৫ জুন ২০১৭, সোমবার, ৩:১৬

ভ্যাট আর করের বোঝা জনগণের ঘাড়ে

বহমান এই সময়ে

|| জি. মুনীর||

নির্বাচন সামনে রেখে সব সরকারেরই একটা লক্ষ্য থাকে যথাসম্ভব জনকল্যাণমূলক বাজেট দেশবাসীকে উপহার দেয়া। কিন্তু সম্পদের ঘাটতির কারণে বাস্তবে তা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। যখন সরকার দেখে আয়ের পরিস্থিতি তেমন ভালো নেই, কিন্তু সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ আয়ের পরিস্থিতিও সুখকর নয়Ñ তখন বাজেটের আকার বাড়িয়ে সরকার কৌশলী বাজেট প্রণয়নে মনোযোগী হয়, সে বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ যা-ই থাকুক না কেনো। কারণ, ঘাটতি বাজেটের ইতি-নেতির অর্থনৈতিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সাধারণ জনগণের ভাবনার বিষয় নয়। তাই বড় অঙ্কের ঘাটতি রেখে হলেও বড় আকারের বাজেট ঘোষণা করে সরকার জনগণের কাছে এই বার্তাটি পাঠাতে চায় যে, সরকার দেশের জন্য আগের চেয়ে বেশি অর্থ খরচ করবে নতুন অর্থবছরে। কিন্তু বাস্তবতার তাগিদে সরকার রাজস্ব আদায় যথাসম্ভব বাড়ানোর চিন্তা মাথা থেকে তাড়াতে পারে না। তাই সরকার কৌশলী হয়ে চেষ্টাসাধ্যি চালায় কী করে ভ্যাট ও করের হার ও আওতা বাড়িয়ে বাস্তবতা মোকাবেলা করা যায়। তখন চেষ্টা চলে অপ্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর কৌশলী প্রয়োগের। আবার সমালোচনা এড়াতে অপ্রচলিত পণ্যে কর অব্যাহতি দেয়া বা কমানোর উপায় অবলম্বন করে। এই অপ্রচলিত পণ্যের তালিকা যথাসম্ভব দীর্ঘ করে দেখানোর একটা প্রয়াসও থাকে। কিন্তু জনপ্রিয় পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও অন্যান্য করের চাপ ঠিকই বলবৎ রাখা হয়। একই সাথে অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের মারপ্যাঁচও থাকে, যা সাধারণ মানুষের বোধের বাইরে। আসলে এবারের বাজেট প্রণয়নে এসব ক্রিয়া-প্রক্রিয়া আমাদের অর্থমন্ত্রীর মাথায় বড় মাপে ক্রিয়াশীল ছিল। ফলে কার্যকর জনকল্যাণমূলক বাজেট প্রণয়ন তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। বরং ঘটেছে এর উল্টোটি। এবার বাজেট যে, সাধারণ মানুষকে ভ্যাট আর কর ভারে জর্জরিত করবে, সে বিষয়টি স্পষ্ট ধরা পড়েছে।
এবারের বাজেটে ভ্যাট আর করের ভার বাড়ানো হলেও ঘাটতি রয়েছে বড় মাপের। আমরা দেখেছি, এবারের বাজেটের আকার চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। আর আয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে দুই লাখ ৯৩ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা, ব্যয়ের পরিমাণ চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। অতএব, ঘাটতি এক লাখ ছয় হাজার ৭৭২ কোটি টাকা। এত বড় ঘাটতি কী করে মেটানো যাবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। তবে এটুকু স্পষ্ট ভ্যাট ও করের আওতা আর হার বাড়িয়ে জনগণের পকেট কেটে ঘাটতির পরিমাণটা সঙ্কোচনের চেষ্টা ছিল এবারের বাজেট প্রণেতাদের। প্রায় সব অর্থনীতিবিদই বলছেন, এবারের বাজেট অতিমাত্রায় উচ্চাভিলাষী, বাস্তবায়নের অনুপযোগী। তাদের অভিমত, সরকার শেষ পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জনে চরমভাবে ব্যর্থ হবে। তা ছাড়া বাজেটের বাস্তবায়নেও ব্যর্থতা থেকেই যাবে। ফলে বছর শেষে বাজেট সংশোধনের প্রবণতা জোরদার হবে। আমরা যত দিন উচ্চাভিলাষী ভোটমুখী বাজেট থেকে বাস্তবসম্মত আকারের বাজেট নিয়ে জাতির কাছে হাজির না হবো, তত দিন অর্থবছর শেষে সংশোধিত বাজেটে কাটছাঁটের অপচর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব না।