৪ জুন ২০১৭, রবিবার, ১০:০৫

দুর্নীতি ও উন্নয়নের গল্প

চলতে ফিরতে দেখা

|| ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী ||

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক-সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তার দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, আগামীতে আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় না আসতে পারে, তাহলে ওই নেতাকর্মীদের টাকা-পয়সা নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। ওবায়দুল কাদের সম্ভবত তার দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে যে বিভেদ, তার দিকে ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন। দল যদি ঐক্যবদ্ধ না থাকে, যদি কোন্দল দলাদলিতে তারা জড়িয়ে পড়েন, যদি কেন্দ্রের নির্দেশ অমান্য করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তবে দল হারতে বাধ্য। আর দল হারলে তাদের পরিণতি কী হতে পারে। তবে ওবায়দুল কাদের যাই বলতে চেয়ে থাকুন না কেন, তার কথার মধ্য দিয়ে একটি নির্জলা সত্য খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আর তা হলো, আওয়ামী নেতাকর্মীরা গত ৯ বছর ধরে দুর্নীতি আর লুণ্ঠনের মাধ্যমে বিপুল বিত্তের মালিক হয়েছেন। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা এখন বিপুল বিত্তের মালিক। তাই দেখা যায়, ছাত্রলীগের নেতা বিয়ে করতে গেছেন হেলিকপ্টারে চড়ে। প্রায় সবারই আছে লেটেস্ট মডেলের গাড়ি আর কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা।
ওবায়দুল কাদের নিজ দলের নেতাকর্মীদের অসৎ পথে উপার্জিত টাকা নিয়ে পালাবার কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগ দল ‘ভালো’। এই দল তার সব স্তরের নেতাকর্মীদের নানাভাবে টাকা কামানোর ব্যবস্থা করে দেয়। আর তাই গড়ে উঠেছে শষ্য ক্ষেতের মাঝখানে অপ্রয়োজনীয় সেতু। রাস্তা নেই, ঘাট নেই, একটি ছোট সেতু বা কালভার্ট মুখ ব্যাদান করে দাঁড়িয়ে আছে। কেন এই আয়োজন? দলীয় নেতাকর্মীদের টাকা কামানোর ব্যবস্থা করার জন্য। সব ক্ষেত্রে এই টাকা কামানোর এক কায়দা নয়। আওয়ামী দলীয় নেতাকর্মীদের দেয়া হয়েছে ভবন নির্মাণকাজের ঠিকাদারি। সেখানে তারা ভবন নির্মাণে রডের বদলে দিয়েছেন বাঁশ। সব কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বা চাকরির জন্য আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগকে দিতে হয় লাখ লাখ টাকা ঘুষ। আওয়ামী নেতা বা এমপিরা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেন বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা। ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়ানোর নামে আওয়ামী লীগারদের দেয়া হলো আর একদফা লুণ্ঠনের সুযোগ।
এখন হাওরে দ্বিতীয় দফা লুণ্ঠনের আয়োজন চলছে। প্রথম দফা লুণ্ঠন হয়েছে বাঁধ নির্মাণ নিয়ে। হাওরে বাঁধ নির্মাণের সব ঠিকাদারি দেয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। তারা নির্ধারিত উচ্চতায় বাঁধ নির্মাণ করেননি। কেউ কেউ কোনো কাজ না করেই তুলে নিয়ে গেছেন বরাদ্দের টাকা। এটা নজরদারির দায়িত্ব যাদের ছিল, তাদের ঘাড়ে দুটো মাথা নেই যে, তারা আপত্তি করতে পারেন। ঠিকাদারকে বিল দিয়ে দিতে হয়েছে। আওয়ামী নেতাকর্মীরা ইউএনও-পুলিশসহ সব স্তরের সরকারি কর্মকর্তাকে কিল-ঘুষি লাথি মারার ‘অধিকার’ রাখেন। ডজন ডজন সরকারি কর্মকর্তা এদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। প্রতিকার কিছুই হয়নি। এখন দ্বিতীয় দফায় আওয়ামী লীগারদের লুণ্ঠনের সুবিধার জন্য বছরব্যাপী চাল ও টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কারা প্রকৃতই দুস্থ হয়ে গেছেন, তা প্রশাসন নির্ধারণ করছে না, নির্ধারণ করছেন আওয়ামী নেতাকর্মীরাই। ফলে সত্যিকার ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা তিরোহিত হয়ে গেছে। নিশ্চিত করেই বলা যায়, আওয়ামী লীগারদের লুণ্ঠনের সুবিধার জন্যই এ ব্যবস্থা করা হয়েছে।
