৩ জুন ২০১৭, শনিবার, ১০:৪৯

সেন্টমার্টিনে খাদ্য সঙ্কট

ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’য় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দ্বীপ সেন্টমার্টিনে গত বুধবার থেকে ত্রাণ বিতরণ শুরু করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতেই নৌবাহিনীর ত্রাণবাহী জাহাজ ত্রাণ নিয়ে দ্বীপে পৌঁছে। বুধবার সকাল থেকে দ্বীপের ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের মধ্যে এসব বিতরণ করা হয়। তবে ত্রাণের নামে বিতরণ করা হচ্ছে শুকনা খাবার। প্রতিটি প্যাকেটে এক কেজি করে মুড়ি, চিঁড়া, গুড় ও পানির বোতল দেয়া হচ্ছে। অথচ ঘূর্ণিদুর্গত সাড়ে আট হাজার দ্বীপবাসী আকস্মিক খাদ্যাভাবের মুখে পড়েছে। দ্বীপে গত বুধবার এক কেজি মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৫০-৫১ টাকা করে।

সেন্টমার্টিন দ্বীপের পশ্চিমপাড়ার চাল দোকানি জাফর আলম বলেন, টেকনাফের সাথে গত ক’দিন নৌচলাচল বন্ধ থাকায় দ্বীপে চালসহ নিত্যপণ্যের অভাব দেখা দিয়েছে। আমার দোকানে ১৩ বস্তা মোটা চাল ছিল। তার মধ্যে আট বস্তা বাকিতে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি। কেননা ত্রেতারা সবাই আত্মীয়স্বজন। তিনি বলেন, চটের বস্তার ৫০ কেজির চাল বিক্রি করছি দুই হাজার ৬০০ টাকা এবং প্লাস্টিকের বস্তার ৫০ কেজির চাল বিক্রি করা হচ্ছে দুই হাজার ৪০০ টাকা করে। এক কেজি ললিতা আলু বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকায়।
চাল দোকানি জাফর আলম বলেন, ঝড় কবলিত দ্বীপবাসীর এমন অবস্থায় বিতরণ করা হয়েছে এক কেজি করে চিঁড়া, মুড়ি, গুড় ও এক বোতল করে পানি। পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক জসিম উদ্দিন জানান, সত্যি দ্বীপের মানুষ এখন বড়ই বিপদে রয়েছেন। এমন কোনো ঘর নেই ক্ষতির শিকার হয়নি। দ্বীপের গাছ ভেঙে ঘরের চালে পড়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে।
সেন্টমার্টিন দ্বীপ ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আবছার কামাল বলেনÑ দ্বীপে এক দিকে নিত্যপণ্যের অভাব দেখা দিয়েছে অন্য দিকে দ্বীপের বাসিন্দাদের হাতে নগদ টাকাও নেই। এ অবস্থায় মানুষ সত্যি বেশ কষ্টের মুখে রয়েছেন। সেন্টমার্টিন দ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ থাকায় টানা কয়েক দিন ধরে টেকনাফের সাথে দ্বীপের নৌযোগাযোগ বন্ধ থাকায় আকস্মিক পণ্য সমাগ্রীর আভাব দেখা দিয়েছে।
এ দিকে জেলা প্রশাসক মো: আলী হোসেন জানিয়েছেন-দ্বীপে পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এখানে ত্রাণের কোনো অভাব নেই। যতটুকু সমস্যা দেখা দিয়েছে তা সাময়িক। গত বুধবার নৌবাহিনীর জাহাজে যেসব শুকনা খাবার দেয়া হয়েছে তাও জরুরি ভিত্তিতে দেয়া হয়েছে। সেন্টমার্টিনের জন্য ২০ টন চাল বরাদ্দের তথ্য দিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, কেবল যাতায়াত সমস্যা।
এ দিকে সেন্টমার্টিনের পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হচ্ছে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরির দ্বীপ। ৫ বছর ধরে প্রতিরক্ষা বেড়িবাঁধ না থাকায় এ দ্বীপের ৪০ হাজার মানুষ এমনিতেই সাগরের জোয়ার-ভাটার পানিতে একাকার থেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এমন অবস্থায় ঘূর্ণিঝড় মোরা এখানকার মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। শাহপরির দ্বীপের জেলেপাড়ার অবস্থান নাফ নদীর তীরে। পাড়াটিতে চার শতাধিক বসতি। বাসিন্দারা সবাই জেলে। পাড়ার লোকজন ঝড়ের পর থেকে তীব্র পানীয়জলের সঙ্কটে রয়েছেন।
এ পাড়ার শতাধিক স্কুল-মাদরাসাপড়–য়া কিশোর-কিশোরী ঝড়ে হারিয়েছে পাঠ্যবইসহ শিক্ষা উপকরণ। পাড়ার সুমাইয়া-ইমরান ভাইবোন জালিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম ও চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। তাদের বাবা ধলু হোসেন পেশায় জেলে। ঝড়ের রাতে তারা এলাকার আশ্রয় কেন্দ্রে দৌড় দেন। টেবিলেই ছিল বইখাতাসহ অন্যান্য উপকরণ। ঝড় শেষে ঘরে ফিরে দেখেন সবই ঝড়-বৃষ্টিতে শেষ হয়ে গেছে। এ রকম পাড়ার প্রায় সব শিক্ষার্থী হারিয়েছে বইখাতা।
এ দিকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মোরার তাণ্ডবে কক্সবাজারে ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ তৈরির কাজ চলছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, সরেজমিন ক্ষতি নিরূপণ করা হচ্ছে। অন্যবারের দুর্যোগের সময় তাৎক্ষণিক ক্ষতির প্রতিবেদন মাঠপর্যায় থেকে টেলিফোন বা মোবাইল/ফ্যাক্সে তৈরি করে জেলা থেকে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হলেও এবার একটু ভিন্নভাবে করা হচ্ছে। এ কারণে একটু বিলম্ব হচ্ছে ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে।
তবে ইতোমধ্যে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন থেকে ক্ষতির একটি প্রাথমিক তথ্য সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে প্রেরণ করা হয়েছে। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো: আলী হোসেন জানান, প্রাথমিকভাবে ক্ষতির চিত্র হচ্ছে জেলায় ঘূর্ণিঝড় মোরার তাণ্ডবে সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ১৭ হাজার ২৩টি ঘরবাড়ি। আংশিকভাবে ক্ষতি হয়েছে ৩৫ হাজার ৫১৬টি ঘরবাড়ি ও ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ৫২ হাজার। মঙ্গলবার ভোর রাতে ঝড়ে পাঁচজনের প্রাণহানি ছাড়া নতুন কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।
অন্য দিকে ঘূর্ণিঝড় মোরার তাণ্ডবে সাগরে বেশ কিছু মাছ ধরার নৌকা ডুবে গেছে। আবার বেশ কিছু নৌকা নিখোঁজও রয়েছে। এসব নৌকার অর্ধশতাধিক জেলের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা জানা যায়নি। কক্সবাজারের খুরুশকুলের দু’টি নৌকা কলাতলি সৈকতে নোঙর দেয়া অবস্থায় ঝড়ে ডুবে গেলেও নৌকার ১৫ জেলের খোঁজ মেলেনি। এ দিকে কুতুবদিয়া দ্বীপের মাছধরা নৌকা মালিক সমিতির সভাপতি জয়নাল আবেদীন বলেন, কুতুবদিয়া ও বাঁশখালী উপজেলার কমপক্ষে ১৫-২০টি নৌকা মঙ্গলবার সকালে ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে গেছে। এসব নৌকার অর্ধশতাধিক জেলের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা জানা যায়নি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/225266