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় ঘোষণা করেছেন, ২০১২ সালের ভ্যাট আইনের পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হবে, যেখানে সব পণ্য ও সেবার ওপর ১৫ শতাংশ হারের ফাটরেট রাখা হবে পরবর্তী তিন বছর, শুধু অব্যাহতি পাওয়া ক্ষেত্রগুলো ছাড়া। যদিও বাজেট ঘোষণার আগে থেকেই ভ্যাটের এই একক হার আরোপেরও বিরোধিতা করে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা।
আমরা দেখেছি, বাজেট ঘোষণার আগে উচ্চ আদালত এক রায়ে সরকারকে ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রবেতনের ওপর ভ্যাট আদায় না করার নির্দেশ দেন। বিষয়টি এখন আপিল বিভাগের বিচারাধীন। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রবেতনের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এর আগে ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রবেতন ও ফি’র ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হতো। এবারের নতুন বাজেটে এই হার বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হলো। অথচ এসব স্কুলের ছাত্রদের অভিভাবকেরা এর আগে আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন। কিন্তু এবারের বাজেটে ঘটানো হলো ঠিক এর উল্টোটিÑ ভ্যাট তো প্রত্যাহার হয়ইনি, বরং তা দ্বিগুণ করে দেয়া হলো।
ভ্যাট অব্যাহিত পাওয়া কিছু পণ্য বা সেবা ছাড়া প্রায় সব পণ্য ও সেবার ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হলেও, ছোট ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে এই হার রাখা হয়েছে ৪ শতাংশ। আন্তর্জাতিক আইনের কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক কমালেও এর বিপরীতে বাড়ানো হয়েছে সম্পূরক শুল্ক। এর ফলে যে হারে শুল্ক কমেছে, তার চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে। ফলে এসব খাতে পণ্যের দাম বাড়বে। একই সাথে থাকবে ভ্যাটের নেতিবাচক প্রভাব। কারণ, এবারের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে বড় উৎস হিসেবে ভ্যাটকেই বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে ৮৭ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকার ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া এনবিআরকে আগামী অর্থবছরে ৮৬ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকার আয়কর এবং ৭৩ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার শুল্ক আদায় করতে বলা হয়েছে। এদিকে জনগণকে বোকা বানানোর জন্য, একই সাথে সাধারণ মানুষের বাহবা আদায়ের প্রয়াস হিসেবে অর্থমন্ত্রী নতুন বাজেটে ভ্যাট অব্যাহতি পাওয়া অপ্রয়োজনীয় পণ্যের লম্বা তালিকায় পণ্যের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে নিয়েছেন। কিন্তু এই অব্যাহতির তালিকায় এমন পণ্যের নাম সংযোজন করেছেন, যা এ দেশের মানুষ সারা জীবনে একবারও ব্যবহার করবে না। হাস্যকরভাবে ঘোড়া, গাধা, খচ্চর বা ঘোটকের গোশতে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আমদানি ও সরবরাহ পর্যায়ে শূকরের মেদবিহীন মাংসেও ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। অথচ মানুষের নিত্য ব্যবহারের সাবান, শ্যাম্পু, মশার কয়েলসহ এমন অনেক পণ্যে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে। তাই এ বাজেটে শুভঙ্করের ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা যে চলেছে, তা সহজবোধ্য। একইভাবে আজকের সমাজের বহুল প্রচলিত পণ্য মোবাইল সেটের ওপর আমদানি কর বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