দলটির সম্ভবত আশা ছিল যে, দলীয় নেতাকর্মীদের নীতি-নৈতিকতা, ন্যায়বিচার রহিত করে লুণ্ঠনের মাধ্যমে টাকা-পয়সা জমানো ব্যবস্থা করে দিলে তারা আরো নিবেদিতপ্রাণ হয়ে দলের জন্য রাস্তায় নামবে। দলের জন্য প্রয়োজন হলে জান দেবে। কিন্তু এখন তাদের ভিন্ন উপলব্ধি হয়েছে। তারা বুঝতে পারছেন যে, এখন যেহেতু যথেষ্ট টাকা-পয়সা হয়ে গেছে, অতএব সেই টাকা-পয়সা নিয়ে এরা দেশ ছেড়ে পালাবে। অর্থাৎ ধরা দেবে না। ওবায়দুল কাদেররা এই টাকা-পয়সাই চিনেছেন, আদর্শ বিষয়টা কোনো দিন উপলব্ধি করেননি। আসলে আওয়ামী লীগের কোনো রাজনৈতিক আদর্শ নেই। টাকাই তাদের কাছে একমাত্র আদর্শ। আওয়ামী লীগ সে আদর্শ কড়ায়-গণ্ডায় বাস্তবায়ন করেছে। এখন ভয়, দলের প্রয়োজনের সময় যদি তাদের রাজপথে পাওয়া না যায়। ওবায়দুল কাদেরসহ নেতারা নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, প্রয়োজনের সময় ওদের কাউকে তারা খুঁজে পাবেন না। ততদিনে তারা টাকা-পয়সা নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাবে।
ইন্টারনেটে ঢুকে বাংলাদেশে দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে পিলে চমকানো সব তথ্য পেলাম। সেখানে বাংলাদেশের দুর্নীতির নানা তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ঘুষ, চাঁদাবাজি, সরকারি তহবিলের তসরুফ, সেবায় বিলম্ব, দুর্নীতি, সরকারি কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীন আচরণের ফলে বাংলাদেশে সরকারি খাত সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত। তা ছাড়া, সব সেবা খাতই দুর্নীতিগ্রস্ত। ২০১২ সালের একটি জরিপের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, ৯৭ শতাংশ এমপি অবৈধ কার্যক্রমের সাথে জড়িত। স্থানীয় নির্বাচনে ৭৭ শতাংশ এমপি ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। ৭৫ শতাংশ এমপি উন্নয়ন প্রকল্প নিজ স্বার্থেই ব্যবহার করেন। তারা প্রকল্প অনুমোদনে ঘুষ গ্রহণ করেন। ৫৩ শতাংশ এমপি সরাসরি অপরাধমূলক তৎপরতায় জড়িত। ৬৯ শতাংশ এমপি সংগ্রহ অভিযানে আর ৬২ শতাংশ এমপি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৪৫ শতাংশ লোক মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত; ৪১ শতাংশ লোক মনে করেন, জাতীয় সংসদও দুর্নীতিগ্রস্ত। তাদের মতে, সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হচ্ছে, পুলিশ ও বিচার বিভাগ। অনেক এমপিকেই মনে করা হয় হাড়ে-মাংসে দুর্নীতিবাজ। আর দুর্নীতিবাজরা এখানে সাধারণত শাস্তির মুখোমুখি হন না। সংসদের ৫৬ শতাংশ সদস্য রাজনীতিক নন, ব্যবসায়ী। আর সেখানেই দুর্নীতিবাজের প্রতীক হিসেবে যার ছবি ভেসে উঠেছিল, তিনি একজন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী। সেখানে ব্যাপক দুর্নীতিবাজ হিসেবে আরো যাদের কৃতকর্মের বিবরণ লিপিবব্ধ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে আছেন সন্ত্রাস-কুখ্যাত জয়নাল হাজারী, রেলের দুর্নীতির জন্য কালো বিড়াল খ্যাত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, হলমার্ক কেলেঙ্কারির খলনায়ক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ডা: সৈয়দ মোদাছ্ছের আলী। উল্লেখ করা হয়েছে সাভারের রানা প্লাজার মালিক যুবলীগ নেতা সোহেল রানার নামও, যার ভবন ধসে মারা যান ১২০০’র মতো লোক। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগের নেতা। উল্লেখ করা হয়েছে আওয়ামী লীগ এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের কথা, যিনি মাতাল অবস্থায় সৌরভ নামের এক শিশুকে গুলি করে আহত করেছিলেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরের দুই ছেলেকে সুপ্রিম কোর্ট তিন বছরের জেল দিয়েছেন আত্মসাতের মামলায়। একই ধরনের আত্মসাতের মামলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। আপিল বিভাগও গত বছর ১০ এপ্রিল সে দণ্ড বহাল রাখেন। এ ছাড়া অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন মামলায় আওয়ামী লীগের এমপি আবদুর রহমান বদিকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
