৫ জুন ২০১৭, সোমবার, ৩:৫৬

বিদেশ সফরই বেশি পছন্দ সরকারি কর্মকর্তাদের

বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে সরকারি আদেশের ব্যত্যয় ঘটছে। মাসের পর মাস গুরুত্বপূর্ণ ফাইল পড়ে থাকছে অনেক সরকারি কর্মকর্তার টেবিলে; অথচ কখনও সরকারি অর্থে, কখনওবা দাতা সংস্থার অর্থে বিদেশ সফরে ব্যস্ত থাকছেন তারা। কখনও মাসে একাধিকবার বিদেশে যাচ্ছেন এসব কর্মকর্তা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দাতা সংস্থার সঙ্গে আলোচনা, সভা-সেমিনারে যোগদান কিংবা প্রশিক্ষণের অজুহাতে বিদেশ সফর করছেন তারা। ফলে ঝুলে থাকছে অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গত দুই মাসে অন্তত ২৫টি টিম বিদেশ সফর করেছে। বর্তমানে বিদেশে রয়েছে ১০টি টিম। দেশের বাইরে রয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ ছয়জন সচিব।

এদিকে সম্প্রতি হাওর অঞ্চল যখন পানিতে ডুবছে তখনও বিদেশ সফরে গিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন হাওর উন্নয়ন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। শুধু এ দপ্তরের কর্মকর্তারাই নন, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা গত ১ বছরে ১৬ বার বিদেশ সফরের গিয়ে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি সফরের নামে বিদেশে গিয়ে ওই কর্তা ব্যক্তিগত কাজ করেছেন।


সরকারি সফরের সময় ১০ দিন ধরে ৪ দিন সরকারি কাজ করে বাকি ৬ দিন করেছেন ব্যক্তিগত কাজ। ওই ৬ দিনও যুক্ত হয়েছে সরকারি সফরের তালিকায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের এক সচিবও বিদেশে থাকতে বেশ পছন্দ করেন। প্রতি মাসেই তিনি দু'বার সরকারি সফরের কথা বলে বিদেশে যান। অভিযোগ রয়েছে, যে কাজে তিনি বিদেশে যান, তাতে একজন যুগ্ম সচিব বা অতিরিক্ত সচিব গেলেও চলে। কিন্তু তাদের না পাঠিয়ে বার বার ওই কর্তা বিদেশ যান। ১৯৮৪ ব্যাচের আরেকজন সচিব মাসের ১০ দিনই বিদেশে থাকেন বলে তার ব্যাচের সচিবরা তাকে 'উড়ন্ত' সচিব বলে থাকেন। এ কর্তা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও দাতা সংস্থার আমন্ত্রণ এনে বিদেশে ঘোরেন। দেশে থাকলে অফিস করেন বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। অভিযোগ রয়েছে, শীর্ষ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা গত কয়েক বছরে দেশের বাইরে বাড়ি করেছেন। কেউ কেউ উন্নত দেশের গ্রিন কার্ড নিয়েছেন। এ জন্য তারা সরকারি সফরের সুযোগ নিয়ে বিদেশে ব্যক্তিগত কাজ করেন। দাতা সংস্থার অর্থে বিদেশ গিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করার অভিযোগ ওঠায় অনেক কর্মকর্তা পরে তাদের টাকা ফেরত দিয়েছেন। এ ঘটনা বেশি ঘটছে বড় বড় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে। এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের নীতিমালা সংশোধনের কাজ চলছে।

এ ব্যাপারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বিদ্যমান বিদেশ সফরের নীতিমালায় স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। ফলে কর্মকর্তারা যে যার ইচ্ছামতো বিদেশ সফর করায় সরকারের যেমন আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে কর্মঘণ্টার অপচয় ঘটছে। কাজকর্মে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। সফরের মূল উদ্দেশ্যও ব্যাহত হচ্ছে। এটি রোধে নতুন নীতিমালার খসড়া তৈরি করা হয়েছে। খসড়া তৈরিতে সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই এটি সচিব কমিটির বৈঠকে পাঠানো হবে।

বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে সরকারি আদেশও পালন করা হচ্ছে না। গত ২০১৪ সালের এক সরকারি আদেশে বলা হয়েছিল, মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিব একসঙ্গে বিদেশ সফর করতে পারবেন না। অথচ গত এক বছরে একসঙ্গে প্রায় ২০ জন মন্ত্রী ও সচিব একাধিকবার বিদেশ সফর করেছেন। কোনো কোনো সময়ে একসঙ্গে ১০ জন সচিবও বিদেশ সফরে থাকছেন। অভিযোগ রয়েছে, বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও সংশ্লিষ্টতার চেয়ে দাপট ও প্রভাবকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। কর্মকর্তাদের ঘন ঘন বিদেশ সফরে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সংশ্লিষ্টদের শেখ হাসিনার অসন্তোষের কথা জানানো হয়। কার্যালয়ের এক চিঠিতে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর কমানোর পরামর্শও দেওয়া হয়। এমন প্রেক্ষাপটে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের লাগাম টেনে ধরার লক্ষ্যে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোজাম্মেল হক খান সমকালকে বলেন, 'কর্মকর্তারা শুধু বিদেশ সফরে ব্যস্ত_ কথাটি ঠিক নয়। প্রশিক্ষণ বা সরকারি কাজে কর্মকর্তারা বিদেশে যাচ্ছেন। তবে কেউ যদি এ সুযোগ ইচ্ছাকৃতভাবে বেশি নেন, তা হলে এটি খারাপ।' তিনি বলেন, 'কর্মকর্তারা যত দক্ষ ও অভিজ্ঞ হবেন, যত বেশি প্রশিক্ষণ পাবেন, প্রশাসনে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।'

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বিদেশ থেকে প্রায় দুই হাজার কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এর মধ্যে চলতি বছর এ পর্যন্ত তিনশ' কর্মকর্তা, ২০১৬ সালে পাঁচশ', ২০১৫ সালে চারশ', ২০১৪ সালে ৪৫০, ২০১৩ সালে ২৫০ জন কর্মকর্তা বিভিন্ন দেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এতে দেখা গেছে, বিগত দুই বছরে বিদেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণের আগ্রহ অনেক বেড়েছে। কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ কোনো বরাদ্দ নেই। কর্মকর্তারা বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) বিভিন্ন দাতা সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রকল্পের মাধ্যমে বিদেশে প্রশিক্ষণ নেন। এতে প্রভাবশালী কর্মকর্তারাই প্রশিক্ষণের নামে ঘুরেফিরে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সুযোগ পান। প্রতি বছর বিদেশ থেকে উন্নত প্রশিক্ষণ নেওয়ার হার বাড়লেও সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর এর প্রভাব কতটুকু পড়ছে, তা নিয়ে সন্দিহান সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে সংশোধন হচ্ছে বিদেশ সফরের নীতিমালা।

বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন মন্ত্রী, সচিবের পিএস এবং এপিএসরা। অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীকে দিয়ে যে কোনো সফরের ফাইলে সম্মতি পেতে তাদের হাতে রাখেন কর্মকর্তারা। এমনও দেখা যাচ্ছে, প্রতি মাসেই একজন কর্মকর্তা সরকারি অর্থে একাধিকবার বিদেশে যাচ্ছেন। এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, স্বাস্থ্য, জনপ্রশাসন, ত্রাণ ও দুর্যোগ এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে। একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব গত ১১ মাসে ১৬ বার সরকারি অর্থে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। যুগ্ম সচিব থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত বিদেশ সফরের অনুমতি প্রধানমন্ত্রী দিয়ে থাকেন। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এর আগে ক'বার বিদেশ সফর করেছেন, তা না জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সফরের অনুমতি নেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি এমন একটি ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করেন। পর বিদেশ সফরের নীতিমালা সংশোধনের নির্দেশ দেন।

যা থাকছে সংশোধনীতে :সংশোধিত নীতিমালায় প্রশিক্ষণসহ দাপ্তরিক ও ব্যক্তিগত কারণে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের ওপর কঠোর শর্ত অরোপ করা হচ্ছে। নীতিমালা অনুযায়ী, এখন থেকে কোনো সরকারি কর্মকর্তা ব্যক্তিগত কারণে তিন বছর পর ৩০ দিন এবং দাপ্তরিক কাজে বছরে চারবারের বেশি বিদেশ সফর করতে পারবেন না। বিদেশ সফরের আগে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলকভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। কেউ শর্ত ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও বিধান থাকছে। দাপ্তরিক কাজে বিদেশ গেলে তার সর্বোচ্চ সময়সীমা হবে ১০ দিন। বিদ্যমান বিধিমালায় বছরে ছয় বার সরকারি খরচে বিদেশ সফরের নিয়ম রয়েছে। এছাড়া ব্যক্তিগত কারণে তিন বছর পর ৩০ দিন ছুটি নিতে পারেন তারা।

 

http://bangla.samakal.net/2017/06/05/298445#sthash.GES3jzNY.dpuf