অস্বীকার করার উপায় নেই, মোবাইল ফোন সেট এ দেশের সাধারণ মানুষের নিত্যব্যবহার্য পণ্য হয়ে উঠেছে। মোবাইল ফোনের ব্যবহার অর্থনীতির গতি বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশের মানুষের প্রাত্যহিক কাজে এনেছে অন্য ধরনের গতি। তাই জনগণের বরাবরের প্রত্যাশা, মোবাইল ফোন সেটের দাম দিন দিন আরো কমে আসবে। কিন্তু এবারের বাজেট এর দাম আরো বাড়িয়ে তুলবে। কারণ, প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইল সেটের আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মোটামুটিভাবে ২০ হাজার টাকার একটি মোবাইল সেটের জন্য একজন ক্রেতাকে বাড়তি দাম দিতে হবে আরো ১৩০০ টাকা। চলতি অর্থবছরে মোবাইল হ্যান্ডসেটের আমদানির ওপর ২৪.৪০ শতাংশ হারে কর দিতে হতো। নতুন বাজেটে তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩৬.৬১ শতাংশ। মোবাইল সেট ও ইন্টারনেট মডেম হচ্ছে ইন্টারনেট ব্যবহারের মূল ডিভাইস। এগুলোর দাম বাড়লে তা নিশ্চিতভাবেই সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
কেবল ভ্যাটেই নয়, নির্বাচনের আগের এই অর্থবছরটিতে অর্থমন্ত্রী জনগণের ওপর ঘন করজাল ফেলেছেন বলে সমালোচনা এসেছে। তার এই করজাল থেকে ধনী-গরিব কেউ রক্ষা পাবেন, এমন সুযোগ নেই। নি¤œমধ্যম আয়ের মানুষের জন্য তা বাড়তি ভোগান্তি সৃষ্টি করবে। অর্থমন্ত্রী তার বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে যারা ব্যাংকে এক লাখ টাকা রাখবেন, তাদের বিত্তশালী বলে চিহ্নিত করে তাদের ওপর বাড়তি করের বোঝা চাপিয়েছেন। কিন্তু রাঘব বোয়ালদের ওপর লোক দেখানো কর আরোপ করেছেন। আসলে এই বাজেটে অর্থমন্ত্রী ব্যাংকে রাখা টাকার ওপর বাড়তি আবগারি শুল্ক বসিয়ে ব্যাংকের সাধারণ আমানতকারীদের ক্ষোভের কারণ হয়ে উঠেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, কেউ ব্যাংকে এক লাখ টাকা রাখলে বছর শেষে মুনাফা হতে পারে তিন হাজার টাকা। এর মধ্যে এই মুনাফার ওপর ১৫ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটা হবে ৪৫০ টাকা।
হিসাব পরিচালনার জন্য ব্যাংক নিয়ে যাবে ৫০০ টাকা। এর সাথে এটিএম ব্যবহারের জন্য কাটা হবে আরো ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা। আবার নতুন বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী আবগারি শুল্ক নামে কাটা হবে আরো ৮০০ টাকা। এভাবে একজন এক লাখ টাকার আমানতকারীর মুনাফা ৩০০০ টাকা থেকে চলে যাবে দুই হাজার ২৫০ টাকা। অতএব কার্যত তার মুনাফা দাঁড়াবে মাত্র ৭৫০ টাকা। এ ভাবে গ্রাহকের মুনাফার বেশির ভাগই যাবে সরকারের পকেটে। সেজন্য অনেকেই বলতে শুরু করেছেন এ সরকার জনগণের পকেট কাটা সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও সুপরিচিত ব্যাংকার খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেছেন, এভাবে গ্রাহকের পকেট থেকে কেড়ে নেয়া হচ্ছে অর্থ, এ কাজ একটি রাষ্ট্র করতে পারে না। আবার কেউ বলছেন, এটি দিন-দুুপুরে ডাকাতি ছাড়া আর কিছু নয়।
