৪ জুন ২০১৭, রবিবার, ১০:০৫

ইলেকশন বাজেট : বিশাল ঘাটতির অবাস্তব প্রস্তাব

বহুদিন ধরে একটি ধারণা ছিল যে বাজেট এলেই বুঝি দাম বাড়ে। এমন একটি ধারণা আমারও বহুদিন ধরে ছিল। আমি অর্থনীতির ছাত্র। তাই আমার ভেতর এরকম একটি ধারণা সৃষ্টি হলে সেটি অমূলক হয় না। কারণ বাজেট এমন একটি বিষয় যেটি পরিবারের মতোই রাষ্ট্রের সারা বছরের আয় ব্যায়ের হিসাব নিকাশের বিবরণ। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বাজেট নাজাইহারি থেকেই যায়। এই নাজাইহারিকে আমরা অর্থনীতির পরিভাষায় ডেফিসিট বা ঘাটতি বলে থাকি। এই ডেফিসিট পূরণ করার দুই তিন রকমের পথ আছে। সবচেয়ে সোজা রাস্তা হলো নতুন পদের ট্যাক্স বা কর বসানো। আরেকটি হলো শুল্ক বসানো। এই শুল্কও কয়েক ধরণের হতে পারে। এ ছাড়াও আছে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে ঋণ, জনগণের নিকট থেকে ঋণ অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র প্রভৃতি ইনস্ট্রুমেন্ট থেকে ঋণ, প্রতিরক্ষা সঞ্চয় পত্র, ফিক্সড ডিপোজিট বা স্থায়ী আমানত থেকে ঋণ ইত্যাদি। এ ছাড়াও আছে বিদেশী ঋণ। এই বিদেশী ঋণের মধ্যে আছে দ্বিপাক্ষিক ঋণ দাতা সংস্থার নিকট থেকে ঋণ প্রভৃতি। বাজেটের আলোচনা এলেই এইসব টেকনিক্যাল পরিভাষা এসে যায়। কিন্তু আমরা বিষয়টি সাধারণ মানুষের জন্য লিখছি বলে আজ আমরা যতদূর সম্ভব টেকনিক্যাল ভাষা পরিহার করবো।
আমরা শুরু করেছিলাম জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে। বাজেট দুয়ারে করাঘাত করলেই শুধু মূল্য বৃদ্ধি হয়, বাজেট দুয়ারের কাছে না এলে কি মূল্য বৃদ্ধি পায় না? আসুন, কয়েকটি নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে আলোচনা করি। গরুর গোশ্ত একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। বর্তমানে গরুর গোশ্ত ৫২০ টাকা কেজি। বলুনতো, ৬ মাস আগে কত ছিল? তখন ছিল ৪৫০ টাকা কেজি। এটি বিগত নবেম্বরের ঘটনা। আপনারাই বলুন, ৮ মাস আগের ব্যাপার। তখন কি বাজেটের কোন ব্যাপার স্যাপার ছিল? কোন কিছুই ছিল না। কসাইদের কথাই বলুন আর গরু ব্যবসায়ীদের কথাই বলুন, বাজেটের জন্য কেউ বসে থাকে না। সময় সুযোগকে মোক্ষম মনে করলেই তারা দাম বাড়িয়ে দেয়। বাজেট এখানে বড় ফ্যাক্টর নয়, বরং রোজা রমজান তাদের কাছে দাম বাড়ানোর মোক্ষম সুযোগ।
কথায় বলে দুর্জনের ছলনার অভাব হয় না। অনেকদিন আগে কলকাতার একটি বাংলা ছবি দেখেছিলাম। যতদূর মনে পড়ে, ছবিটির নাম ‘সাগরিকা’। ছবির একটি ডায়ালগ, ‘ভায়া, নিজের চরকায় তেল দাও’। যাকে পরামর্শটি দেয়া হলো, সে বলছে, ‘চরকায় তেল দেয়া যার অভ্যাস সে নিজের চরকা পরের চরকা খুঁজে বেড়ায় না। চরকা পেলেই তেল দেয়া শুরু করে।’ দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। চান্স পেলেই হলো। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেয়।
আপনারাই বলুন, তেলের দাম বৃদ্ধির সাথে রিক্সা ভাড়া বৃদ্ধির কি কোন সম্পর্ক থাকতে পারে? ওরা সম্পর্ক ঠিক ঠিক আবিষ্কার করে বসে। কলাবাগান থেকে ল্যাব এইড রিক্সা ভাড়া ছিল ১০ টাকা। হঠাৎ করে একদিন ওরা হাঁকলো ২০ টাকা। রিক্সাওয়ালাকে প্রশ্ন, “ভাই ভাড়া কেন বাড়ালেন।” দন্ত বিকশিত করে রিক্সাওয়ালার জবাব, “কি করবো বলেন, তেলের দাম যে বেড়ে গেছে”। তেলের দাম বাড়ার সাথে আপনার রিক্সাভাড়া বাড়ার কি সম্পর্ক? আপনার রিক্সা কি তেল দিয়ে চলে? রিক্সাওয়ালা বত্রিশটি দাঁত বের করে হি হি করে হাসে।
বাজেট নাই, রোজা রমজানও নাই, হঠাৎ দেখা গেলো শাক সব্জির দাম বেড়ে গেছে। কি ব্যাপার? কারণ হলো, বৃষ্টি বেশি হওয়ায় শাক সব্জি বোঝাই ট্রাক আসতে দেরি হচ্ছে। আবার ওরাই বলছে যে এখন বৃষ্টি কমে গেছে আগামীকাল থেকে আবার দাম স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কিন্তু ঘটনা ঘটে যায় সেই নজরুল সঙ্গীতের মতো। শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলো না। তেমনি বৃষ্টি কমে যায়। ঘটঘটে রোদ ওঠে, কিন্তু জিনিস পত্রের দাম ঐ যে বেড়ে যায় সেটি আর কমেনা। বরং এই সুযোগে আরো ২/৪টি পণ্যের দাম লাফ দিয়ে বাড়ে।
