৪ জুন ২০১৭, রবিবার, ১০:৩৪

বাজেট আসে যায় জনগণ কি পায়?

বাজেট আসে বাজেট যায়। কিন্তু সাধারণ মানুষের শূন্যতা কমে না। বড় বাজেট আর ব্যয় বৃদ্ধিতে বাহাদুরি মনে করছে সরকার। লাখ লাখ টাকার বাজেট থেকে সাধারণ জনগণ কি পাচ্ছে? টেকসই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, উন্নত যোগাযোগ অবকাঠামো, মানসম্পন্ন শিক্ষা, স্বল্পমূল্যে স্বাস্থ্যসেবা, উন্নত কর্মসংস্থানের বাজারের নামে প্রতি বছরই বাজেট বড় হচ্ছে। শব্দের ঝঙ্কারে নতুন দলিল প্রকাশ পেলেও স্বপ্নের পূর্ণতা আসে না। জনজীবনে উল্টো চাপ বাড়ে। প্রশ্ন একটাই গন্তব্যহীন বাজেটে জনগণ কি পাবে।

২০১৫ সাল থেকে জাতি নিরবচ্ছিন্নভাবে ভাগ্যোন্নয়নের মহাযজ্ঞে লিপ্ত রয়েছে। সরকার তার লক্ষ্যে পৌঁছতে উচ্চবিলাসী এই বাজেট দিয়েছেন। তবে চূড়ান্ত লক্ষ্য কী বা কোথায়, তা ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় পরিষ্কার করেননি অর্থমন্ত্রী।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে ২৬ দশমিক ২০ শতাংশ বড় বা ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, যেতে হবে অনেক দূর। কিন্তু সক্ষমতা না বাড়িয়েই ২৬ শতাংশ বড় বাজেট কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, তার কোনো নির্দেশনা দেননি অর্থমন্ত্রী। আবার এ বাজেট বাস্তবায়নে গত অর্থবছরের চেয়ে ৩১ শতাংশ অধিক কর কীভাবে আহরিত হবে, তাও পরিষ্কার নয়।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বড় বাজেট দিতে পছন্দ করেন। কিন্তু তার এই পছন্দে জনগণের জান শেষ। তিনি কিসের ভিত্তিতে এত বড় বাজেট দিলেন তা বুঝা খুবই কঠিন। এরই ধারাবাহিকতায় এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি ধরে বাজেট প্রস্তাব প্রণয়ন করেছেন এবার। ফলে আগামী অর্থবছরে বাজেটে ঘাটতি দাঁড়াচ্ছে মোট বাজেটের ২৮ শতাংশ। ২৬ শতাংশ ব্যয় বাড়ানোর বাহাদুরির কারণেই অতিরিক্ত ঋণের ঝুঁকি নিতে হচ্ছে তাকে।
দেশী-বিদেশী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণ করে এবং ভ্যাটের নামে জনগণের পকেট কেটে তিনি তার সখ বাস্তবায়ন করছেন। আর এ সুযোগের তার দলীয় লোকদের ভাগ্য পরিবর্তন হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে এত বড় বাজেটে সাধারণ জনগণ কি পাচ্ছে। তাদের ভাগ্যের কি পরিবর্তন হচ্ছে।
এদিকে করপোরেট কর কমানো হবে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি পাবে বাড়তি ছাড়, জনগণকে কিছুটা স্বস্তি দিতে বাড়ানো হবে করমুক্ত আয়ের সীমা, ভ্যাট হার কিছুটা কমবে না-হয় স্তর হবে কয়েকটি গত দুই মাসে এমন অনেক আশ্বাস দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু আশ্বাসের আতিশয্য থাকলেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। বরং পুরোনো পথেই হেঁটেছেন অর্থমন্ত্রী। আরোপ করেছেন ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট। আবার করপোরেট কর বা আয়কর কোনোটিই ছাড় দেওয়া হয়নি।
সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অস্বস্তির বিষয়গুলো অর্থমন্ত্রী তার বজেটে এড়িয়ে গেছেন সযতেœ। চালের বাজারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা, রেমিট্যান্স প্রবাহে নিম্নমুখী প্রবণতা, হাওরে ফসল নষ্ট, খাদ্য ঘাটতি কাটিয়ে ওঠাসহ নানা বিষয়ে কোনো মন্তব্য তিনি করেননি। এমনকি ব্যবসায়ীদের ভ্যাট বিরোধিতা চরমে উঠলে, তা মানা হয়নি।
সংস্কার ও সুশাসন নিয়ে অনেক কথা বললেও অর্থমন্ত্রী গোপন করেছেন অনেক বিষয়। আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অব্যবস্থাপনার বিষয় তার বক্তব্যে উঠে আসেনি। ব্যাংকগুলোয় মূলধন দুই হাজার কোটি জোগান দেওয়া হলেও এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। বরং সংখ্যার মধ্যে আবদ্ধ থেকেছেন অর্থমন্ত্রী।
