৫ জুন ২০১৭, সোমবার, ৩:১৪

একটি ছবি, প্রশ্ন অনেক

হাতকড়া অবস্থায় শুয়ে আছে একটি ছেলে। হাসপাতালের বেডে। হাতকড়া লাগানো আছে বেড স্ট্যান্ডের সঙ্গে, যাতে সে পালিয়ে যেতে না পারে। এ ছবি ভাইরাল হয়ে গেছে সামাজিক গণমাধ্যমে। প্রথম দর্শনে মনে হবে ও হয়তো ভয়ঙ্কর কোনো সন্ত্রাসী। কিংবা জঙ্গি। হয়তো সাম্প্রতিক কোনো জঙ্গিবিরোধী ‘অপারেশনে’ সে আহত হয়েছে এবং পুলিশ চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ওকে ভর্তি করিয়েছে। না, পুলিশ তাকে হাসপাতালে ভর্তি করায়নি। ও নিজে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। আর আমাদের পুলিশ ‘তৎপর’ হয়ে তাকে হাতকড়া পরিয়ে বেডের সঙ্গে আটকে রেখেছে। কিন্তু যা সত্যি নয়, তা হচ্ছে ও কোনো সন্ত্রাসী নয় এবং কোনো ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আহতও হয়নি। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ঘটনা ঘটল এবং যার রেশ ধরে যে ৪২ জন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মামলা করল, ও তাদের একজন। পুলিশ তাকে আহত অবস্থায় হাসপাতালের বেডে আটকে রেখেছিল। ওর নাম নাজমুল হোসাইন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। যে বিভাগে আমি এক সময় শিক্ষকতা করেছি। নাজমুল কি দোষী? যদি দোষী হয়েই থাকে, তাকে কি হাতকড়া পরিয়ে হাসপাতালের বেডে আটকে রাখতে হবে? হাইকোর্ট এক দৃষ্টি আকর্ষণ নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে আশুলিয়া থানার ওসিকে সশরীরে হাজির হয়ে এর ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওসি এসেছিলেন। ক্ষমাও চেয়েছিলেন। কিন্তু এর রেশ কি থেমে যাবে? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষিত হয়েছে। তাও যে ঘটনা ঘটেছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে। তবে এমনিতেই গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে এ সময়টা বন্ধই থাকত বিশ্ববিদ্যালয়। তবে বন্ধের সময় হলগুলো খোলা থাকে। ছেলেদের একটা অংশ হলে থেকে টিউশনি করে, বিসিএস কিংবা ব্যাংকগুলোতে পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়, কোচিং করে। ওরা এখন সবাই হল ছাড়তে বাধ্য হল।


জাহাঙ্গীরনগরে এর আগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। আগেও ঢাকা-আরিচা রোডে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে ছাত্রী পর্যন্ত মারা গেছে সড়ক দুর্ঘটনায়। কিন্তু কোনো একটি ঘটনায় কোনো একজন বেপরোয়া গাড়ি চালকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে, তা বলা যাবে না। হয়নি। সারা দেশই তো আজ বেপরোয়া গাড়ি চালকদের হাতে জিম্মি!