॥দুই॥
এখন একটি ভারী বিষয়ের আলোচনায় যাচ্ছি। ছাত্র জীবন থেকেই শুনে আসছি যে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেশি বলে আমদানিকৃত সব পণ্যের দামই বেশি। অনেকদিন ধরেই তেলের দাম কমেনা। বাংলাদেশে তো কোনো কথাই নাই। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেশি বলে সবগুলো আমদানিকৃত পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। সোনা রূপার তো কথাই নাই। ওগুলোর দাম হাইজাম্প লংজাম্প দিয়ে বাড়ে। এর মধ্যে বছর তিনেক আগে একটি ঘটনা ঘটলো। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমতে কমতে ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার কমে গেল। কোন কোন ক্ষেত্রে ১৩০ ডলার কমে যায়। বাংলাদেশের সব শ্রেণীর ব্যবসায়ী ও ভোক্তা বিরাট আশায় বুক বাঁধেন যে এবার হয়তো শুধুই তেলের দাম নয়, সব ধরনের আমদানি পণ্যের দাম অর্ধেকেরও বেশি কমে যাবে। কিন্তু এক বছর সময় পার হয়ে গেল। দেখা গেল তেলের দাম বা অন্যান্য আমদানি পণ্যের দাম এক পাইও কমলো না। ব্যবসায়ী এবং ভোক্তাদের তো মাথায় হাত। তখন একটি সাংবাদিক সম্মেলনে বিষয়টি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের কাছে উত্থাপন করা হয়। সাংবাদিকরা জানতে চান যে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অর্ধেকের বেশি কমা সত্ত্বেও বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়ছেনা কেন? এই সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীর পাশে বসেছিলেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানকে দেখিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, “ইনারা অর্থাৎ পেট্রোবাংলা বছরের পর বছর ভর্তুকি দিয়ে ভোক্তাদের কাছে তেল বিক্রি করেছে। এখন তাদেরকে লোকসান পুষিয়ে নেয়ার সুযোগ দিন।” যেমন কথা তেমন কাজ। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম অর্ধেকের বেশি কমে গেলেও বাংলাদেশে জ্বালানির দাম এতটুকু কমানো হয়নি। একটি রাষ্ট্র যে সরকারিভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে মুনাফাখুরী করতে পারে, একটি রাষ্ট্র যে প্রাইভেট সেক্টরের মতো মুনাফাখোর ব্যবসায়ী হিসেবে কম্পিটিশনে নামতে পারে সেটি এই সরকারের আচরণ না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
॥তিন॥
আমি প্রথমে বলেছিলাম যে আজকে বাজেটের নীটি গ্রিটিতে অর্থাৎ বাজেটের খুঁটিনাটি আলোচনায় যাবোনা। বাজেটের সাইজ অনেক বড় দেখিয়ে বাহাবা নেয়ার একটি প্রবণতা গত কয়েক বছর ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে। ৪ লক্ষ কোটির অধিক টাকার বাজেট বলে সরকার বগল বাজাচ্ছে। ৪ লক্ষ কোটি টাকার অধিক বাজেটের মধ্যে যদি লক্ষ কোটি টাকার বেশি ঘাটতি থাকে তাহলে সেই ধরনের বিশাল বাজেটের লাভ কি? আরেকটি বিষয়ের প্রতি কেউই নজর দিচ্ছেন না। এই বিষয়টি আমার কাছে অত্যন্ত বিস্ময়কর লাগে। লক্ষ কোটিরও বেশি টাকা লিকুইডিটি বা নগদ অলস অর্থ হিসাবে বিভিন্ন ব্যাংকে পড়ে আছে। এই বিশাল অংকের অর্থ যদি উৎপাদনমূলক খাতে বিনিয়োগ হতো তাহলে দেশে কি বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আসতো। আমানতকারীরা লক্ষ কোটি টাকার ওপর তাদের কষ্টের সঞ্চয় ব্যাংকে আমানত রাখছেন। অথচ বিনিময়ে তাদেরকে কি দেয়া হচ্ছে? এই তো কয়েক বছর আগেও যেখানে ৫ বছর মেয়াদী সঞ্চয় পত্রের সুদ ছিল ১৩ শতাংশ, আজ সেটি নামতে নামতে ৮ শতাংশে এসে ঠেকেছে। শোনা যাচ্ছে যে আমানতের সুদের হার নাকি আরো কমবে। অথচ এই ক্ষুদ্র সঞ্চয়ীদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় থেকে সরকার ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিতে যাচ্ছে। তার জন্য সরকার ব্যাংকে কত শতাংশ হারে সুদ দিচ্ছে?