ব্যাংকের লুটপাটের সাথে যারা জড়িত তাদের বিচার না করে উল্টো তাদের জন্য মূলধন বরাদ্দ দেয়া হলো। অথচ খেটে কাওয়া আর দিন মুজরের ঘামের টাকায় এ বাজেট তৈরি হয়েছে। তাদের টাকা নিয়ে এসব চিহ্নিত চোর আর লুটেরাদের পুনর্বাসন করার নাম কি বাজেট। বাজেটে ৪ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও জনগণ কিছুই পায় না। সাধারণ জনগণ বছর শেষে শুধু শুনতে পায় দেশের জিডিপি বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি কমেছে। মাথা পিছু আয় বেড়েছে। কিন্তু তার কোন সুফল সে পায় না। মেয়ে বিয়ে দিতে গেলে কিংবা ছেলে বিশ^ বিদ্যালয়ের ভর্তি করাতে গেলে তিনি বুঝতে পারেন কি সুফল পেয়েছেন তিনি। জমি কিংবা গরু বিক্রি করে এসব করতে গেলেও তাকে ভ্যাট দিতে হচ্ছে। তাহলে এই বাজেট দিয়ে তার কি লাভ হবে। এমন সব প্রশ্নের কোন জবাব খুজে পায় না সাধারণ মানুষ। অথচ সখ করে অর্থমন্ত্রী বাজেটের আকার বাড়াচ্ছেন। কিন্তু এসব মানুষের কথা কি তিনি এক বারও চিন্তা করেছেন।
আগামী অর্থবছরের জন্য প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ৪০ প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। তা অর্জনের উপায় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ভোগ ও বিনিয়োগ ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাবে অভ্যন্তরীণ ধারণক্ষমতা আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বাড়বে। ফলে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে সামান্য ঘাটতি সৃষ্টি হবে। তবে মূলধন ও আর্থিক হিসাবে পর্যাপ্ত উদ্বৃত্ত থাকায় সার্বিক লেনদেন ভারসাম্য উদ্বৃত্ত থাকবে। সব মিলিয়ে প্রস্তাবিত বাজেট কাঠামো, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাসহ টেকসই উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় সম্পদ সঞ্চালন সক্ষম হবে।
বিশাল রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রার পরও বাজেটে রয়ে গেছে বড় অঙ্কের ঘাটতি। আগামী অর্থবছর ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ ধরা হয়েছে এক লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা, চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে যা ধরা হয়েছে ৯৮ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। রাজস্ব লক্ষ্য অর্জন না হলে পরবর্তী সময়ে ঘাটতি আরও বাড়বে। ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। আর অভ্যন্তরীণ ঋণ ৬০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণের লক্ষ্য প্রায় ২৮ হাজার ২০৩ কোটি টাকা ধরা হয়েছে।
চলতি অর্থবছর এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ছিল ২ লাখ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। যদিও তা কমিয়ে ১ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। কিন্তু মার্চ পর্যন্ত ১ লাখ ২৬ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। বাকি সময়ে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে চলতি অর্থবছর ঘাটতিতে পড়তে পারে এনবিআর। তার পরও নতুন অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এ অর্থ আদায়ে ভ্যাটের চাপ বাড়ছে, যা মূলত সাধারণ মানুষের ওপরও পড়বে।
২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে বড় ধরনের উল্লম্ফন দেখা যায়। পরের দুই বছরও এ ধারা অব্যাহত থাকে। এরপর বেসরকারি খাত ক্রমেই উৎসাহ হারাচ্ছে। ২০০৯-১০ বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ২৪ শতাংশ। পরের বছর তা দাঁড়ায় ২৬ শতাংশে। তবে চলতি অর্থবছর মার্চ শেষে ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক শূন্য আট শতাংশ, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম। এছাড়া সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ায় মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমেছে।