প্রতিদিন কত মানুষ গাড়ি চাপায় মারা যায়, বিচার হচ্ছে কই! বরং গাড়ি চালকরা ক’দিন আগেও দেখিয়ে দিয়েছিল তারা কী পারে। সারা দেশ তারা অচল করে দিয়েছিল। তাদের পেছনে একটি ‘বড় শক্তি’ আছে। সরকার, বিচার বিভাগ এখানে অসহায়! সুতরাং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন ছাত্রের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু এবং মৃত্যু-পরবর্তী ঘটনায় যে একটা প্রতিক্রিয়া থাকবে, এটিই স্বাভাবিক। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ‘ব্যর্থতা’ ছিল, তারা পরিস্থিতির ‘গভীরতা’কে ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারেননি। উপাচার্যকে যারা পরামর্শ দিয়েছেন, তারা সঠিক পরামর্শ দিয়েছেন বলে মনে হয় না। ছাত্ররা আমাদের সন্তানের মতো। নিশ্চয়ই উপাচার্য ভবন ভাংচুর করা ঠিক হয়নি। এটা অন্যায়। আমি এ অন্যায়কে সমর্থন করতে পারি না। কিন্তু আমি এটা বুঝি ওরা বিক্ষুব্ধ ছিল। উত্তেজিত ছিল। সেটিই কি স্বাভাবিক ছিল না? কিন্তু কেন ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকবে? কেন রাবার বুলেট ছুড়বে? কেন আহত করবে আমার সন্তানতুল্য ছাত্রদের? হ্যাঁ, রাস্তা অবরোধ করে যান চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি করা অন্যায়। ছাত্রদের এটা করাও ঠিক হয়নি। আমি ওদের সেন্টিমেন্টকে ধারণ করি। কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা রাস্তা অবরোধ করা নয়, আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া নয়। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যর্থতা আরও এক জায়গায় আমি দেখি। রাস্তায় ‘স্পিডব্রেকার’ ছিল না। সেই কবে চীনা প্রেসিডেন্টের জন্য তা তুলে নেয়া হয়েছিল। সওজ এরপর আর তা প্রতিস্থাপন করেনি। এখানে সুশাসনের ঘাটতি দেখি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নজরেই আনেননি কেউ! বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টোরিয়াল বডির কি দায়িত্ব ছিল না বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নজরে আনা? প্রয়োজনে তিন গেটে তিনটি ‘স্পিড ব্রেকার’ নির্মাণ করবে বিশ্ববিদ্যালয় নিজ খরচে। ক্ষতি কী? এমনিতেই বিশ্ববিদ্যালয় হাজার হাজার টাকা খরচ করে ‘নানাবিধ’ কাজে। এখন যদি বিশ্ববিদ্যালয় নিজ খরচে তিনটি ‘স্পিড ব্রেকার’ নির্মাণ করত, তাতে এমন কী ক্ষতি হতো? আসলে প্রশ্নটা দায়িত্বহীনতার। প্রশ্নটা সুশাসনের। দায়িত্ববোধের বড় অভাব। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী প্রতিদিন ক্যাম্পাস থেকে ঢাকা ও অন্যত্র যাতায়াত করে। তিনটি গেটের মাঝে মূলত দুটি গেটই তারা বেশি ব্যবহার করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন ছিল।

উপাচার্যের একটি কথায় আমি আহত হয়েছি। তিনি বলেছেন, তিনি ছাত্রদের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলবেন না। কথাটা এভাবেই মিডিয়ায় এসেছে। একজন অভিভাবক এভাবে কথা বলতে পারেন না। তার বাসভবন আক্রান্ত হয়েছে। তিনি অসন্তুষ্ট হতেই পারেন। কিন্তু ‘সন্তানদের’ বিরুদ্ধে মামলা করব কেন? ক’জন ছাত্রছাত্রীকে জেলেও পাঠিয়েছিল পুলিশ ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে। এদের মাঝে কয়েকটি মেয়েও ছিল। এর কি কোনো প্রয়োজন ছিল? ওরা জামিন পেয়েছে। কিন্তু ওদের ‘ব্যক্তি জীবনে’ যে একটা ‘কালি’ লেগে গেল, আমরা কি তা ভেবেছি কখনও? আমরা কি কখনও ভেবেছি ওদের ভবিষ্যৎ জীবনকে আমরা কতটুকু ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ করে দিলাম? ওদের কেউ কেউ আগামীতে বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে, এবং ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন’-এ তারা ‘আটকে’ যেতে পারে, আমরা কি তা ভেবেছি কখনও? ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন’ নিয়ে নানা ‘কাহিনী’ আমরা জানি। আমরা এসব ছেলেদের জীবনকে আরও ‘অনিশ্চিত’ করে দিলাম এই মামলা করার মধ্য দিয়ে। মামলা না করেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ‘প্রশাসনিক ব্যবস্থা’ নিতে পারতেন। আগেও অনেকবার এ ধরনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। এবার নিলেও তেমন ক্ষতি হতো না। মামলা করাটা ঠিক হয়নি। উপাচার্য এর অনুমতি দিয়েছেন। না দিলে মামলা হতো না। এটিও তিনি ঠিক করেননি। ‘অন্যভাবে’ এর সমাধান করতে পারতেন তিনি।

