৫ জুন ২০১৭, সোমবার, ৪:০০

কাগজে কৌশলী ভ্যাটে ব্যয় বাড়বে শিক্ষায়

মা-বাবা কষ্ট করে হলেও আদরের সন্তানকে চাহিদামাফিক বই-খাতার জোগান দেন। সন্তান শিক্ষিত হয়ে চাকরি করবে, পরিবারের অভাব দূর হবে—স্বপ্ন দেখেন তাঁরা। তাঁদের এই স্বপ্নের সঙ্গে রাষ্ট্রের চাওয়াও একাকার—পুরো জাতি শিক্ষিত হবে, কর্মদক্ষতা বাড়বে। এতে উত্পাদন ও প্রবৃদ্ধিও বাড়বে, সমৃদ্ধ হবে দেশ। এ কারণেই প্রতিবছর বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ে, বিনা মূল্যে পাঠ্য বই সরবরাহ করে সরকার। গরিব অভিভাবকরা যাতে সন্তানকে স্কুলের বদলে কাজে না পাঠান, সে জন্য উপবৃত্তি ব্যবস্থার পেছনেও সরকার বিপুল অর্থ ঢালছে। গত ১ জুন ঘোষিত আগামী অর্থবছরের বাজেটেও পাঠ্য বই থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ছাড়া সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে ভ্যাটমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ প্রস্তাবিত বাজেটেই আবার কাগজের মতো অপরিহার্য উপকরণের দাম বাড়িয়ে প্রান্তিক মানুষের শিক্ষার খরচ বৃদ্ধির আয়োজনও রাখা হয়েছে। 

শিক্ষার মূল উপকরণ কাগজের ওপর সরবরাহ পর্যায়ে থাকা ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) প্রত্যাহারের বদলে উল্টো উত্পাদন পর্যায়ে আরোপ করা হয়েছে চার গুণ ভ্যাট। সেখানেই ক্ষান্ত থাকেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। দেশি কাগজশিল্পকে সুরক্ষা দিতে এত দিন বাজারমূল্যের চেয়ে প্রায় অর্ধেক দরে সরবরাহ পর্যায়ে ‘ট্যারিফ মূল্য’ নির্ধারণ করে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ ছিল। বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন বাজেট প্রস্তাবের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে করা এক আবেদনে ওই ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু ভ্যাট প্রত্যাহার করার বদলে ট্যারিফ মূল্য প্রত্যাহার করা হয়েছে। এতে সরবরাহ পর্যায়েও বিভিন্ন ধরনের কাগজের ওপর দ্বিগুণ পরিমাণ ভ্যাট আরোপ হচ্ছে। কৌশলে দেশি মিলগুলোতে উত্পাদিত কাগজের ওপর এভাবে ভ্যাট আরোপ করায় কেবল কাগজশিল্পেই বিপর্যয় নেমে আসবে না, হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে শিক্ষিত জাতি গঠনে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন কর্মসূচিও বিফলে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শিক্ষাবিদ ও গবেষকরা এভাবে ভ্যাট আরোপের সমালোচনা করে বলেছেন, কাগজসহ সব ধরনের শিক্ষা উপকরণ থেকে ভ্যাট সরিয়ে তা সহজলভ্য করতে হবে।
মিল মালিকরা জানান, শুধু ভ্যাটই নয়, কাগজ তৈরির প্রধান উপকরণ পাল্পের দাম এখন আন্তর্জাতিক বাজারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে প্রতি টন পাল্পের আমদানি মূল্য ছিল ৪৬৫ থেকে ৪৭০ ডলার। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৬৯০ থেকে ৭০০ ডলার। ফলে পাল্পের দামসহ প্রতি টন কাগজের উত্পাদন ব্যয় পড়ছে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ও চোরাই কাগজে বেহাত বাজারে টিকে থাকতে দেশি মিলগুলো তা ৬২ হাজার থেকে ৬৩ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। মিল মালিকরা জানান, পাল্পের দাম বেড়ে যাওয়ায় এমনিতেই কাগজের উত্পাদন ব্যয় ও দাম বেড়েছে। ভ্যাট বাড়িয়ে তা আরো বাড়ানো হলে কেবল কাগজশিল্পই ধ্বংস হবে না, সাধারণ পরিবারের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর পক্ষে বই-খাতা কেনাও সম্ভব হবে না। ভারী শিল্প, বিপুল বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের পাশাপাশি শিক্ষা উপকরণ বিবেচনায় কাগজের ওপর আরোপিত ভ্যাট সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহারের দাবি জানান তাঁরা।
এনবিআরের সদস্য (ভ্যাট প্রশাসন) ও ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের পরিচালক রেজাউল হাসান গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, চলতি অর্থবছর দেশে উত্পাদিত বিভিন্ন ধরনের কাগজের ট্যারিফ মূল্যের ওপর ৪ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ আছে। আগামী বাজেটে ট্যারিফ ভ্যালু প্রত্যাহার করে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে উত্পাদন পর্যায়ে ব্যবহূত উপকরণের ওপর মিল মালিকরা রেয়াত পাবে।