এদিকে ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর অর্থনীতি যে শক্তি অর্জন করে, তা ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে অর্থনীতির প্রতিটি সূচক ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। কৃষিতে ক্রমাগত প্রবৃদ্ধি কমছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৯-১০ অর্থবছরে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ হলেও চলতি অর্থবছর তা সাড়ে ৩ শতাংশের কাছাকাছি চলে এসেছে। আর শিল্প খাত প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে গেছে এ বছর।
সড়ক অবকাঠামো ও বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হলেও এগুলোর অবস্থা এখনো দূরস্ত। ঢাকার যানজট নিরসনে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ শুরু করা হলেও কবে তা শেষ হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। পদ্মা সেতুর নির্মাণও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে আছে। আর পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ শুরুই হয়নি। অন্যান্য বড় প্রকল্পের গতিও একই রকম।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) নিয়ে নানা কথা বলা হলেও বাস্তবে তার কোনো অগ্রগতি নেই। এখনো একটি প্রকল্পও পিপিপিতে বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। এরপরও পিপিপিতে ৪২টি প্রকল্প রাখা হয়েছে। নিয়মিতই রাখা হয়েছে বরাদ্দও।
আবার বিদ্যুৎ খাতে প্রচুর বিনিয়োগ করেও সাফল্য পাচ্ছে না সরকার। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল দিয়ে সাময়িক সাফল্য পাওয়া গেলেও এখন আর বিদ্যুৎ খাতে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা যাচ্ছে না। বিদ্যুতের সরকারি বড় কোনো কেন্দ্র সময়মতো উৎপাদনে আসছে না। ২০টি কেন্দ্রের সময়সীমা পেছানো হয়েছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কোনো অগ্রগতি নেই। যদিও সরকার বড় ১০ প্রকল্পের জন্য পৃথক বাজেট পেশ করেছে এ বছর। এরপরও বড় ১০ প্রকল্পের জন্য পৃথক বাজেট দেওয়া হয়েছে এ বছর।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে বড় অঙ্কের বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। আগামী অর্থবছর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। আর পদ্মা রেল লিংকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার বেশি। যদিও চলতি অর্থবছর দুই প্রকল্পেই বরাদ্দের বড় অংশ অব্যবহৃত থেকে যায়।
বড় অঙ্কের উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা না থাকলেও আগামী অর্থবছরে ১ লাখ ৫৯ হাজার ১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর বর্তমান সক্ষমতায় সর্বোচ্চ এক লাখ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নও সম্ভব নয়। চলতি অর্থবছর সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা হলেও এপ্রিল পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র সাড়ে ৫৪ শতাংশ। অর্থাৎ বাকি সময়ে ৪৮ শতাংশও বাস্তবায়ন সম্ভব কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
চলতি অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম পাওয়া গেছে বৈদেশিক ঋণ। আবার যা পাওয়া যাচ্ছে, তা ব্যয় করতে না পারায় পাইপলাইনে আটকে আছে। এ অবস্থায় বৈদেশিক অর্থায়নে চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৩০ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। পরে তা কমিয়ে ২৪ হাজার ৭৭ কোটি টাকা করা হয়। এরপরও আগামী অর্থবছর বৈদেশিক ঋণ ৪৬ হাজার ৪২০ কোটি টাকা ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

http://www.dailysangram.com/post/286599-