এখন এর সমাধান কী? ১. মামলা প্রত্যাহার করা জরুরি। ধরে নিচ্ছি ছাত্ররা ‘অন্যায়’ করেছে। কিন্তু তারপরও অভিভাবক হিসেবে আমি মামলার অনুমতি দিতে পারি না। উপাচার্য এখন স্ব-উদ্যোগে মামলা প্রত্যাহার করে সিন্ডিকেটে রিপোর্ট করতে পারেন। শুনলাম মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে আইন উপদেষ্টার পরামর্শ নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটি ভালো খবর। ২. শুধু মামলা প্রত্যাহারই নয়। মামলায় যাদের নাম আছে, তারা যাতে ভবিষ্যতে কোনোভাবে ‘পুলিশি হয়রানির’ শিকার না হয়, এ বিষয়টিরও নিষ্পত্তি করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে। প্রয়োজনে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে এর ফয়সালা করতে হবে। ৩. দ্রুত হলগুলো খুলে দিতে হবে। হলে ছাত্রছাত্রীরা থাকে নানাবিধ কারণে। অনেকেরই ঢাকা শহরে থাকার জায়গা নেই। রমজান শুরু হয়েছে। সামনে ঈদ। খুব বেশি ছাত্রছাত্রী হয়তো হলে থাকবে না। অনেকেই ইতিমধ্যে বাড়ি চলে গেছে। আমি অনেক ছাত্রীকে জানি, যাদের কেউ কেউ এখন তাদের ‘প্রাইভেট ছাত্রীদের’ বাসায় থাকছে একরকম অনন্যোপায় হয়ে। ছাত্রী পড়িয়েই ওদের চলে। তাই খুলে দেয়া হোক ছাত্রাবাসগুলো। এই লেখা শেষ করার পর জেনেছি ৮ জনু থেকে হলগুলো খুলে দেয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটিও ভালো খবর। ৪. ছাত্ররা দাবি করেছিল ক্ষতিপূরণ দেয়ার। উপাচার্য তাতে রাজিও হয়েছিলেন। তিনি নিজে টিভিতে এ কথা স্বীকারও করেছিলেন। আমি জানি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো না কোনো ‘ফান্ড’ থাকে। তা থেকে এ টাকা দেয়া সম্ভব। না হলে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্ষতিপূরণের অর্থ জোগাড় করা সম্ভব। ৫. বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি ‘আপদকালীন ফান্ড’ গঠন করতে পারেন, যাতে করে ভবিষ্যতে এ ফান্ড থেকে অর্থ জোগান দেয়া যায়। প্রত্যেক ছাত্র, প্রত্যেক শিক্ষক প্রতি মাসে ‘সীমিত পরিমাণ’ টাকা এ ফান্ডে দান করবেন। প্রতি মাসে ছাত্র সংসদের জন্য টাকা নেয়া হয় (শিক্ষকরাও দেন)। এ টাকা কোথায় যায়, কোন কাজে ব্যয় হয়, তার হিসাব কেউ কোনোদিন নেয় না। কেউ জানেও না। উপাচার্য নিজেও জানেন কিনা জানি না। ওই টাকা এই আপৎকালীন ফান্ডে এখন জমা হতে পারে। এমনকি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এখন অনেকেই উচ্চপদে আছেন। সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাও আছেন। তাদের কাছ থেকে ‘ফান্ড’ জোগাড় করা কঠিন কিছু নয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, এমনকি ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন থেকেও ফান্ড জোগাড় করা সম্ভব। এখন প্রয়োজন শুধু উদ্যোগ নেয়ার। ৬. বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে (মূল গেটগুলোসহ) একাধিক ‘স্পিড ব্রেকার’ নির্মাণ করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় স্ব-উদ্যোগে এ কাজটি করুক। শুধু ‘স্পিড ব্রেকার’ নয়, প্রয়োজনে ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে কথা বলে তিন গেটে তিনজন ট্রাফিক পুলিশের ব্যবস্থা করা হোক। বিকল্প হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নিরাপত্তা শাখা থেকে তিনজনকে তিন গেটে ‘ডিউটির’ ব্যবস্থা করা হোক। মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় চলাকালীন খুব কমই দুর্ঘটনা ঘটে। সুতরাং বিকাল ও রাতের কিছুটা সময় যাতে এখানে দায়িত্ব পালন করার লোক থাকে, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ইতিমধ্যেই স্পিড ব্রেকার নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে শুনলাম। ৭. ‘প্রক্টোরিয়াল বডি’তে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আমার ধারণা এই ‘বডি’ উপাচার্যকে সঠিক তথ্যটি দেয় না। অতীতে ছাত্র ও শিক্ষকদের ক্ষোভ আমি ‘প্রক্টোরিয়াল বডি’, বিশেষ করে প্রক্টরের ওপর দেখেছি। আমার নিজের অভিজ্ঞতাও ভালো নয়। আমি নিজেও প্রক্টরকে প্রায় সময়ই খুঁজে পাই না। ফলে এই ‘বডি’র দায়বদ্ধতা ও পরিবর্তন প্রয়োজন। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়মিতভাবে দলের বাইরে থাকা ভিন্ন মতাবলম্বীদের সঙ্গে যদি মতবিনিময় করেন, তাহলে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ‘চিত্র’ তিনি পাবেন, যা তাকে তার দলের লোকেরা কখনই দেন না। তিনি একটি ‘ক্ষুদ্র গ্রুপ’-এর স্বার্থে কাজ করেন এবং তাদের দ্বারা পরিচালিত হন- এমন অভিযোগ আছে। নিয়মবহির্ভূতভাবে শিক্ষক নিয়োগ, স্বার্থান্বেষী গ্রুপের স্ত্রী-সন্তানদের বিজ্ঞপ্তি ছাড়া চাকরি দেয়া ইত্যাদি অভিযোগ তার বিরুদ্ধে উঠেছে যা পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। এ বিতর্কের মাঝে কেন তিনি যাবেন? তিনি শিক্ষক। এ পরিচয়ই যেন তার কাছে বড় হয়ে থাকে- এই পরামর্শটুকুই তাকে দিতে পারি মাত্র!

একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। এ কমিটি তদন্ত করে কী বের করবে আমি জানি না। কিন্তু অনেককেই আমি অসন্তুষ্ট হতে দেখেছি। তবুও দেখা যাক তদন্ত কমিটি কী করে! দু’জন ছাত্র প্রাণ হারিয়েছে। ৪২ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে খোদ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মামলা করেছে- এটা দুঃখজনক, অনাকাক্সিক্ষত। এ দুই ছাত্রই ছিল পরিবারের ভরসা। আশার জায়গা। সেই ‘আশা’ কীভাবে পূরণ হবে আমি জানি না। ‘ক্ষতিপূরণ’ দিলেও সেই দুটি পরিবারে ‘শান্তি’ ফিরে আসবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। উপাচার্য তাদের অভিভাবক। ওই দুই পরিবারের ‘ক্ষতি’ তিনি কিছুটা হলেও কমাতে পারবেন যদি তিনি নিজে ওই দুই পরিবারের কাছে যান। সন্তান হারানোর ব্যথা তিনি নিজেও বুঝবেন। ছাত্ররা অভিযোগ করেছে কিন্তু শিক্ষকের বিরুদ্ধে। ছাত্ররা নাকি শিক্ষকদের গালাগালিও করেছে। উপাচার্য নিজে অভিযোগ করেছেন ছাত্ররা শিক্ষকদের দিকে কাঁঠালের অব্যবহৃত অংশ ছুড়ে মেরেছে। এটা নিঃসন্দেহে অন্যায়। ছাত্রদের এটা করা ঠিক হয়নি। উপাচার্য একটি প্রতিষ্ঠান। তার বাড়ি ভাংচুর করার অর্থ একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর আঘাত করা। এটা কি ছাত্রদের ‘ছাত্রসুলভ’ কাজ হয়েছে? যে প্রতিষ্ঠান থেকে তারা সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেবে, সেই প্রতিষ্ঠানকে আঘাত করা, তার ভাবমূর্তি নষ্ট করা অন্যায়। মহা-অন্যায়। উপাচার্য এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি হলেও তিনি যখন উপাচার্যের দায়িত্ব নেন, তখন তিনি নিজেও একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে যান। আমি আশা করব আন্দোলনকারী ছাত্ররা এজন্য উপাচার্যের কাছে ক্ষমা চাইবে। তারা উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে, অথবা সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষমা চাইতে পারে। আমি এতে কোনো সমস্যা দেখি না। আর একটা কথা। কিছু হলেই উপাচার্য ভবন ভাংচুর হয়। ঘেরাও হয়। আমরা ভুলে যাই উপাচার্যেরও পরিবার আছে। তার পরিবারের সদস্যদের ‘মানসিকভাবে বিপর্যস্ত’ করা আমাদের কারোরই কাম্য নয়। আমি চাই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসুক। পরপর দুটি মৃত্যু তার বন্ধুদের আহত করেছে। বিক্ষুব্ধ করেছে। আমি তাদের সঙ্গে সমব্যাথী। সুযোগ থাকলে আমি ওদের ‘শিক্ষক’ হিসেবে পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু যেতে পারিনি। তবে আমাদের বোধহয় চিন্তা করা প্রয়োজন- আমরা প্রতিবাদী হব, কিন্তু তা যেন হয় নিয়মতান্ত্রিক। পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়ল। আহতদের ছবি সামাজিক গণমাধ্যমে আছে। পুলিশ কি আরও একটু সংযত হতে পারত না? সাভারে নিয়োজিত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তো আমার ছাত্র। এ জাহাঙ্গীরনগরই তাকে ডিগ্রি দিয়েছে। তিনি কি আরও একটু সংযত হতে পারতেন না? অন্তত রাবার বুলেট না ছুড়ে, ছাত্রদের লাঠিচার্জ না করে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করেও তো ‘বিক্ষুব্ধ’ ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করা যেত।

