৪ জুন ২০১৭, রবিবার, ১০:১৪

ব্যাংক গ্রাহকরা শাঁখের করাতে

ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেন মো. ফায়েকুজ্জামান। সম্প্রতি উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া গ্রামের একখণ্ড জমি বিক্রি করে তিন লাখ পাঁচ হাজার টাকা পান তিনি। এর থেকে বিভিন্ন খরচ বাদে দুই লাখ ৯০ হাজার টাকা জমা করেন মাগুরায় কৃষি ব্যাংকের মহম্মদপুর শাখায় নিজের সঞ্চয়ী হিসাবে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী, ব্যাংকে রাখা এই টাকার ওপর এক্সাইজ ডিউটি বা আবগারি শুল্ক দিতে হবে ৮০০ টাকা। বর্তমানে এই শুল্কের পরিমাণ ৫০০ টাকা। অনার্স পাস করে চাকরি খুঁজছেন ফারুক আহমেদ। বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর পেনশনের সাত লাখ টাকা তুলে ঢাকার একটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখায় নিজের সঞ্চয়ী হিসাবে জমা করেন ফারুক। সেই টাকা তুলে সম্প্রতি একটি মেয়াদি আমানত হিসাবে রাখেন সামান্য কিছু সুদ পাওয়ার আশায়। এই দুটি হিসাবের জন্য সরকারকে তাঁর দিয়ে দিতে হবে এক হাজার ৬০০ টাকা। এটাকে ‘শাঁখের করাত’ আখ্যা দিয়ে ফারুক বলেন, ‘টাকা জমা করলেও বিপদ, তুললেও বিপদ। জমা করলে সরকার কাটবে, তুলে নিলে চুরি-ডাকাতির ভয়, আবার খরচের প্রবণতাও আছে। এখন আমরা কোথায় যাব?’

