৪ জুন ২০১৭, রবিবার, ১০:১৯

আতঙ্কের নাম ভ্যাট

প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ ভাগ অভিন্ন ভ্যাট কার্যকরের প্রস্তাবে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে সাধারণ মানুষের মাঝে। পণ্য ও সেবাপণ্যে ১৫ ভাগ 

হারে ভ্যাট দিতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হবে অনেককে। আগে সেবা ও পণ্যভেদে ভ্যাটের হার ভিন্ন থাকলেও এখন এটি সব ক্ষেত্রে সমান হচ্ছে। এতদিন বিদ্যুৎ গ্রাহকরা ৫ ভাগ হারে ভ্যাট দিতেন। এখন সেখানে ১৫ ভাগ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য হলে মাসে পাঁচশ’ টাকার বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী ব্যক্তি অতিরিক্ত ৫০ টাকা দিতে হবে বাড়তি ভ্যাট হিসেবে। একইভাবে পণ্য ও সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রেও বাড়তি এই কর দিতে হবে ক্রেতাদের। প্রস্তাবিত বাজেটে অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রচলিত পণ্যে লম্বা তালিকা দিয়ে ভ্যাট অব্যাহতির কথা বলা হলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর একই হারে ভ্যাট আরোপ এক ধরনের চালাকি বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বাড়তি ভ্যাটের এই জালে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষ পিষ্ট হবে বলে মত তাদের। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যে সহজ উপায়ে জনসাধারণের ওপর ভ্যাটের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তাতেও সরকারের লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে না। কারণ এই ধরনের ফ্ল্যাট ভ্যাট আদায়ের কৌশল নির্ধারণ ও প্রশিক্ষণ এবং ব্যবসায়ীদের উদ্বুদ্ধকরণের কোনো কর্মসূচি আগে নেয়া হয়নি। অতীতে ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে যে দুর্বল দিক চিহ্নিত হয়েছে তা শোধরানোরও জোরালো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি সরকারের তরফে।
এদিকে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, বিদ্যমান ১৯৯১ সালের আইনে মাত্র ৫৩৬টি পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি ছিল। নতুন আইন কার্যকর করতে গিয়ে ওই সংখ্যা বাড়িয়ে এক হাজার ৪৩ করা হয়েছে। চাল, ডাল, মুড়ি, চিঁড়া, চিনি ও আখের গুড়, মাছ, মাংস, শাক-সবজি, তরল দুধ, প্রাকৃতিক মধু, বার্লি, ভুট্টা, গম ও ভুট্টার তৈরি সুজি, লবণসহ ৫৪৯টি পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতির প্রস্তাব করেছেন তিনি। তবে প্রতিটি সবজিকে এখানে একেকটি পণ্য হিসেবে ধরা হয়েছে। ৯৩ ধরনের জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, গণপরিবহন সেবা, জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। কৃষি, গবাদিপশু ও মৎস্য চাষ খাতের প্রায় ৪০৪টি ক্ষেত্রকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। একেকটি কীটনাশক, আগাছানাশক ও ছত্রাকনাশককে একেকটি পণ্য হিসেবে ধরে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া পণ্যের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে খুবই কম সংখ্যায়। অন্যদিকে যেসব পণ্যের ভ্যাট অব্যাহতির তালিকা দেয়া হয়েছে তার মধ্যে একেবারে অপ্রয়োজনীয় এবং হাস্যকর পণ্যের নামও রাখা হয়েছে। চর্বিমুক্ত শূকরের মাংস রয়েছে ভ্যাট অব্যাহতি পাওয়া পণ্যের তালিকায়। বাজেটে প্রস্তাবিত ভ্যাটের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজস্ব আয় বাড়াতে সহজ উপায়ে ভ্যাট চাপানো হয়েছে। এটা এত সহজে কি বাস্তবায়ন করা যাবে? সব ব্যবসাকে তো সহজেই স্বয়ংক্রিয় বা অটোমেটেড করা যাবে না। সংস্কার না করে ভ্যাট চাপিয়ে দেয়াটাও ঠিক হয়নি। শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা সব বোঝা চাপিয়ে দেবে ভোক্তার ওপর। এতে সরকারের আয় বাড়বে হয়তো, কিন্তু পুরোটাই যাবে সাধারণ ভোক্তার পকেট থেকে। ১৯৯১ থেকেও তো ভ্যাট আছে, এবার জোর করে পুরোটাই চাপানো ঠিক হয়নি। এভাবে পরোক্ষ কর না বাড়িয়ে করজাল বাড়াতে পারতো সরকার। বাজেটে কর, ভ্যাট আর্থিক নীতির ফলে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করছে সিপিডি। বাজেট পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, যেসব খাত থেকে দ্রুত রাজস্ব তোলা যায়, এমন খাত বেছে সেগুলোর কর বাড়ানো হয়েছে। যেমন ব্যাংকে টাকা রাখায় বা বিমানের টিকিট কেনায় কর বাড়ানো হয়েছে। যারা কর না দিয়ে বিদেশে টাকা নিয়ে যায়, তাদের ব্যাপারে নীতিগত কোনো কার্যকর অবস্থান না নিয়ে সৎ করদাতাদের ওপর আরো করের বোঝা চাপানো নৈতিকভাবে ঠিক না। করের চাপটা মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের ওপর বেশি আসবে। তিনি বলেন, চালের দাম বৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের দাম না কমানো, সবকিছু মিলিয়ে আগামী বছর মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা রয়ে গেল।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=68343&cat=2/-