বাংলাদেশ পেপার মিল অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা জানান, খাতা হিসেবে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যে কাগজ ব্যবহার করে, তার ট্যারিফ ভ্যালু নির্ধারণ করা আছে ২৫ হাজার টাকা টনপ্রতি। উত্পাদন পর্যায়ে এই ২৫ হাজার টাকার ওপরে এত দিন ৪ শতাংশ হারে এক হাজার টাকা ভ্যাট দিতে হতো। এখন ট্যারিফ ভ্যালু তুলে নিলে প্রতি টন কাগজের উত্পাদন পর্যায়ে মূল্য ধরা হবে ৬৩ হাজার টাকার মতো। এই ৬৩ হাজারের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ হলে গুনতে হবে ৯ হাজার ৪৫০ টাকা। অর্থাৎ উত্পাদন পর্যায়ে প্রতি টন কাগজে বাড়তি প্রায় সাড়ে আট হাজার টাকা ভ্যাট দিতে হবে। এ ছাড়া সরবরাহ পর্যায়েও ১৫ শতাংশ ভ্যাট বহাল রাখা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, একদিকে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার অপব্যবহারে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি হওয়া বিপুল পরিমাণ কাগজ প্রতিদিন দেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে। আবার মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অবৈধভাবে ও পাচার হয়ে বাংলাদেশে বিপুল হারে কাগজ ঢুকছে প্রতিনিয়ত। এসব কাগজের ভিড়ে প্রায় কয়েক লাখ শ্রমিক-কর্মচারীসহ ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা দেশি কাগজকলগুলো রুগ্ণ হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় যেখানে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার রোধ, অবৈধভাবে বিদেশি কাগজের অনুপ্রবেশ ঠেকানোর পাশাপাশি দেশি কাগজগুলোকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে স্থানীয়ভাবে উত্পাদিত কাগজের ওপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার করা জরুরি, তখন এভাবে বাড়তি ভ্যাট আরোপ করায় দেশি কাগজশিল্প ধ্বংস হবে। একই সঙ্গে এর প্রভাব পড়বে সব ধরনের শিক্ষার্থীর ওপর। বাজেট পাস হওয়ার আগেই দেশি কাগজের ওপর আরোপিত সব ধরনের ভ্যাট প্রত্যাহার করে সম্পূর্ণ অব্যাহতি সুবিধা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ও পার্ল পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রেজাউল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, এমনিতেই বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার অপব্যবহার, মিথ্যা ঘোষণা ও চোরাচালানের মাধ্যমে আসা কাগজ সারা দেশে বাজারজাত হচ্ছে। এসব কাগজের কারণে দেশি কাগজশিল্প এমনিতেই ধুঁকছে। এ অবস্থায় কাগজের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হলে এ শিল্প আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তা ছাড়া এ খাতে ভ্যাট রেয়াত পাওয়াও সম্ভব নয়। ভারী শিল্প বিবেচনায় কাগজশিল্পের ওপর আরোপিত সব ধরনের ভ্যাট প্রত্যাহার করা জরুরি। না হলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা কাগজশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।
বর্তমানে দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে ৮৭টি পেপার মিল চালু রয়েছে উল্লেখ করে রেজাউল ইসলাম আরো বলেন, এসব শিল্পে সরাসরি শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছে প্রায় ৩৬ হাজার। ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজসহ হিসাব করলে কাগজশিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা কয়েক লাখ ছাড়িয়ে যাবে। তিনি বলেন, বড় মিলগুলো সরকারকে নিয়ম মেনে ভ্যাট, শুল্ক ও কর দেয়। কিন্তু বগুড়া, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট ছোট অনেক পেপার মিল রয়েছে, যারা বিদ্যমান হারে প্রতি টনে চার হাজার টাকা ভ্যাটই পরিশোধ করে না। এসব কারখানা কিভাবে আগামী অর্থবছর থেকে টনপ্রতি ১২ হাজার টাকা ভ্যাট দেবে?