এবার বাজেটে যে ব্যবস্থাটা অর্থমন্ত্রী করতে যাচ্ছেন, তার সরল অর্থ ব্যাংকে টাকা রাখার অপর অর্থ বিপদের সড়কে পা রাখা। নতুন বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী, যেকোনো ব্যাংক হিসাবে এক লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা জমা বা তোলা হলে বছর শেষে এই হিসাব থেকে ৮০০ টাকার আবগারি শুল্ক কেটে নেয়া হবে। প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বর এই শুল্ক গ্রাহকের হিসাব থেকে কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে এই শুল্ক ছিল ৫০০ টাকা। তবে এক লাখ টাকার নিচের লেনদেনের জন্য এই কর দিতে হবে না। চলতি অর্থবছরে এই সীমা ছিল ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত, যখন ২০ হাজার এক টাকা থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত লেনেদেনের জন্য দিতে হতো ১৫০ টাকা। নতুন অর্থবছরে ১০ লাখ এক টাকা থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেনের জন্য আবগারি শুল্ক দিতে হবে দুই হাজার ৫০০ টাকা। বর্তমানে এই পরিমাণ লেনদেনের জন্য আবগারি শুল্ক দিতে হয় এক হাজার ৫০০ টাকা। আগামী অর্থবছরে এক কোটি এক টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকা লেনদেনের জন্য আবগারি শুল্ক দিতে হবে এক হাজার ২০০ হাজার টাকা, যা বর্তমানে দিতে হয় ৭৫০ টাকা। আর নতুন অর্থবছরে পাঁচ কোটি টাকার ওপরে যেকোনো অঙ্কের টাকার লেনদেনের জন্য আবগারি শুল্ক কাটা হবে দুই হাজার ৫০০ টাকা। বর্তমানে এই পরিমাণ অঙ্কের টাকার লেনদেনের জন্য আবগারি শুল্কের পরিমাণ ১৫ হাজার টাকা। আবগারি শুল্কের এই উল্লম্ফনে এরই মধ্যে ব্যাংকের আমানতকারীদের মধ্যে এক ধরনের চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। শুধু আমানতের টাকার ওপরই নয়, নেয়া ঋণের টাকা থেকেও একই হারে আবগারি শুল্ক কাটা হবে।
এদিকে চার দিকে ব্যাংকে টাকা রেখে যখন মুনাফার মুখ দেখতে পাচ্ছেন না সাধারণ গ্রাহক, তখন সঞ্চয়পত্রে টাকা বিনিয়োগের প্রতি মানুষের আগ্রহ সমধিক বেড়ে গেছে। কিন্তু সেখানেও অর্থমন্ত্রীর থাবা প্রসারিত হতে যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী তার বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, এখন থেকে বছরে একবার সঞ্চয়পত্রের সুদের হার পর্যালোচনা করা হবে। তার মতে, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ব্যাংকের আমানতের সুদের হারের চেয়ে সামান্য বেশি হওয়া উচিত। তবে ৭ শতাংশ আর ১১ শতাংশ নয়। আগামী দু-এক মাসের মধ্যে সরকার তা পর্যালোচনা করবে। অর্থাৎ অর্থমন্ত্রী আগামী দুয়েক মাসের মধ্যে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনতে যাচ্ছেন। এটিও এক ধরনের জনগণের পকেট কাটারই নামান্তর। এক দিকে ব্যাংকের আমানতকারীদের হতাশার মধ্যেও আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে, অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রের সুদের হারও কমানো হচ্ছে। এ অবস্থায় বিদেশে অর্থপাচারের মাত্রা আরো বেড়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সমালোচকেরা একটি নতুন পদবাচ্যের জন্ম দিয়েছেন। এর নাম পাপ কর বা সিন ট্যাক্স। বাংলাদেশে কয়েক বছর আগে এই পদবাচ্যটির সূত্রপাত। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অজান্তেই যেন এই পাপ করটি আমাদের দেশে চালু হয়ে গেছে বাজেট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এবারের বাজেটে তা আরো জোরালোভাবে আমাদের ওপর চাপানো হচ্ছে। সমালোচকেরা বলে থাকেন, জাতি হিসেবে আমরা আমাদের ব্যাংক খাতে বড় ধরনের পাপ করে বসে আছি, সে জন্যই এই পাপ কর আমাদের জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছে। আসলে ব্যাংক খাতে লুটপাটের যে নতুন কাব্য-কাহিনীর জন্ম দিয়ে চলেছি, আমাদের জাতিকে সে জন্য পাপ করের বোঝা বছর বছর বইতে হবে বৈ কি! কার্যত সরকার এই পাপ করের বোঝাটি আমানতকারীদের ঘাড়েই চাপায়, যেমনটি এবারের বাজেটের মাধ্যমে চাপিয়েছে আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়ে। জেলা শহরে গাঁজা, আফিম ও দেশীয় মদের মতো নেশাপণ্য বিক্রির জন্য সরকারের বিশেষ অনুমতিপ্রাপ্ত দোকানগুলো রয়েছে, সেগুলো আবগারি দোকান বলে পরিচিত। অর্থনীতির ভাষায় আবগারি শুল্ক হচ্ছে পাপ কর। অর্থমন্ত্রী এম এ মুহিতের প্রায় প্রতিটি বাজেটেই আমরা দেখেছি, একদিকে ব্যাংকগুলোতে চলে লুটপাটের মচ্ছব, অন্যদিকে জনগণের করের টাকায় পূরণ করা হয় সরকারি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি। এটি বাজেটের একটি খারাপ দিক। এর উপস্থিতি এবারের বাজেটেও রয়ে গেছে। এবারের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে দুই হাজার কোটি টাকা। এটি নৈতিক দিক থেকে অন্যায় এবং অবিচারের সংস্কৃতি গড়ে তোলার নিয়ামক। কারণ, সরকারি ব্যাংকের লুটপাটের সাথে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি না করে এই লুটপাটকে স্থায়ী রূপ দেয়া হচ্ছে। আর লুটপাটে হারিয়ে যাওয়ার ফলে ব্যাংকগুলোতে যে মূলধন ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে, তা বছরের পর বছর জনগণের করের টাকায় পূরণ করা হচ্ছে।
এদিকে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ের পরিমাণ যখন হু হু করে বাড়ছে, তখন সরকার নতুন বাজেটে গ্যাসের দামও বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আরেক ডিগ্রি বাড়িয়ে দিয়েছে। নতুন অর্থবছরে দুই চুলার গ্যাসের জন্য বর্তমানের ৮০০ টাকার পরিবর্তে দিতে হবে ৯৫০ টাকা। আর এক চুলার গ্রাহকদের দিতে হবে ৯০০ টাকা। এ নিয়ে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ল মাসে ৩০০ টাকা, বছরে তিন হাজার ৬০০ টাকা। বাড়তি কর দিতে হবে বিমানযাত্রীদেরও।
আরেকটি বিষয়, এবারের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা সহায়তার পরিধি বাড়ানো হয়েছে। তবে এই সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা বা সহায়তা কারা পাচ্ছে, তা নিয়ে অভিযোগ এ সরকারের বিরুদ্ধে এন্তার। ভোটের আগের বছরে এ বিতর্ক আরো জোরদার হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তা ছাড়া কোনো ধরনের কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া এই বিশাল আকারের ও বিশাল ঘাটতি বাজেট বাস্তবায়নের চালেঞ্জটা অনেক বড় ও শঙ্কার কারণ। তা ছাড়া ভ্যাট আর কর ভারে জর্জরিত হওয়ার কারণে জনগণের ভোগান্তি যে এ বাজেট বাড়াবে, সেটাও প্রায় নিশ্চিত।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/225728