নাজমুলের হাতকড়া পরা অবস্থায় তার করুণ কাহিনী আমাকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে ‘বিচারের কাঠগড়ায়’ দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমাকে ‘দোষী’ করেছে নাজমুল! আদালত এটা বিবেচনায় নিয়েছেন। এ জন্য উচ্চ আদালতের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমি খুশি হতাম যদি উপাচার্য হাসপাতালে যেতেন ও নাজমুলের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। আমি উপাচার্য হলে তাই করতাম। ওর বাবা যখন ওকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে রেখে যায়, ওই আমাদের সন্তান! এই ‘সন্তানদের’ দেখার দায়িত্ব আমাদের সব শিক্ষকদের। দুঃখজনক হলেও সত্য, এটা আমরা ভুলে যাই। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার বয়স তো নাজমুলদেরই! জাহাঙ্গীরনগরে যে ঘটনা ঘটেছিল, আমরা সবাই মিলে তা ভুলে যেতে চাই। এ বিশ্ববিদ্যালয়টি আমাদের সবার। নাজমুলরা একদিন থাকবে না। আমি থাকব না। নতুন একজন উপাচার্য আসবেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টি থাকবে হাজার বছর। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভালো’ আমাদের সবার জন্য ‘ভালো’।

ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

tsrahmanbd@yahoo.com

http://www.jugantor.com/sub-editorial/2017/06/05/130062