শিক্ষাবিদ ও গবেষক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কাগজ শিক্ষার মূল উপকরণ। সরকার পাঠ্যপুস্তকে থাকা ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করে খাতা হিসেবে শিক্ষার্থীদের ব্যবহূত কাগজের ওপর ভ্যাট বাড়ালে তা খুবই অগ্রহণযোগ্য। কাগজসহ সব ধরনের শিক্ষা উপকরণ সহজলভ্য না হলে তা শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে অন্তরায় হবে। বাজেট পেশের সময় ও সারা বছরই সরকারের মন্ত্রী ও নীতিনির্ধারকরা শিক্ষার সম্প্রসারণে নানা কথা বলেন, কিন্তু বাস্তবে তার ফল দেখা যায় না। আমার সোজা কথা, কাগজসহ শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত সব উপকরণের ওপর থেকে ভ্যাট-ট্যাক্স প্রত্যাহার করে তা সহজলভ্য করতে হবে। ’
বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন কর্মকর্তারা জানান, কাগজ ও কাগজজাতীয় পণ্য উত্পাদনকারী ৮৭টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান অফসেট, নিউজপ্রিন্ট, লেখা ও ছাপার কাগজ, প্যাকেজিং পেপার, ডুপ্লেক্স বোর্ড, মিডিয়া পেপার, লাইনার, স্টিকার পেপার, বিভিন্ন গ্রেডের টিস্যু পেপারসহ অন্যান্য সব ধরনের কাগজ উত্পাদন করছে। দেশে উত্পাদিত এসব কাগজ দেশের সম্পূর্ণ চাহিদা মিটিয়ে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করছে, তেমনি দেশে উত্পাদিত কাগজ রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
গত ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে করা এক আবেদনে অ্যাসোসিয়েশন জানায়, দেশের মিলগুলোর উত্পাদিত কাগজ থেকে তৈরি হচ্ছে এক্সারসাইজ বুক, স্পাইরাল নোটবুক ও খাতা, যা শিক্ষা-সংস্কৃতি বিকাশে অপরিসীম ভূমিকা রাখছে। সরকার দেশের মিলগুলোর সরবরাহ করা কাগজে ছাপানো বই প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও ইবতেদিয়া স্তরে বিনা মূল্যে সরবরাহ করছে। নিরক্ষতার হার কমিয়ে জাতিকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা বর্তমান সরকারের লক্ষ্য। এ জন্যই বাজেটের একটি বড় অংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীরা বিনা মূল্যে বই পেলেও শিক্ষার অন্যতম উপকরণ খাতার (এইচএস কোড-৪৮.২০) ওপর এনবিআর ভ্যাট আরোপ করায় শিক্ষার্থীদের অধিক মূল্যে তা কিনতে হচ্ছে। ফলে সরকারের সর্বস্তরে ও স্বল্প ব্যয়ে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার অনেকটাই ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা জানান, অন্য দেশের মতো বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাও খোলা কাগজের পরিবর্তে রেডিমেড বা প্রস্তুত করা খাতাপত্র ব্যবহারে বেশি আগ্রহ ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। বিশ্বের অনেক দেশে শিক্ষার্থীদের বইয়ের সঙ্গে শিক্ষা উপকরণ হিসেবে খাতাও বিনা মূল্যে সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া বর্তমানে লেখাপড়ার প্রায় সব স্তরে কম্পিউটারের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বাড়ায় কম্পিউটার প্রিন্টের জন্য এ-৪ (এ-ফোর) আকারের কাগজের ব্যবহারও অনেক বেড়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে আইসিটি খাতের জন্য এ-৪ কাগজ একটি অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। দেশে সাক্ষরতার হার বাড়াতে হলে শিক্ষা উপকরণ হিসেবে কাগজ, খাতা এবং এ-৪ কাগজের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহার করা জরুরি। এতে শিক্ষার্থীরা কম খরচে ভালো মানের বিভিন্ন গ্রেডের এক্সারসাইজ বুক, স্পাইরাল নোটবুক, খাতা ও এ-৪ কাগজ ব্যবহারের সুযোগ পাবে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/06/05/505195