জানা গেছে, দেশের ব্যাংকগুলোতে সঞ্চয়ী হিসাবে আমানতের ওপর সুদের হার ৩ থেকে ৩.৫ শতাংশ। মেয়াদি আমানতের সুদহার ব্যাংক ভেদে ৫ থেকে ৭ শতাংশ। এর ওপর উেস কর দিতে হয় ১৫ শতাংশ, হিসাব পরিচালনার জন্য বার্ষিক সার্ভিস চার্জ ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, এটিএম সেবার জন্য আলাদা ফি তো রয়েছেই। এ ছাড়া রয়েছে নানা ধরনের সার্ভিস চার্জ। এর ওপর যোগ হচ্ছে অতিরিক্ত আবগারি শুল্ক।
গত দুই দিনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিরাপদে টাকা রাখতে মানুষ ব্যাংকের শরণাপন্ন হয়। কিন্তু এর জন্য দিন দিন খরচ বাড়লে ব্যাংকে টাকা না রেখে তারা এখন আবার সেই পুরনো পদ্ধতি অর্থাৎ মাটির ব্যাংক বা বাঁশের মধ্যে টাকা জমাতে চেষ্টা করবে। এতে দেশে চুরি-ডাকাতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘একদিকে আমানতের ওপর সুদ কমছে, অন্যদিকে আমানতের ওপর কর বাড়ছে। এতে গ্রাহকরা দুইদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। ফলে আর্থিক খাতে ছায়া অর্থনীতির (অপ্রদশির্ত অর্থ) আকার বাড়বে। ’
এদিকে মূল্যস্ফীতির তুলনায় ব্যাংকের আমানতের ওপর গড় সুদহার নিচে নেমে যাওয়ায় প্রকৃত মুনাফা কমে যাচ্ছে। বর্তমানে ব্যাংক খাতে আমানতের গড় সুদহার ৪.৯৭ শতাংশ। অন্যদিকে গত এপ্রিল পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের ওপরে ছিল। এ অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে এক বছর ব্যাংকে জমানো টাকা (সুদসহ) দিয়ে এক বছর আগে যে পরিমাণ পণ্য কেনা যেত পরের বছর ওই পরিমাণ পণ্য কেনা যাবে না। কারণ জিনিসপত্রের দাম বেশি বেড়ে যাবে ব্যাংক থেকে পাওয়া সুদের তুলনায়। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকে টাকা জমা বা তোলার ওপর আবগারি শুল্ক প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছেন ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান এবং মিউচুয়্যাল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আনিস এ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ব্যাংক আমানতের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক দেশের নাগরিকদের প্রকৃত সঞ্চয় খেয়ে ফেলবে। আমরা মনে করি, এই শুল্ক সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর পরিবর্তে উল্টো কমিয়ে আনবে। দেশের সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের অভ্যাস ধ্বংস করে দেবে। পৃথিবীর কোনো দেশেই আমানতের ওপর এমন শুল্ক বা করের কথা আমরা শুনিনি। এটা প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করছি। ’
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত ১ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। তাতে ব্যাংকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত জমা বা উত্তোলনের ওপর কোনো ধরনের আবগারি শুল্ক আরোপের কথা না বললেও এক লাখ টাকার ওপরে জমা বা উত্তোলনের ওপর কয়েক ধাপে আবগারি শুল্ক বাড়ানোর কথা উল্লেখ আছে।
প্রস্তাব অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরে কোনো ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবে এক লাখ এক থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত যেকোনো অঙ্কের টাকা জমা বা তোলা হলে বছর শেষে ওই হিসাব থেকে আবগারি শুল্ক বাবদ ৮০০ টাকা কাটা হবে। বর্তমানে কাটা হচ্ছে ৫০০ টাকা করে। এ ছাড়া ১০ লাখ এক থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেনের ওপর দুই হাজার ৫০০ টাকা আবগারি শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। বর্তমানে একই অঙ্কের ওপর এক হাজার ৫০০ টাকা নিচ্ছে সরকার। আগামী অর্থবছরে এক কোটি এক টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেনের ওপর সাত হাজার ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে পাঁচ কোটি এক টাকা থেকে এর ওপরে যেকোনো অঙ্কের লেনদেনে ২৫ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে একই অঙ্কের লেনদেনে আবগারি শুল্ক বাবদ দিতে হচ্ছে ১৫ হাজার টাকা।
প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বর ব্যাংক হিসাবধারীদের হিসাবে জমা টাকা থেকে এই শুল্ক কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয় ব্যাংকগুলো। কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টধারী সারা বছরে যদি একবারও এক লাখ টাকার ওপরে লেনদেন না করে ৩০ ডিসেম্বর একবারের জন্য এমন অঙ্কের লেনদেন করেন তাহলেও নির্ধারিত হারে আবগারি শুল্ক দিতে হবে। আগামী ১ জুলাই শুরু হওয়া নতুন অর্থবছর থেকে এই আবগারি শুল্ক হার আরোপ করার প্রস্তাব নিয়ে পত্রপত্রিকা, টিভি টক শো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে বিভিন্ন স্তরের মানুষ।
গত শুক্রবার বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বলেছেন ‘এক লাখ টাকার মালিক সম্পদশালী। ’ অর্থমন্ত্রীর এমন মন্তব্যের পর এ নিয়ে আরো বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। গতকাল শনিবার বিকেল ৫টায় শেখ সুলভ নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ফেসবুকে নিজের ওয়ালে লিখেছেন, ‘মাননীয় অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা মতে কিছুদিনের মধ্যেই আমি সম্পদশালী হতে যাচ্ছি। ’ সকালে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচারিত এক অনুষ্ঠানে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সাবেক সভাপতি সুলতান মাহমুদ বাদল বলেন, ‘সাধারণত বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা একটু বেশি করে টাকা পাঠান ঈদে খরচ করার জন্য কিংবা বাড়িতে ঘর তোলার জন্য। বিদেশ থেকে পাঠানো এই অর্থ বা রেমিট্যান্স স্বজনরা যখন তাঁদের ব্যাংক হিসাবে রাখবেন বা তুলবেন তখন তাঁদের ওপর এই শুল্ক আরোপ করা হবে। এটা কিন্তু প্রকারান্তরে রেমিট্যান্সকে নিরুৎসাহিত করা হলো। অথচ অর্থমন্ত্রী কিন্তু সব সময় রেমিট্যান্স বাড়ানোর কথা বলে আসছেন। ’
বাদল আরো বলেন, ‘এভাবে খরচ বাড়তে থাকলে লোকজন আর ব্যাংকে টাকা রাখবে না। সেই পুরনো পদ্ধতি অর্থাৎ মাটির ব্যাংক বা বাঁশ কেটে তার মধ্যে টাকা জমাতে চেষ্টা করবে। এতে দেশে চুরি-ডাকাতি বেড়ে যাবে। ’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/06/04/504803