চার লাখ টাকা হতে পারে। এটা গরিবের তিলে তিলে সঞ্চয়। বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থায় এটা খুবই কম। এ কারণে তিনি ওই অর্থ দিয়ে কোনো সম্পদ কিনতে পারেন না। এ অর্থের সঙ্গে বাড়তি কিছু পাওয়ার আশায় তারা ওই অর্থ ব্যাংকে রাখেন।”
“ব্যাংক আমানতে আবগারি শুল্ক বাড়ানো অন্তর্ভুর্ক্তিমূলক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। মানুষকে ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে দূরে রাখতে প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক আমানতে আবগারি শুল্ক বসানো হয়েছে। মদ, গাজাসহ কিছু পণ্য রোধকল্পে আবগারি শুল্ক হয়। এবারের বাজেটে ব্যাংকিংয়ে আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে।”
এবারের বাজেটে বাস্তবায়ন হতে যাওয়া নতুন ভ্যাট আইন প্রসঙ্গে বিশ্লেষকরা বলেছেন, এই আইনটির সাফল্য নির্ভর করছে আমদানি বা উৎপাদন পর্যায় থেকে সরবরাহ পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ীদের সঠিক হিসাব রাখার ওপর। ব্যবসায়ীরা যদি সঠিকভাবে হিসাব রাখতে পারেন, তবে নিজের দেওয়া ভ্যাটের টাকা রেয়াত নিতে পারবেন। সঠিক হিসাব না রাখলে শেষ পর্যন্ত ভ্যাটের টাকা ভোক্তার পকেট থেকেই যাবে।
বাজেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নতুন ভ্যাট আইনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে যে অব্যাহতি আছে, তা আগেও ছিল। এতে নতুন আইনটি মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের জন্য বাড়তি পকানো সুবিধা আনতে পারেনি। বোতলজাত পানি, টুথপেস্ট, ব্রাশ,কাপড়চোপড়, চা, আসবাবপত্রসহ অতি প্রয়োজনীয় পণ্যে ভ্যাট বসবে। বিদ্যুৎ বিলেও আগের চেয়ে বেশি ভ্যাট দিতে হবে। রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। এসি বাস, ট্রেন কিংবা লঞ্চে যাতায়াত করলেও খরচ বাড়বে।
‘নতুন ভ্যাট আইনের অজুহাতে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তার ওপর বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দিতে পারেন’ উল্লেখ করে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, “সঠিকভাবে হিসাব রাখতে পারলে পণ্য বা সেবার দাম বাড়ার কথা নয়। ক্রেতাদের এ বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। তাঁদের জানতে হবে, কোন কোন পণ্যে ভ্যাট আছে, কোনটিতে নেই।” সরকারের এই বিষয়ে প্রচারণা চালানো উচিত বলে মত দেন তিনি।
এদিকে বিবিএস’র হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বার্ষিক মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশের মতো। এ অবস্থায় ব্যাংকে রাখা টাকার ওপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দিয়েছে এনবিআর। বছরে একবার এই শুল্ক দিতে হয়। এর ফলে ১ লাখ টাকার বেশি থাকলেই আগের চেয়ে ৩শ টাকা বেশি শুল্ক দিতে হবে। আগামী ১ জুলাই থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।
নতুন বাজেটে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুসারে, ছোট সঞ্চয়কারীর জন্য কিছুটা ছাড় দিয়ে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত কোনো আবগারি শুল্ক বসবে না। ২০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫০ টাকা আবগারি শুল্ক দিতে হতো; এখন আর দিতে হবে না। নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী, ১ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ৫০০ টাকার পরিবর্তে ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক দিতে হবে। ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত দেড় হাজারের পরিবর্তে আড়াই হাজার টাকা দিতে হবে। ১ কোটি টাকা থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত আবগারি শুল্ক সাড়ে ৭ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১২ হাজার টাকা করা হয়েছে। আর ৫ কোটি টাকার বেশি থাকলেই ২৫ হাজার টাকা দিতে হবে।
আবগারি শুল্ক হিসাব করা হয়, সারা বছরে কোনো গ্রাহকের হিসাবে কোনো এক দিন সর্বোচ্চ কত টাকা ছিল। এর মানে হলো, কারও হিসাবে টাকার পরিমাণ বাড়তে পারে, আবার কমতেও পারে। কিন্তু সর্বোচ্চ বেড়েছিল যেদিন, সেদিনের পরিমাণটির ওপর আবগারি শুল্ক বসে। বছরে একবারই হিসাব দিতে হবে গ্রাহককে।
ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, “ব্যাংকে টাকা রাখার ওপর আবগারি শুল্ক বৃ
বৃদ্ধির সময়টি সঠিক হয়নি। কেননা ব্যাংকে সুদের হার মূল্যস্ফীতির চেয়েও কম। এতে ব্যাংকে টাকা রাখলে এক বছর পর সুদের টাকা যোগ করলেও এর মূল্যমান আগের চেয়ে কমে যায়। এখন আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি করায় তা আরও কমে যাবে।”
এদিকে করমুক্ত আয়সীমা আগের মতোই আড়াই লাখ টাকা রাখা হয়েছে। এতে সীমিত আয়ের মানুষ চাপে থাকবেন। কেননা, চলতি অর্থবছরে গড়ে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশের মতো ছিল। এর মানে, করমুক্ত আয়সীমার কিছু ওপরে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের জীবনযাত্রায় খরচ সাড়ে ৫ শতাংশের মতো বেড়েছে। একদিকে মূল্যস্ফীতির জন্য বাড়তি টাকা খরচ হয়ে গেছে, সামনে একই হারে কর দিতে হবে। এতে সামগ্রিকভাবে ছোট করদাতার খরচ বাড়বে, সঞ্চয় কমবে। যারা গতবার আড়াই লাখ টাকার কাছাকাছি গিয়ে করজালের বাইরে ছিলেন, কিন্তু এবার বেতন-ভাতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সেই সীমা পেরিয়ে যাচ্ছেন, তারা করজালে আটকে যাবেন।
এবারের বাজেটে বিপাকে পড়তে যাচ্ছেন বেসরকারি খাতের পদস্ত কর্মকর্তারা। গত বাজেটে বেসরকারি খাতের ম্যানেজমেন্ট পর্যায়ের কর্মকর্তাদের টিআইএন নম্বর নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এবারের বাজেটে তাদের আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হলো।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী সঞ্চয়পত্র নিয়ে তেমন কোনো কিছু বলেননি। বাজেট ঘোষণার পরদিনই সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী শিগগিরই সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন। নতুন বাজেটে ব্যাংকে টাকা রাখার খরচ বৃদ্ধির মাধ্যমে মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষকে চাপের মুখে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। আবার সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমালে তারা আরও কোনঠাসা হয়ে পড়বে। ব্যাংকে টাকা রাখলে খরচ বাড়বে; আবার সঞ্চয়পত্রে মুনাফা কমবে। নিরাপদে টাকা রাখা মধ্যবিত্তের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।
আকাশপথে বিদেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে আগের তুলনায় খরচ বাড়বে। ভ্রমণ কর দ্বিগুণ করা হয়েছে। সার্কভুক্ত দেশে ১ হাজার টাকার পরিবর্তে ২ হাজার টাকা এবং ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য দেশে দেড় হাজার টাকার পরিবর্তে ৩ হাজার টাকা করা হয়েছে। এ টাকা বিমান টিকিটের সঙ্গে কেটে রাখা হবে।


https://www.dailyinqilab.com/article/82496/