এত সব ঘটনার পরও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। তথাকথিত ওই নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দি¦তায় নির্বাচিত হয়েছেন ১৫৪ জন সদস্য। কিন্তু ওই নির্বাচনে যাদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়, তারা যেন এখন সব চেয়ে বেশি বেপরোয়া। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। বেরিয়ে আসছে অনির্বাচিত এমপিদের ব্যাপক দুর্নীতির চিত্রও।
তাদেরই একজন দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনাস্থল, রেইনট্রি হোটেলের মালিক আওয়ামী লীগের অনির্বাচিত সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুন (বি এইচ হারুন)। তার স্ত্রী ও তিন ছেলে এ হোটেলের পরিচালক। বনানীর আবাসিক এলাকায় রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই তিনি প্রভাব খাটিয়ে এ হোটেলটি নির্মাণ করেছেন। বেআইনিভাবে পরিচালিত হওয়ায় রাজউকের ভ্রাম্যমাণ আদালত গত ১৫ এপ্রিল হোটেলটি সিলগালা করে দিয়েছিলেন। বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল এর গ্যাস পানি বিদ্যুৎ। কিন্তু এমপি ক্ষমতার দাপটে কয়েক দিনের মধ্যেই ওই সব সংযোগ পুনঃস্থাপিত হয়। কিন্তু কোথা থেকে এলো তার এত টাকা?
২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনের হলফনামায় তিনি নিজের সম্পদ দেখান ৩৮ লাখ টাকার। সে সময় তার স্ত্রীর নামে কিছুই ছিল না। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে হলফনামায় তিনি দেখালেন, তার নিজের ও স্ত্রীর নামে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ রয়েছে ১৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া নগদ দুই কোটি ৯০ লাখ টাকা, ব্যাংকে ৬৭ লাখ এবং ব্যাংকে স্থায়ী আমানত ৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। আর জমি দেখান গাজীপুরে ১৭ কাঠা, মীরপুরে ৫ কাঠা, বারিধারায় ৬ কাঠা ও সাড়ে চার কাঠার দু’টি প্লট। এ ছাড়া তিনি ছোট ছেলে আদনানকে দু’টি জাহাজ কিনতে ১৩ কোটি টাকা এবং বড় ছেলে নাহিয়ানকে প্রিমিয়াম ব্যাংকের পরিচালক হতে ২০ কোটি টাকা দিয়েছেন। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ভাই ফয়জুর রব আজাদের নামে জমা রাখেন ১৫ কোটি টাকা। এ টাকার উৎসের কোনো খবর নেই।
তবে প্রিমিয়াম ব্যাংকের গ্রাহক রুমি এন্টারপ্রাইজের মালিক খলিলুর রহমানের ১৩৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন বি এইচ হারুন চেক জালিয়াতির মাধ্যমে। এর বিরুদ্ধে খলিলুর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদকে প্রতিকারের আবেদন জানিয়েছেন। জনাব হারুন প্রিমিয়াম ব্যাংকের চেয়ারম্যান এইচ বি এম ইকবালের ভগ্নিপতি। দুদক হারুনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও পরে পিছিয়ে যায়। খলিলুর রহমানের সাথে একটি নিষ্পত্তিতে আসার জন্য তিনি তাকে ৫ কোটি টাকার একটি চেক দিলেও সে চেক ডিজঅনার হয়। রুমি এন্টারপ্রাইজের মালিক খলিলুর রহমান জানান, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিন যাচ্ছে। হুমকি দিচ্ছে মেরে ফেলার। বনানী ও গুলশান থানায় ৫টি সাধারণ ডায়েরি করেছি। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচারপ্রার্থী।’ আওয়ামী শাসনামলে এ রকম একজন নয়, শত শত ব্যক্তি তৈরি হয়েছে। উন্নয়নের ফিরিস্তি গাইলেও এটাই হচ্ছে চিত্রপট।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/225413