সরকারের ঋণ প্রয়োজন, তারা আমানতের গচ্ছিত অর্থ দেখে ঋণ নেবে এতে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার ব্যাংকের নিকট থেকে কত শতাংশ হারে সুদ দিয়ে এই ঋণ নিচ্ছে? শোনা যায় যে সরকার যে ঋণ নিচ্ছে তার সুদের হার নাকি হবে ১২ শতাংশ। যদি তাই হয় তাহলে ক্ষুদ্র আমানতকারীদেরকে ৮ শতাংশ ঋণ দেয়া হবে কেন? মধ্যবর্তী ৪ শতাংশ সুদ নিয়ে ব্যাংকগুলোকে আরো মোটাতাজা করা হবে কেন? তেলে মাথায় তেল দেয়ার নীতি আর কতদিন চলবে?
॥চার॥
এবার বাজেট বরাদ্দ সম্পর্কে দুটি কথা। যথারীতি জন প্রশাসনে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পরিমাণ ৬৪ হাজার ৫ শত ৮৫ কোটি টাকা। শতাংশ হারে ৪৮.৩৫ শতাংশ। বিদ্যুৎ এবং জ্বালানিতে ২১ হাজার ১ শত ১৯ কোটি টাকা। শতাংশ হারে ৪৫.০২ শতাংশ। স্বাস্থ্য খাতে ২০ হাজার ৬ শত ৭৯ কোটি টাকা। শতাংশ হারে ৩৯.১৮ কোটি টাকা। পরিবহন এবং যোগাযোগ ৫০ হাজার ৯২ কোটি টাকা। শতাংশ হারে ৩৮.০৮ কোটি টাকা। প্রতিরক্ষা খাত ২৫ হাজার ৭ শত ৭১ কোটি টাকা। শতাংশ হারে ১০.৯৪ শতাংশ। কৃষি ২৪ হাজার ৪ শত ৩০ কোটি টাকা। শতাংশ হারে ২১.৯৩ শতাংশ। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ২৭ হাজার ৭শত ৮ কোটি টাকা। শতাংশ হারে ১১.৬০ শতাংশ। শিক্ষা এবং প্রযুক্তি ৬৫ হাজার ৪ শত ৫০ কোটি টাকা। শতাংশ হারে ৩০.১৩ শতাংশ। বাজেটের আকার ৪ লক্ষ ২শত ৬৬ কোটি টাকা। উন্নয়ন বাজেট ১ লক্ষ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। অনুন্নয়ন বাজেট ২ লক্ষ ৪৬ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা। ঘাটতি ১ লক্ষ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। ঘাটতি পূরণ (ক) ব্যাংক থেকে ঋণ ২৮ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। (খ) ব্যাংক ছাড়া অন্য খাত থেকে ঋণ, বিশেষ করে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ ৩২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। (গ) বৈদেশিক সূত্র থেকে ঋণ ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা।
আগামী অর্থ বছরের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে ৭.৪ শতাংশ। বিশ্ব ব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এই লক্ষ্য মাত্রাকে মাত্রাতিরিক্ত উচ্চাভিলাসী বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের মতে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়। যে বাজেটে ঘাটতি থাকে ২৮ শতাংশ তেমন উচ্চাভিলাসী বাজেট ইলেকশন বাজেট হয়, বাস্তববাদী বাজেট হয় না। আর ইলেকশন বাজেটে টাকা হরিলুট হয়, সুষ্ঠ উন্নয়ন হয় না।

http://www.dailysangram.com/post/286569-